আইয়ুব আল-আমিন
কয়েকদিন হলো, আমার বড় পুত্রবধূ আমেরিকা থেকে ঢাকায় এসেছে। সে অন্যান্য জিনিসসহ আমার জন্য বেশকিছু গোটচিজ (Goat Cheese) নিয়ে এসেছে। এই গোটচিজ আমার শুধু পছন্দের খাবারই নয়, এটার বিষয়ে আমি খুব নস্ট্যালজিকও বটে!
আমি আমার পাইলট জীবনের ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট করেছি। সবচেয়ে বেশি ফ্লাইট করেছি এথেন্সে।
গ্রিক খাবার আমার খুবই পছন্দের। ওদের ল্যাম্বচপ, গ্রিকস্যালাড, ছোট ছোট ড্যারসের সবজি এসবের তুলনা হয় না। ওখানে গেলে আমার ব্রেকফাস্ট শুরু হতো ছাগলের দুধ দিয়ে তৈরি করা দই, দুই-তিন টুকরা পাঁউরুটি এবং গোটচিজসহকারে গ্রিনটি দিয়ে। তবে দুপুরের খাবারে জন্য প্রায়ই চলে যেতাম কনিনগস স্কোয়ারের এসকন অর্থাৎ কৃষ্ণ কনসাস্ সোসাইটিতে। ওখানকার এসকন-ভবনটি ছিল তিনতলা বিশিষ্ট। নিচতলায় ছিল ‘গোবিন্দ রেস্তোরাঁ’ নামের একটি ছোট রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁটির রান্না-বান্নার তদারকি করত প্যাট্রেসিয়া নামের একজন ফরাসী মেয়ে।
ওখানে ছিলেন জগানন্দ এবং মহানন্দ নামের দুজন কৃষ্ণভক্ত আমেরিকান। তারা বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করে ওই নাম গ্রহণ করেছিলেন। তারা দুজনেই ছিলেন মধ্যবয়সী। আমার বয়স ছিল মধ্য ত্রিশ। প্যাট্রেসিয়ার বয়স ছিল ত্রিশের মতোই।
প্যাট্রেসিয়া বেশ কয়েক বছর এসকন সোসাইটির সঙ্গে সম্পর্কিত থাকলেও কখনও বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেননি। নামও বদল করেননি। তিনি এক বছর ভারতের বৃন্দাবনে কাটিয়েছিলেন। এরপর পশ্চিম বাংলার মায়াপুর ছিলেন চার বছর। ওখানে থাকার সময় বাঙালী রন্ধন প্রক্রিয়া এতটাই আয়ত্ত করেন যে, কোন বাঙালী মহিলাও অত সুন্দর রান্না করতে পারবে না। প্যাট্রেসিয়া ছিলেন ফরাসী দেশের মেয়ে। তাই তার নিরামিষ রান্নার মাঝেও ফরাসী সৌরভ ছিল।
গোবিন্দ রেস্তোরাঁয় দুপুর এবং রাতের বেলা মিলিয়ে ৪০ থেকে ৫০ জনের বেশি খরিদ্দার হতো না। ওই রেস্তোরাঁয় ছিল একজন মাত্র রাঁধুনি এবং একজন খাবার পরিবেশনকারী। সবকিছু তদারকির দায়িত্বে থাকতেন প্যাট্রেসিয়া। রেস্তোরাঁর পরিবেশ ছিল যথাসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। খাবার পরিবেশনকারী হাতে গ্লাভস পরত। গোবিন্দ রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করত এসকনের সদস্যরাই। তবে অন্য ধর্মের মানুষের ওখানে খাওয়া-দাওয়া করার বাধানিষেধ ছিল না।
খাওয়া-দাওয়ার দামও বেশি ছিল না। তবে ওখানে খাওয়ার জন্য আমাকে কোন অর্থকড়ি দিতে হতো না। এথেন্স যাওয়ার আগে আমি ফ্লাইট নিয়ে যেতাম দুবাই। দুবাইতে দুই তিন দিন থাকার পর ফ্লাইট নিয়ে যেতাম এথেন্সে। দুবাই থেকে খুব উঁচুমানের কয়েক কেজি বাসমতি চাল নিয়ে যেতাম ‘গোবিন্দ রেস্তোরাঁ’র জন্য। এছাড়া এথেন্সের এসকনে আমাকে বেশ সমাদরই করা হতো।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করার পর জগানন্দ-মহানন্দ এবং প্যাট্রেসিয়ার সঙ্গে বেশকিছু সময় আড্ডা এবং গল্পগুজব করার পর বিকেল চারটার দিকে প্যাট্রেসিয়া এবং আমি স্বাস্থ্য রক্ষার্থে হাঁটতে বেরোতাম।
প্যাট্রেসিয়া যখন হাঁটতে বেরোতো তখন খুব সুন্দর শাড়ি-ব্লাউজ পরত। শাড়ির রঙের সঙ্গে ম্যাচিং করে কপালে টিপ পরত। আমি লালপাড়ের সিল্কের লুঙ্গি এবং সিল্কের ফতুয়া পরতাম। শাড়ি-ব্লাউজ পরা প্যাট্রেসিয়াকে এবং লালপাড়ের লুঙ্গি পরা আমাকে একসঙ্গে হাঁটতে দেখে, পথচারীরা আমাদের স্বামী-স্ত্রী বলেই মনে করত। মুম্বাইর ক্রফোর্ড মার্কেটের একটি নির্দিষ্ট দোকান থেকে আমি ওই লুঙ্গি এবং ফতুয়াগুলো কিনতাম। সিনতেগমা স্কোয়ার (পার্লামেন্ট ভবন প্রাঙ্গণ) ওদিয়ন থিয়েটার প্রাঙ্গণ। ফ্লিমার্কেট এসব এলাকায় ঘণ্টা দেড়েক হাঁটার পর আমি চলে যেতাম আমার হোটেলে। কোন কোন দিন প্যাট্রেসিয়ার অনুরোধে গোবিন্দ রেস্তোরাঁয়ও রাতের খাবার খেতে যেতাম। প্যাট্রেসিয়ার সঙ্গে চলতে ফিরতে সুবিধা ছিল। কারণ, ও বাংলা বলত স্বচ্ছন্দে এবং পরিশুদ্ধভাবে।
প্যাট্রেসিয়ার সঙ্গে ভাল বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কোন সম্পর্ক আমার ছিল না। তার পরিচ্ছন্ন-মার্জিত চেহারার জন্য আজ ত্রিশ বছর পরেও তাকে বেশ মনে পড়ে।
দুই
এথেন্সের কথা এতটা বিস্তারিত করে লিখতে গিয়ে মনে হলো, টোকিওর কথাও সংক্ষিপ্তাকারে কিছু লিখি।
১৯৯২ সালের কথা।
আমি ঢাকা থেকে টোকিও ফ্লাইট নিয়ে যাব। বন্ধুবর হায়াৎ মামুদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, টোকিও গেলে আমি যেন প্রফেসর কাজুয়ো আজুমার সঙ্গে যোগাযোগ করি; একই সঙ্গে জাপানের ইউনেস্কো প্রধান তানজীমা সিনজীর সঙ্গেও যোগাযোগ করি। এই বলে হায়াৎ মামুদ তাদের দুজনারই টেলিফোন নম্বর আমাকে দিলেন।
১৯৯২ সালে প্রফেসর আজুমার বয়স ছিল ৭৫ বছর। প্রথম জীবনের ১৭ বছর তিনি ছিলেন টোকিও ইউনিভার্সিটির জার্মান ভাষার অধ্যাপক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলী’ কাব্যগ্রন্থখানার ইংরেজী অনুবাদ পড়ে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে মনে করলেন, কবিতার তো অনুবাদ হয় না; তারপরেও ‘গীতাঞ্জলী’ কাব্যগ্রন্থখানার ইংরেজী অনুবাদ যখন এতটাই সুন্দর, তাহলে অরিজিন্যাল ‘গীতাঞ্জলী’ কাব্যগ্রন্থখানা কতোই না সুন্দর হবে? এ কথা মনে করে তিনি নিজের চেষ্টায় বাংলা ভাষা শেখেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপান সম্পর্কিত বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে তিনি টোকিওর রেইতুকু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। তার স্ত্রী কেউকো আজুমা টোকিরও অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। তাদের একমাত্র মেয়ে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসখানা নিজেই অনুবাদ করেছেন। সমগ্র রবীন্দ্র-রচনাবলী জাপানী ভাষায় অনুবাদ করার কমিটিরও প্রধান ছিলেন।
এবার আমি বলছি, তানজিমা শিনজীর কথা-
তিনি জাপানের ইউনেস্কোর প্রধান। ১৯৮০ বা ’৮১ সালে তার লেখা ‘খবমবহফ ড়ভ ঞযব ংঁৎঢ়ৎরংব চষধহবঃ’ বইখানা প্রকাশিত হয়। বইখানা বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বিশ্বের অনেকগুলো ভাষায় বইখানার অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষায়ও বইখানার অনুবাদ করেছিলেন, আমাদের শিল্পকলা একাডেমির সাবেক ডিজি মোবারক হোসেন সাহেব। তবে তানজিমা শিনজীর বিশ্বখ্যাত বই ‘এধঁফর’ং ঙপবধহ’ ১৯৮৯ বা ’৯০ সালে প্রকাশিত হয়। দুখানা বইই তিনি আমাকে দিয়েছিলেন।
টোকিওতে পৌঁছে যখন প্রফেসর আজুমার সঙ্গে যোগাযোগ করি তখন তানজিমা শিনজীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলাম। একদিন পর প্রফেসর আজুমা সস্ত্রীক আমাদের হোটেলে এলেন সন্ধ্যা সাতটার দিকে। একটু পরে তানজিমা শিনজীও এলেন। তখন আমার রুমে বাংলাদেশ বিমানের এয়ারহোস্টেজ জাবীন ছিলেন। মেহমানদের দেখে তিনি চলে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে অনুরোধ করলাম, ঢাকা থেকে আনা চানাচুর এবং চা পরিবেশন করতে। জাবীন সে অনুরোধ রক্ষা করেন।
আজুমার পতœী কেউকো আজুমা একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং একটি জাপানী সঙ্গীত পরিবেশন করে আমাদের মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনিও বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারতেন।
তানজিমা শিনজী আমাকে এশিয়ান কালচারাল সেন্টারে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। পরেরদিন দুপুর বেলায় এশিয়ান কালচারাল সেন্টারে গেলাম। তখন তানজীমা শিনজীর অফিসে মাসুকো আনুকি নামের বেশ সুন্দরী একটি মেয়ে ছিল। তানজিমা তার সঙ্গে আমাকে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, আনুকি খুব ভাল ভরতনাট্যম নাচতে জানেন। তিনি জাপানী ভরতনাট্যম দলের প্রতিনিধি হয়ে দুবার ভারত ভ্রমণ করেছেন। আনুকি ছিলেন ইউনেস্কোর ‘ইড়ড়শ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ধহফ খরঃবৎধপু’ বিভাগের প্রধান।
তখন দুপুর বেলা। তাই তানজিমা শিনজী এবং আনুকি আমাকে বললেন, চলুন কাছেই একটি জাপানি রেস্তোরাঁয় গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আসি। বললাম, দুপুরে আমি কিছু খাই না। আমার মেয়ে আমেরিকায় ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। প্রতি মাসে আমি যে মাইনে পাই, তার থেকে নিজের খরচের জন্য কিছু অর্থ রেখে বাকিটা সবটা মেয়ের পড়ার খরচের জন্য পাঠিয়ে দেই। জাপানী রেস্তোরাঁয় খাবারের মূল্য অনেক। সেটা পরিশোধ করার আমার সামর্থ্য নেই। তবে কাল বা পরশু আপনারা যদি আমার হোটেলে আসেন এবং রুমের বারান্দায় এক্সটেনশন ক্যাবল নিয়ে সুপারকুকারে আমি যে বাঙালী খিচুড়ি রান্না করব সেটার স্বাদ গ্রহণ করতে রাজি থাকেন, তা হলে আমি আপনাদের সঙ্গে খেতে রাজি আছি।
খিচুড়ির স্বাদ গ্রহণের আগে বাংলাদেশী চানাচুরের সঙ্গে হুইস্কি এবং ব্রান্ডি অবশ্যই থাকবে। এ্যারোপ্লেনের প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের যে সৌজন্যমূলক পানীয় পরিবেশন করা হয়, তার অনেকটাই উদ্বৃত্ত থেকে যায়। ওই উদ্বৃত্ত পানীয় থেকে দুই একটি বোতল হুইস্কি-ব্রান্ডি আমি নিয়ে আসি। তানজিমা এবং আনুকির সঙ্গে দুপুরের ভোজনপর্ব হয়েছিল খুবই উপাদেয়।
ওই দিনই সন্ধ্যার দিকে মিসাকো আনুকি আমার হোটেলে একাই এলেন। বললেন তানজিমা একটা বিশেষ কাজে আটকে যাওয়ায় আসতে পারেননি। বললাম, তানজিমা যে আসতে পারবেন না, সে কথা টেলিফোন করে তিনি আমাকে জানিয়েছেন। বলেছেন, তার বাসায় শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশাই আসবেন।
সুপারকুকারের মাধ্যমে আমার খিচুড়ি রান্না করা শেষ হয়েছিল। আনুকি এবং আমি চানাচুরসহকারে হুইস্কি পান করছিলাম। রাত দশটায় আমরা খিচুড়ি খেলাম। আনুকি বললেন, এমন সুস্বাদু খাবার আমি খুব কমই খেয়েছি। এই খিচুড়ি রান্না করার রেসিপি এবং রান্না করার কৌশল কিন্তু আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে।
জাপানে যতদিন বিমানের ফ্লাইট চলেছে, ততদিন তানজিমা শিনজী, প্রফেসর আজুমা এবং মিসাকো আনুকির সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক বজায় ছিল।
আমি যে আমার মেয়ের পড়ার খরচ চালানোর জন্য একবেলা উপবাস করি, রুমের ভেতরে রান্না করে খাইÑএই বিষয়টা নিয়ে তানজিমা শিনজী ‘ঋধঃযবৎ ধহফ উধঁমযঃবৎ’ নাম দিয়ে একটি গল্প লিখেছেন। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক যে আমার মেয়ে এবং আমাকে নিয়ে এ রকম একটি গল্প লিখবেন, এ কথা ভেবে আমি বিস্মিত হয়েছি।
২০০১ বা ২০০২ সালে আমার এক বন্ধু জাপানে গিয়েছিলেন এবং প্রফেসর আজুমা এবং তানজিমা শিনজীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তানজিমা তাকে ওই গল্প লেখার কথা বলেছিলেন। এ কথাও বলেছিলেন, ওই গল্পটা ইংরেজী ভাষায় অনূদিত হলে তা তিনি আমাকে পাঠাবেন।