ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কথা ও কাহিনী

আলমগীর সাত্তার

প্রকাশিত: ০১:৩৬, ২৯ জুলাই ২০২২

কথা ও কাহিনী

আইয়ুব আল-আমিন

কয়েকদিন হলো, আমার বড় পুত্রবধূ আমেরিকা থেকে ঢাকায় এসেছেসে অন্যান্য জিনিসসহ আমার জন্য বেশকিছু গোটচিজ (Goat Cheese) নিয়ে এসেছেএই গোটচিজ আমার শুধু পছন্দের খাবারই নয়, এটার বিষয়ে আমি খুব নস্ট্যালজিকও বটে!

আমি আমার পাইলট জীবনের ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট করেছিসবচেয়ে বেশি ফ্লাইট করেছি এথেন্সে

গ্রিক খাবার আমার খুবই পছন্দেরওদের ল্যাম্বচপ, গ্রিকস্যালাড, ছোট ছোট ড্যারসের সবজি এসবের তুলনা হয় নাওখানে গেলে আমার ব্রেকফাস্ট শুরু হতো ছাগলের দুধ দিয়ে তৈরি করা দই, দুই-তিন টুকরা পাঁউরুটি এবং গোটচিজসহকারে গ্রিনটি দিয়েতবে দুপুরের খাবারে জন্য প্রায়ই চলে যেতাম কনিনগস স্কোয়ারের এসকন অর্থা কৃষ্ণ কনসাস্ সোসাইটিতেওখানকার এসকন-ভবনটি ছিল তিনতলা বিশিষ্টনিচতলায় ছিল গোবিন্দ রেস্তোরাঁনামের একটি ছোট রেস্তোরাঁরেস্তোরাঁটির রান্না-বান্নার তদারকি করত প্যাট্রেসিয়া নামের একজন ফরাসী মেয়ে

ওখানে ছিলেন জগানন্দ এবং মহানন্দ নামের দুজন কৃষ্ণভক্ত আমেরিকানতারা বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করে ওই নাম গ্রহণ করেছিলেনতারা দুজনেই ছিলেন মধ্যবয়সীআমার বয়স ছিল মধ্য ত্রিশপ্যাট্রেসিয়ার বয়স ছিল ত্রিশের মতোই

প্যাট্রেসিয়া বেশ কয়েক বছর এসকন সোসাইটির সঙ্গে সম্পর্কিত থাকলেও কখনও বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেননিনামও বদল করেননিতিনি এক বছর ভারতের বৃন্দাবনে কাটিয়েছিলেনএরপর পশ্চিম বাংলার মায়াপুর ছিলেন চার বছরওখানে থাকার সময় বাঙালী রন্ধন প্রক্রিয়া এতটাই আয়ত্ত করেন যে, কোন বাঙালী মহিলাও অত সুন্দর রান্না করতে পারবে নাপ্যাট্রেসিয়া ছিলেন ফরাসী দেশের মেয়েতাই তার নিরামিষ রান্নার মাঝেও ফরাসী সৌরভ ছিল

গোবিন্দ রেস্তোরাঁয় দুপুর এবং রাতের বেলা মিলিয়ে ৪০ থেকে ৫০ জনের বেশি খরিদ্দার হতো নাওই রেস্তোরাঁয় ছিল একজন মাত্র রাঁধুনি এবং একজন খাবার পরিবেশনকারীসবকিছু তদারকির দায়িত্বে থাকতেন প্যাট্রেসিয়ারেস্তোরাঁর পরিবেশ ছিল যথাসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্নখাবার পরিবেশনকারী হাতে গ্লাভস পরতগোবিন্দ রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করত এসকনের সদস্যরাইতবে অন্য ধর্মের মানুষের ওখানে খাওয়া-দাওয়া করার বাধানিষেধ ছিল না

খাওয়া-দাওয়ার দামও বেশি ছিল নাতবে ওখানে খাওয়ার জন্য আমাকে কোন অর্থকড়ি দিতে হতো নাএথেন্স যাওয়ার আগে আমি ফ্লাইট নিয়ে যেতাম দুবাইদুবাইতে দুই তিন দিন থাকার পর ফ্লাইট নিয়ে যেতাম এথেন্সেদুবাই থেকে খুব উঁচুমানের কয়েক কেজি বাসমতি চাল নিয়ে যেতাম গোবিন্দ রেস্তোরাঁর জন্যএছাড়া এথেন্সের এসকনে আমাকে বেশ সমাদরই করা হতো

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করার পর জগানন্দ-মহানন্দ এবং প্যাট্রেসিয়ার সঙ্গে বেশকিছু সময় আড্ডা এবং গল্পগুজব করার পর বিকেল চারটার দিকে প্যাট্রেসিয়া এবং আমি স্বাস্থ্য রক্ষার্থে হাঁটতে বেরোতাম

প্যাট্রেসিয়া যখন হাঁটতে বেরোতো তখন খুব সুন্দর শাড়ি-ব্লাউজ পরতশাড়ির রঙের সঙ্গে ম্যাচিং করে কপালে টিপ পরতআমি লালপাড়ের সিল্কের লুঙ্গি এবং সিল্কের ফতুয়া পরতামশাড়ি-ব্লাউজ পরা প্যাট্রেসিয়াকে এবং লালপাড়ের লুঙ্গি পরা আমাকে একসঙ্গে হাঁটতে দেখে, পথচারীরা আমাদের স্বামী-স্ত্রী বলেই মনে করতমুম্বাইর ক্রফোর্ড মার্কেটের একটি নির্দিষ্ট দোকান থেকে আমি ওই লুঙ্গি এবং ফতুয়াগুলো কিনতামসিনতেগমা স্কোয়ার (পার্লামেন্ট ভবন প্রাঙ্গণ) ওদিয়ন থিয়েটার প্রাঙ্গণফ্লিমার্কেট এসব এলাকায় ঘণ্টা দেড়েক হাঁটার পর আমি চলে যেতাম আমার হোটেলেকোন কোন দিন প্যাট্রেসিয়ার অনুরোধে গোবিন্দ রেস্তোরাঁয়ও রাতের খাবার খেতে যেতামপ্যাট্রেসিয়ার সঙ্গে চলতে ফিরতে সুবিধা ছিলকারণ, ও বাংলা বলত স্বচ্ছন্দে এবং পরিশুদ্ধভাবে

প্যাট্রেসিয়ার সঙ্গে ভাল বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কোন সম্পর্ক আমার ছিল নাতার পরিচ্ছন্ন-মার্জিত চেহারার জন্য আজ ত্রিশ বছর পরেও তাকে বেশ মনে পড়ে

 

দুই

এথেন্সের কথা এতটা বিস্তারিত করে লিখতে গিয়ে মনে হলো, টোকিওর কথাও সংক্ষিপ্তাকারে কিছু লিখি

১৯৯২ সালের কথা

আমি ঢাকা থেকে টোকিও ফ্লাইট নিয়ে যাববন্ধুবর হায়া মামুদের সঙ্গে কথা হচ্ছিলতিনি বললেন, টোকিও গেলে আমি যেন প্রফেসর কাজুয়ো আজুমার সঙ্গে যোগাযোগ করি; একই সঙ্গে জাপানের ইউনেস্কো প্রধান তানজীমা সিনজীর সঙ্গেও যোগাযোগ করিএই বলে হায়া মামুদ তাদের দুজনারই টেলিফোন নম্বর আমাকে দিলেন

১৯৯২ সালে প্রফেসর আজুমার বয়স ছিল ৭৫ বছরপ্রথম জীবনের ১৭ বছর তিনি ছিলেন টোকিও ইউনিভার্সিটির জার্মান ভাষার অধ্যাপকরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলীকাব্যগ্রন্থখানার ইংরেজী অনুবাদ পড়ে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে মনে করলেন, কবিতার তো অনুবাদ হয় না; তারপরেও গীতাঞ্জলীকাব্যগ্রন্থখানার ইংরেজী অনুবাদ যখন এতটাই সুন্দর, তাহলে অরিজিন্যাল গীতাঞ্জলীকাব্যগ্রন্থখানা কতোই না সুন্দর হবে? এ কথা মনে করে তিনি নিজের চেষ্টায় বাংলা ভাষা শেখেন১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপান সম্পর্কিত বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেনবর্তমানে তিনি টোকিওর রেইতুকু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকতার স্ত্রী কেউকো আজুমা টোকিরও অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকাতাদের একমাত্র মেয়ে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করছেনতিনি রবীন্দ্রনাথের গোরাউপন্যাসখানা নিজেই অনুবাদ করেছেনসমগ্র রবীন্দ্র-রচনাবলী জাপানী ভাষায় অনুবাদ করার কমিটিরও প্রধান ছিলেন

এবার আমি বলছি, তানজিমা শিনজীর কথা-

তিনি জাপানের ইউনেস্কোর প্রধান১৯৮০ বা ৮১ সালে তার লেখা খবমবহফ ড়ভ ঞযব ংঁরংব চষধহবঃবইখানা প্রকাশিত হয়বইখানা বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেনবিশ্বের অনেকগুলো ভাষায় বইখানার অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছেবাংলা ভাষায়ও বইখানার অনুবাদ করেছিলেন, আমাদের শিল্পকলা একাডেমির সাবেক ডিজি মোবারক হোসেন সাহেবতবে তানজিমা শিনজীর বিশ্বখ্যাত বই এধঁফরং ঙপবধহ১৯৮৯ বা ৯০ সালে প্রকাশিত হয়দুখানা বইই তিনি আমাকে দিয়েছিলেন

টোকিওতে পৌঁছে যখন প্রফেসর আজুমার সঙ্গে যোগাযোগ করি তখন তানজিমা শিনজীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলামএকদিন পর প্রফেসর আজুমা সস্ত্রীক আমাদের হোটেলে এলেন সন্ধ্যা সাতটার দিকেএকটু পরে তানজিমা শিনজীও এলেনতখন আমার রুমে বাংলাদেশ বিমানের এয়ারহোস্টেজ জাবীন ছিলেনমেহমানদের দেখে তিনি চলে যাচ্ছিলেনআমি তাকে অনুরোধ করলাম, ঢাকা থেকে আনা চানাচুর এবং চা পরিবেশন করতেজাবীন সে অনুরোধ রক্ষা করেন

আজুমার পতœী কেউকো আজুমা একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং একটি জাপানী সঙ্গীত পরিবেশন করে আমাদের মুগ্ধ করে দিয়েছিলেনতিনিও বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারতেন

তানজিমা শিনজী আমাকে এশিয়ান কালচারাল সেন্টারে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেনপরেরদিন দুপুর বেলায় এশিয়ান কালচারাল সেন্টারে গেলামতখন তানজীমা শিনজীর অফিসে মাসুকো আনুকি নামের বেশ সুন্দরী একটি মেয়ে ছিলতানজিমা তার সঙ্গে আমাকে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিলেনবললেন, আনুকি খুব ভাল ভরতনাট্যম নাচতে জানেনতিনি জাপানী ভরতনাট্যম দলের প্রতিনিধি হয়ে দুবার ভারত ভ্রমণ করেছেনআনুকি ছিলেন ইউনেস্কোর ইড়ড়শ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ধহফ খরঃবধপুবিভাগের প্রধান

তখন দুপুর বেলাতাই তানজিমা শিনজী এবং আনুকি আমাকে বললেন, চলুন কাছেই একটি জাপানি রেস্তোরাঁয় গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আসিবললাম, দুপুরে আমি কিছু খাই নাআমার মেয়ে আমেরিকায় ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়েপ্রতি মাসে আমি যে মাইনে পাই, তার থেকে নিজের খরচের জন্য কিছু অর্থ রেখে বাকিটা সবটা মেয়ের পড়ার খরচের জন্য পাঠিয়ে দেইজাপানী রেস্তোরাঁয় খাবারের মূল্য অনেকসেটা পরিশোধ করার আমার সামর্থ্য নেইতবে কাল বা পরশু আপনারা যদি আমার হোটেলে আসেন এবং রুমের বারান্দায় এক্সটেনশন ক্যাবল নিয়ে সুপারকুকারে আমি যে বাঙালী খিচুড়ি রান্না করব সেটার স্বাদ গ্রহণ করতে রাজি থাকেন, তা হলে আমি আপনাদের সঙ্গে খেতে রাজি আছি

খিচুড়ির স্বাদ গ্রহণের আগে বাংলাদেশী চানাচুরের সঙ্গে হুইস্কি এবং ব্রান্ডি অবশ্যই থাকবেএ্যারোপ্লেনের প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের যে সৌজন্যমূলক পানীয় পরিবেশন করা হয়, তার অনেকটাই উদ্বৃত্ত থেকে যায়ওই উদ্বৃত্ত পানীয় থেকে দুই একটি বোতল হুইস্কি-ব্রান্ডি আমি নিয়ে আসিতানজিমা এবং আনুকির সঙ্গে দুপুরের ভোজনপর্ব হয়েছিল খুবই উপাদেয়

ওই দিনই সন্ধ্যার দিকে মিসাকো আনুকি আমার হোটেলে একাই এলেনবললেন তানজিমা একটা বিশেষ কাজে আটকে যাওয়ায় আসতে পারেননিবললাম, তানজিমা যে আসতে পারবেন না, সে কথা টেলিফোন করে তিনি আমাকে জানিয়েছেনবলেছেন, তার বাসায় শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশাই আসবেন

সুপারকুকারের মাধ্যমে আমার খিচুড়ি রান্না করা শেষ হয়েছিলআনুকি এবং আমি চানাচুরসহকারে হুইস্কি পান করছিলামরাত দশটায় আমরা খিচুড়ি খেলামআনুকি বললেন, এমন সুস্বাদু খাবার আমি খুব কমই খেয়েছিএই খিচুড়ি রান্না করার রেসিপি এবং রান্না করার কৌশল কিন্তু আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে

জাপানে যতদিন বিমানের ফ্লাইট চলেছে, ততদিন তানজিমা শিনজী, প্রফেসর আজুমা এবং মিসাকো আনুকির সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক বজায় ছিল

আমি যে আমার মেয়ের পড়ার খরচ চালানোর জন্য একবেলা উপবাস করি, রুমের ভেতরে রান্না করে খাইÑএই বিষয়টা নিয়ে তানজিমা শিনজী ঋধঃযব ধহফ উধঁমযঃবনাম দিয়ে একটি গল্প লিখেছেনবিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক যে আমার মেয়ে এবং আমাকে নিয়ে এ রকম একটি গল্প লিখবেন, এ কথা ভেবে আমি বিস্মিত হয়েছি

২০০১ বা ২০০২ সালে আমার এক বন্ধু জাপানে গিয়েছিলেন এবং প্রফেসর আজুমা এবং তানজিমা শিনজীর সঙ্গে দেখা করেছিলেনতানজিমা তাকে ওই গল্প লেখার কথা বলেছিলেনএ কথাও বলেছিলেন, ওই গল্পটা ইংরেজী ভাষায় অনূদিত হলে তা তিনি আমাকে পাঠাবেন

×