ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

জসীম উদ্দীনের লোকসঙ্গীত ও লোকসাহিত্য

প্রকাশিত: ০০:২৫, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১

জসীম উদ্দীনের লোকসঙ্গীত ও লোকসাহিত্য

কবি জসীম উদ্দীনের অনেক পল্লীগীতি অমর হয়ে গেছে। অনেক গান আমাদের মুখে মুখে। কিন্তু ‘গীতিকার জসীম উদ্দীন’ নিয়ে জানি না অনেকেই। এ বিষয়ে আর একজন প্রধান কবির কথা বলতে পারি। তিনি হচ্ছেন, কবি শামসুর রাহমান। এক শ’এর মতো গান লিখেছেন বলে ধারণা করা হয়। তাঁর বেশকিছু দারুণ জনপ্রিয় দেশের গান রয়েছে। ‘আজব দেশের ধন্য রাজা...’, ‘স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে...’, ‘আমি প্রতিদিন তোমাকেই দেখি...’, ‘এ দেশ আমার, ‘জননী আমাকে দিয়েছে অন্ন...’ ‘সুন্দরীতমা আমার...’ মতো গানগুলোর ‘গীতিকার শামসুর রাহমান’-কে আমরা অনেকেই জানি না। কবি জসীম উদ্দীনকে আমরা ‘পল্লীকবি’ বলেই জানি। আমরা ‘গীতিকার জসীম উদ্দীন’ হিসাবে কতজন জানি তাঁকে? বা বলা হয় ‘গীতিকার’ হিসেবে কবিকে নিয়ে আলোচনা হয় কতটুকু? এক্ষেত্রে বলতে পারি প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করছি আমরা। আমি গীতিকার ও লোকসাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে কবি জসীম উদ্দীনের অবদানের কথা নিয়েই লিখব আজ। পরবর্তীতে বিশদ লেখার ইচ্ছে আছে। তাঁর আরও কিছু অমূল্য সাহিত্যরচনা আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত, দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে লোকসাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে জসীম উদ্দীন কাজ করেন। তিনি পূর্ববঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহকও। তিনি ১০,০০০ এরও বেশি লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করেছেন, যার কিছু অংশ তার সঙ্গীত সংকলন ‘জারি গান’ এবং ‘মুর্শিদা গান’- এ স্থান পেয়েছে। অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গানের স্রষ্টা পল্লীবাংলার সুখ-দুঃখের কবি জসীম উদ্দীন। তিনি এমন কিছু বাংলা গান এখনও মনের অজান্তে গুনগুন করে ছেলে-বুড়ো-আমরা। লোকজ এবং মাটির গানগুলোকে তুলে দিয়েছেন শহুরে মানুষের মুখে মুখে। আমরা মনের অজান্তে কবি জসীম উদ্দীনের অনেক গান গেয়ে থাকি। তবে অনেকেই গীতিকারের নাম জানেন না। শিল্পী রথীন্দ্রনাথের কণ্ঠের অমর অনেক গানই শিল্পীর সুনাম বাড়িয়ে দিয়েছে। পল্লীগীতি, দেশেরগান বা ধর্মীয় অনুভূতির গানগুলো অনেক সুন্দর। যেমন বলা যেতে পারে- ‘আমার হাড় কালা করলাম রে/আমার দেহ কালার লাইগা রে/আরে আমার অন্তর কালা করলাম রে/দুরন্ত পরবাসে...’, ‘ছলছল কলকল নদী করে টলমল...’, ‘ও বাজান চল যাই চল মাঠে লাঙ্গল বাইতে...’ কিংবা ‘নিশিতে যাইও ফুল বনে গো ভোমরা, নিশিতে যাইও ফুল বনে..’। পর্দার আড়ালের গীতিকার পর্দার আড়ালেই থেকে গেছেন। কয়েকটি জনপ্রিয় অমর গানের কথা বলতেই পারি- (১) ‘প্রাণ সখিরে/ ঐ শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে।/ বংশী বাজায় কে রে সখী, বংশী বাজায় কে।/ আমার মাথার বেণী খুইলা দিমু/ তারে আনিয়া দে...’, (২) ‘ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না...’,(৩) ‘বৈদেশী কন্যা গো...’,(৪) ‘আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে অকূল দরিয়ায় বুঝি কূল নাইরে...’/ নদীর কূল নাই কিনার নাইরে...আমি কোন কূল হইতে কোন কূলে যাব...’, (৫) ‘কি বলিব সোনার চাঁদ...’, (৬) ‘আমায় এত রাতে কেন ডাক দিলি...’, (৭) ‘যোগী ভিক্ষা ধরো...’,(৮) ‘রসুল নামে...’,(৯) ‘ও সুজন বন্ধু রে...’,(১০) ‘পেটের জ্বালায় জইলা মইলা...’, (১১) ‘উজান গাঙ্গেরর নাইয়া...’, (১২) ‘আমার সোনার ময়না পাখি...’ , (১৩) ‘জল ভরিতে যায় গো কন্যা...’, (১৪) ‘নদীর কূল নাই কিনার নাই...’,(১৫) ‘তোরা কে কে যাবি লো জল আনতে...’, (১৬) ‘ছল ছল কল কল নদী করে টলমল...’,(১৭) ‘আমারন বন্ধু বিনোদিয়া রে প্রাণ বিনোদিয়া...’, (১৮) ‘নিশিথে যাইও ফুল বনে গো ভোমরা...’,(১৯) ‘উজান গাঙ্গের নাইয়া...’, (২০) ‘আমার সোনার ময়না পাখি/কোন দেশেতে গেলা উইড়া রে/দিয়া মোরে ফাঁকি রে/ আমার সোনার ময়না পাখি...’, (২১) ‘আমি বাইয়া যাইয়া কোন ঘাটে...’ ইত্যাদি গানের অংশ উল্লেখ করা যেতেই পারে। এ রকম অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা কিন্তু কবি জসীম উদ্দীন। আধুনিক গান, ইসলামী গান, পল্লীগীতি, জারি, সারি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান এবং উর্দুসহ অসংখ্য গান লিখে বাংলা গানের জগতকে করেছেন সমৃদ্ধ এবং উজ্জ্বল। ইসলামী কিংবা আধ্যাত্মিক গানেও জসীম উদ্দীন সমান দক্ষতায় মুন্সিয়ানার পরিচয় দেখিয়েছেন। ইসলামী কয়েকটি স্মরণীয় গান-‘খোদার ঘরে নালিশ করতে দিল না আমারে।পাপ পূণ্যের বিচার এখন মানুষে করে।...’,/ ‘রসুল নামে...’/ ‘যোগী ভিক্ষা ধরো..’/ ‘কি বলিব সোনার চাঁদ.../ আগে জানিনারে দয়াল তোর পিরিতে’... মতো জনপ্রিয় অনেক গান উপহার দিয়েছেন কবি। বিখ্যাত লোকসঙ্গীতের গায়ক আব্বাসউদ্দীন, তার সহযোগিতায় কিছু বিশেষত ভাটিয়ালি ধারার অবিস্মরণীয় লোকগীতি নির্মাণ করেছেন। জসীম উদ্দীন রেডিওর জন্যও আধুনিক গান লিখেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন তিনি বহু দেশাত্মাবোধক গান লিখেন। ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবি জসীম উদ্দীনকে সম্মান সূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। এছাড়া ১৯৭৬ সালে একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৭৮(মরণোত্তর)। লোকজীবনের রূপায়ণ ও লোকদর্শনের প্রকাশ জসীম উদ্দীনের গানের প্রধান উপজীব্য। গীতিকবিতা উপাদান, চিত্রময়তা বা বৈশিষ্ট্যে সেসবের চেয়ে কোনভাবে পিছিয়ে- এ কথা বলার ন্যূনতম অবকাশ নেই। লালনকে আর লালনের দর্শনকে অনুভব করেছেন আত্মার গভীর থেকে। এ কারণেই তার গানে লালনের পরোক্ষ প্রভাব লক্ষণীয়। এমনকি জসীম উদ্দীনের স্মৃতিকথায় ব্যক্তি লালনকেও গুরুত্ব পেতে দেখা যায়। শুধু লোকসাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয়, কবি জসীম উদ্দীনের সকল লেখা সমসাময়িক ও প্রাণবন্ত। তিনি দেশের মানুষের কথা, তাদের জীবনযাপনের কথা,সংস্কৃতি ও প্রকৃতি নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। গান ও কবিতায় তুলে এনেছেন লোকজ উপাদানের প্রাচুর্যে। কবি জসীম উদ্দীন পালাগান, গাজীর গান, লোকগীতি বা জারি-সারির আসরে যোগ দিতেন; এবং তা উপভোগ করতেন। আবার নিজের বাড়িতেও লোকসাহিত্যের বা উল্লেখিত গানের আসর বসাতেন। লোকসঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন তিনি। তাঁর এ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে আমন্ত্রিতও হতেন। এসব ক্ষেত্রে আলোচক হিসাবেও উপস্থিত থাকতেন। কবি জসীম উদ্দীনকে লোকসঙ্গীতের প্রবাদপুরুষও বলা যায়।
×