
বরেণ্য কথাসাহিত্যিক ও প্রথিতযশা সাংবাদিক রাহাত খান ১৯৪০ সালের ১৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার পূর্ব জাওয়ার গ্রামের খান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াকালীন তাঁর প্রথম গল্পটি লিখেছিলেন। তিনি আনন্দ মোহন কলেজ থেকে অর্থনীতি ও দর্শনে ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারী কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেন।
১৯৬৯ সালে তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ইত্তেফাক ছাড়ার পর ২০১৩ সালের জুলাই মাসে তাঁর সম্পাদনায় দৈনিক বর্তমান প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে তিনি আড়াই বছরের জন্য বাসসের বোর্ড চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন। সবশেষে তিনি প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
রাহাত খান ছোটগল্প ও উপন্যাসÑউভয় শাখায়ই অবদান রেখেছেন। ১৯৭২ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অনিশ্চিত লোকালয়’ প্রকাশিত হয়। পরের বছর তাঁর ছোটগল্পের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি ‘ছায়া দম্পতি’, ‘শহর’, ‘অমল ধবল চাকরি’, ‘হে শূন্যতা’, ‘হে অনন্তের পাখি’, ‘মধ্যমাঠের খেলোয়াড়’সহ বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন। গোয়েন্দা সিরিজ মাসুদ রানার রাহাত খান চরিত্রটি তাঁর অনুসরণেই তৈরি করা হয়।
রাহাত খানে জীবনাবসানের পর অনুজ কথাসাহিত্যিকদের কলমে উঠে এসেছে তাঁর বিশিষ্ট জীবন। রাহাত খানকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কবি তুষার দাশ লিখেছেন, ‘ভালোমন্দের টাকা’ আর ‘ঈমান আলীর মৃত্যু’ এবং পরে ‘হে অনন্তের পাখি’Ñরাহাত খানের এই লেখাগুলো তাঁকে অনেকদিন মনে রাখার মতো লেখা বলে তাঁর মুগ্ধ পাঠক আর ঋদ্ধ সাহিত্য আলোচকরা মনে করে থাকেন। আধুনিক নাগরিক জীবনের এক অন্যতম রূপকারও তিনি ছিলেন, এমন কথাও আমরা অনেকের মুখে শুনেছি। ওই জায়গাটায় বড় একটি পাথর স্থানচ্যুত হয়ে বিরাট এক শূন্যতা ত্রিশাল হয়েছেÑএ বিষয়ে হয়ত তেমন একটা দ্বিমত করার মতো লোক খুবই কম পাওয়া যাবে।’ (কথাশিল্পী রাহাত খানের পাখি হয়ে যাওয়া)
কবি ও কথাশিল্পী ফরিদ কবির বলেছেন, ‘রাহাত খান আমাদের যৌবনে ছিলেন যৌবনেরই প্রতীক। বাংলাদেশের নগরজীবনের মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন তাঁর রচনার অনেকটা জুড়েই ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর গদ্যভঙ্গি ও সংলাপ ছিল আমাদের এ অঞ্চলের নাগরিক মধ্যবিত্ত জনমানুষের মুখের ভাষার সবচেয়ে কাছাকাছি। বাংলাদেশে এখনও শিক্ষিত নগরবাসীর এই অংশ আর কারোর সাহিত্যেই ততটা বিশিষ্ট হয়ে উঠতে পারেনি।’ (রাহাত খান আমাদের যৌবনে ছিলেন যৌবনেরই প্রতীক)
কবি ও প্রাবন্ধিক ওবায়েদ আকাশ বলেছেন, ‘প্রচলিত আছে যে, রাহাত খান একজন ব্যতিক্রমী কথাসাহিত্যিক। সে বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত না হলেও, তাঁর অনেকখানি স্বকীয়তা অবশ্যস্বীকার্য। যেমন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর লেখালেখিতে নতুনত্ব বিশেষভাবে শনাক্তযোগ্য মনে না হলেও বিশিষ্টতা লক্ষণীয়। তাছাড়া একই ঘটনা নিয়ে ভিন্ন কিছু উপস্থাপন খুব বিরল ব্যাপার। প্রতিটি মুক্তিযুদ্ধেই বড় ঘটনা হলো প্রতিপক্ষের নির্যাতন এবং সেই নির্যাতনের বিভিন্ন প্রকার বা ধরন। আর একটি বড় বিষয় হলো, সেই যুদ্ধকে ঘিরে বিশ্বব্যাপী স্নায়ুযুদ্ধ। স্নায়ুযুদ্ধের দিকটি খতিয়ে দেখলেই আসল কারণ বেরিয়ে আসে এবং যুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলী চাক্ষুষ হয়। যেমন আমরা যদি সাম্প্রতিক আমাদের দেশের একটি ইস্যুতে স্নায়ুযুদ্ধের কথা বলি, সেটা হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু। এর পেছনে বিশ্বের বড় কোন কোন দেশের রাজনীতি কাজ না করলে রোহিঙ্গারা এভাবে এদেশে ঢুকতে পারে না কিংবা এতদিন স্থায়ী হতে পারে না। এই রোহিঙ্গারা কোনদিন এদেশ থেকে ফিরবে বলেও মনে হয় না।’ (স্বনির্মিত রাহাত খান এবং ভাবনার বিশিষ্টতা)
কবি ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক বলেছেন, ‘রাহাত খানের গল্প মানুষের যাপিত জীবনের দিনপঞ্জি নয়, বিশেষ মুহূর্তের ঘাত-প্রতিঘাতের প্রতিচ্ছবি। ব্যক্তিগত রুচিবোধ গল্পের ভেতর চারিয়ে দিয়ে লেখকও খানিকটা স্বস্তিবোধ করেন। তাঁর গল্পে মানবজীবনের জটিল ঘূর্ণাবর্তের যেমন বর্ণনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়েরও বিবরণ। অনেক সময় তাকে শ্রেণি সংগ্রামের শিল্পী বলেও মনে হয়। খুব সাধারণভাবে গল্প বলতে বলতে পাঠককে নিয়ে যেতে পারেন গভীরতর কোন চিন্তার জগতে। যেখানে মানুষ নিজের সত্তার অস্তিত্ব টের পায়। নিজেকেই নিজের অস্তিত্বের বিষয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত করে।’ (রাহাত খানের গল্পে জীবনজিজ্ঞাসা)
কথাশিল্পী ম্যারিনা নাসরীন বলেন, ‘রাহাত খানের রচনায় আমরা দেখতে পাই তিনি অসংখ্য চিত্রের মাধ্যমে সমকালকে নিখুঁতভাবে এঁকে গিয়েছেন। তাঁর গল্প মানে সময়ের চলচ্চিত্র। এতে করে বোঝা যায় তিনি তাঁর চারপাশে ঘূর্ণায়মান প্রতিটি চরিত্র,সমাজ, রাষ্ট্রকে তীব্র আকাক্সক্ষার সঙ্গে পাঠ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কথায় বললে, ‘সমস্ত চৈতন্য দিয়ে দেখতে।’ তিনি তাঁর সময়কে সমস্ত চৈতন্য দিয়ে দেখেছেন এবং অত্যন্ত মেধার সঙ্গে তাঁর নির্মাণ করেছেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘রাহাত খানের গল্পের প্রতিটি চরিত্র এতটাই জীবন্ত যে, পাঠক তাঁর সঙ্গে যাত্রা শুরু করে শেষ পর্যন্ত নিমগ্ন হয়ে তাঁর সঙ্গেই অবস্থান করতে বাধ্য হন। গল্পের শেষেও পাঠক চরিত্র থেকে সহসা বেরুতে পারেন না। তাঁর মনে নতুন নতুন অনেক গল্পের জন্ম হয়। অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন তিনি। (রাহাত খানের গল্প : আত্মজিজ্ঞাসা এবং সমকালের এক অসাধারণ চিত্রশালা)
বাংলা সাহিত্যের অনন্তের পাখি রাহাত খান গত ২৮ আগস্ট ৮০ বছরের বর্ণাঢ্য আখ্যান শেষে পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যান। অনন্তের পাখি অনন্তের পথে পাড়ি জমান। তবুও তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে, টিকে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মাঝে। বরেণ্য এ জীবনশিল্পীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।