কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ক্রমবিবর্তিত চেতনার কবি। বাংলা কবিতায় তাঁর আবির্ভাব এমন সময়ে যখন ‘রোমান্টিকতা’ ও ‘আধুনিকতা’র মিছে দ্বন্দ্ব শুরু হচ্ছিল। নজরুল দুই দিকের কোনটাতেই যাননি, কিংবা দুই তত্ত্বের চাপে পিষ্টও হননি। কারণ তাঁর মনোযোগ ছিল অন্যত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। তার দগদগে ঘা তখনও শুকোয়নি। এই বৈশ্বিক পরিস্থিতির অভিঘাত ভারতবর্ষেও বর্তমান ছিল। তাঁর ওপর ভারত ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর্যুদস্ত। পর্যুদস্ত ছিল এদেশের মানুষ। কবি নজরুলের দৃষ্টি সেইদিকে। তত্ত্বাশ্রিত না হয়েও নজরুলের কবিচেতনার উন্মেষ রোমান্টিক অনুভবের মধ্য দিয়েই। আর এই রোমান্টিক চেতনার স্ফুরণ ঘটেছে উপনিবেশ-শৃঙ্খলিত শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তি-আকাক্সক্ষায়, অর্থাৎ বিদ্রোহী-ভূমিকায়। এই রোমান্টিক অনুভবে তিনি প্রত্যাশা করেছেন সুষম-সুন্দর-কল্যাণময় সমাজ। নজরুলের এই প্রত্যাশা প্রথমত ‘ব্যক্তি-আমি’র উচ্চারণ দিয়ে উদ্বোধিত হলেও এর উদ্দীপন-উদ্দীষ্ট হচ্ছে গণমানুষ, যারা যুগ যুগ ধরে, শতাব্দাধিক কাল ধরে উৎপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত হয়ে আসছে। অর্থাৎ নজরুল ক্রমেই পৌঁছে গেছেন নিম্নবর্গের সমান্তরালে।
অগ্নিবীণা (১৯২২) কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কবিতাগ্রন্থ। বলা যায়, এটিই তাঁর কাব্যযাত্রার সূচনামুখ এবং শৃঙ্খল-মুক্তির কাব্যরূপ। কাব্যযাত্রার প্রারম্ভেই দেখা যায় এক ‘আমি’র দোর্দ- প্রতাপ, স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ। এই ‘আমি’ কে? শিল্প ও সাহিত্যে ‘আমি’র প্রকাশ মূলত আত্মগৌরব অর্থাৎ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের সূত্র ধরে। আঠারো শতকের শেষে পশ্চিম ইয়োরোপে জাগরণ ঘটে আমিত্বের, যা জন্ম দেয় রোমান্টিকতার। আবিষ্কৃত হতে থাকে শিল্পীর আত্মসন্ধান, আত্মপ্রকাশ ও আত্মউন্মীলনের নতুন নতুন ধারা ও পথ। সেই সূত্রে বলা যায়, অগ্নিবীণায় যে আমিত্বের সরব প্রকাশ ঘটেছে, তার অন্তর্দেশে আছে রোমান্টিক চেতনা; এবং তা আরোপিত নয়, বরং সময়ের সাবলীল সৃষ্টি। নজরুলের ‘আমি’ সত্তা প্রোথিত হয়ে আছে তাঁর স্বসমাজ, সমকাল, স্বজাতি ও রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তিভূমিতে। নজরুলের ‘আমি’ জনবিচ্ছিন্ন ‘আমি’ নয়, জনসাপেক্ষ ও জনঘনিষ্ঠ।
কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমত ও প্রধানত জনমানুষের কবি। কবিজীবনের প্রতিক্ষণ প্রবলভাবে জাগরুক রাখতে চেয়েছেন তাঁর সংঘসত্তাকে। এই সংঘচেতনা ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে, এই বিদ্রোহ সকল প্রকার শোষণের বিরুদ্ধে। নজরুল কেবল শোষিত নিম্ন বর্গের শোষণমুক্তি আর অধিকার প্রতিষ্ঠাই চাননি, চেয়েছেন নিম্ন বর্গের উত্থান। অগ্নিবীণার ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়ে নজরুল তাঁর আমিত্বের জানান দিলেন। বাংলা কবিতার জগতে এ এক নতুন নিনাদ : ‘বল বীর - / আমি চির-উন্নত শির! / আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্ব্বিনীত, নৃশংস, / মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস / আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বির, / আমি দুর্বার, / আমি ভেঙে করি সব চুরমার!’ (‘বিদ্রোহী’) এই স্বর বাংলা সাহিত্যে অভূতপূর্ব। পুরো কবিতা জুড়ে রয়েছে আমিত্বের দুর্নিবার রণহুঙ্কার। শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে সদাজাগ্রত ‘আমি’ পুরাতনকে ভেঙে এক নতুনকে গড়ার আহ্বান জানায়। নজরুল কেবল নতুন সমাজই চাইছেন না, তিনি সুষম বণ্টন-ব্যবস্থার সমাজ প্রত্যাশা করছেন, যেখানে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল থাকবে না, পরাধীনতা থাকবে না, মানবেতর জীবনের অবসান ঘটবে। অগ্নিবীণার অন্যান্য কবিতায়ও (‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’, ‘কামালপাশা’, ‘আনোয়ার’ প্রভৃতি) একক ব্যক্তির উদ্বোধন লক্ষণীয়। পৌরাণিক চরিত্র-নির্বাচনেও তিনি এ পর্যায়ে বেছে নিয়েছেন মহাশক্তিধর শিবকে। গেয়েছেন তার জয়গান।
নজরুলের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ বিষের বাঁশী (১৯২৪), যাকে কবি অগ্নিবীণার দ্বিতীয় খ- রূপে প্রকাশ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। আদতে বিষের বাঁশীতে দেখা যায় অগ্নিবীণারই অনুরণন। এতেও রয়েছে বিদ্রোহ-বিপ্লব ও মুক্তির বাণী। কিন্তু বিষের বাঁশীর বিদ্রোহচেতনায় যোগ হয় নতুন মাত্রা। এ পর্যায়ে কবি অবতীর্ণ হন বিদ্রোহচেতনার পরিণত ও সংহত স্তরে। অগ্নিবীণাতে যে ব্যক্তি-বিদ্রোহ দিয়ে নজরুল তাঁর যাত্রা শুরু করেছিলেন, বিষের বাঁশীতে রূপান্তরিত হয়েছে সামষ্টিক-বিদ্রোহে। কবি হয়েছেন দর্শন-পরিশ্রুত। তিনি অনুভব করতে পারছিলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযাত্রায় সংঘশক্তির উদ্বোধন ছাড়া সফলকাম হওয়া অসম্ভব। তাই বিষের বাঁশীর কবিতাগুলোর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় অভিজ্ঞতা ও আবেগের ঐক্য। এক্ষেত্রে কবির ব্যক্তিগত জীবনের কারাভোগ ও নিপীড়িত হওয়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অগ্নিবীণা প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই নজরুল ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লেখার অভিযোগে গ্রেফতার-বরণ করেন। সেটা ১৯২২ সালের ২৩ নবেম্বর। ১৯২৩ সালের ১৪ এপ্রিল তাঁকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে হুগলি কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। হুগলি জেলে বসে তিনি লেখেন ‘সেবক’ কবিতা। জেলখানায় বন্দী কবি তৎকালীন অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমিতে এবং পরাধীন দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে, অন্ধকারে আলোর মন্ত্র দেয়ার জন্য, মুক্তির পথনির্দেশের জন্য আহ্বান করেছেন তরুণ ‘মুক্তি-সেবক’কে। লিখছেন : ‘হঠাৎ দেখি আসছে বিশাল মশাল হাতে ও কে? / ‘জয় সত্যম্ মন্ত্র-শিখা জ্বলছে উজল চোখে। / রাত্রি-শেষে এমন বেশে কে তুমি ভাই এলে? - / ‘সেবক তোদের, ভাইরা আমার! - জয় হোক মা’র।’ / হাঁকলো তরুণ কারার দুয়ার ঠেলে!’ (‘সেবক’) এই মশাল হাতে তরুণ সেবক বৃহত্তর জনসমষ্টির জন্য, ‘ভাইদের জন্য’ জন্য কাজ করার ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসছে। নজরুল ধর্মীয় কুসংস্কার ও রাজনৈতিক ভ-ামির বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার। আর ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে পরাধীন স্বদেশের আংশিক নয়, চান পূর্ণ স্বাধীনতা। এখানেই অপরাপর ভারতীয় রাজনীতিকের সঙ্গে তাঁর পৃথকতা। স্বাধীনতা বিষয়ে তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট : ‘আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ! / এই দুলালুম বিজয়-নিশান, মরতে আছি- র্মব শেষ।’ (‘বিদ্রোহী বাণী’) এই উচ্চারণ আর একক ‘আমি’তে সীমায়িত থাকছে না, ‘আমরা’র সংঘশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। উপনিবেশের মধ্যে অবস্থান করেও উপনিবেশের বিরুদ্ধে সরব হতে নজরুলের চেয়ে বেশি আর কোন কবিকে দেখা যায় না। নজরুল আবেগের বশবর্তী হয়ে উপনিবেশ-বিরোধিতা করেননি, তিনি উপনিবেশের ফাঁদগুলোকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এবং অকপটে প্রকাশ করেছেন। ঔপনিবেশিক জুলুমের বিরুদ্ধে তাঁর উচ্চারণও এখানে সামষ্টিক উচ্চারণ : ‘অত্যাচারে আর উৎপীড়নে সে আজিকে আমরা পর্যুদস্ত, / ভয় নাই ভাই! ঔ যে খোদার মঙ্গলময় বিপুল হস্ত!’ (‘বোধন’) নজরুলের ধর্ম একটি, তা হচ্ছে সদর্থক শক্তি; এ ছাড়া তাঁর অন্য কোন ধর্ম নেই। যে নজরুল একসময় শিবকে শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, সেই শিবকেই দেখেছেন ভারতবর্ষের প্রতিটি তরুণের মধ্যে। শিবও পরিণত হয়েছে বহুবাচকে। বিষের বাঁশীর কবিতাগুলো অধিকাংশই গান হিসেবে রচিত। এই গানগুলো আবার কোরাসধর্মী (সমবেত সঙ্গীত)। অর্থাৎ কবির উচ্চারণেও ঘটেছে সমবেত কণ্ঠের প্রকাশ।
নজরুলের আরেক কবিতাগ্রন্থ সর্বহারা (১৯২৬)। নামকরণ থেকেই এর চারিত্র্য-লক্ষণ বুঝে নেয়া যায়। তলের তল অর্থাৎ নি¤œবর্গের মানুষের উত্থানের কাব্য সর্বহারা। বিষের বাঁশীর অঙ্গীকার সর্বহারায় পরিণত ও বাস্তব রূপ লাভ করেছে। নজরুলকে সুনির্দিষ্টভাবে মার্কসিস্ট বা বামপন্থী বলা যাবে না। কারণ শুরুতেই বলা হয়েছে, নজরুলকে কোন তত্ত্ব দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। তবে এই রাজনীতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা মুজাফ্ফর আহমদের সাহচর্য পেয়েছিলেন। তবুও বলতেই হবে, সর্বহারা মার্কসীয় সর্বহারা নয়; এই সর্বহারা দেশীয় সর্বহারা, উপনিবেশের শোষণে পিষ্ট সর্বহারা; সংখ্যায় তারা অগণিত, অজ¯্র। এই কাব্যে নিম্নবর্গ কেবল উপলক্ষ হিসেবে আসেনি, এসেছে লক্ষ্য হিসেবে। ‘কৃষকের গান’, ‘শ্রমিকের গান’, ‘ধীবরদের গান’, ‘ছাত্রদলের গান’ কবিতাগুলোর নাম থেকেই সংঘচেতনা ও মানবতাবাদের সূত্র-সন্ধান পাওয়া যায়। সর্বহারায় নজরুল রোমান্টিকতা থেকে মানুষের দৈনন্দিনতায় এসে পৌঁছেছেন। এবার তিনি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতবাসীকে নিয়ে দাঁড়িয়েছেন: ‘প্রার্থনা করো - যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, / যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখার তাদের সর্বনাশ!’ (‘আমার কৈফিয়ত’) তিনি শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র সমগ্র জনতার উত্থান কামনা করেছেন।
অভিজ্ঞতা ও শিল্পকুশলতায় ঋদ্ধ হয়ে নজরুল ‘একক আমি’-র বন্ধন ছিঁড়ে পৌঁছে গেছেন ‘বহু আমি’-র বিশালতায়। ব্যক্তি কবি সমর্পিত হয়েছেন ব্যক্তি-সমষ্টিতে। ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল-মোচন, নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ও দেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ছিল নজরুলে কবিমানসের মৌল অন্বিষ্ট। এর জন্য কখনো তিনি বিদ্রোহী হয়েছেন একক সত্তায়, আবার সময়ের পরিক্রমায় তিনি গণমানুষের ‘বহু আমি’-র প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এখানেই নজরুলের কাব্য-অভিযাত্রার স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা।