ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

দুইদিনেও স্বাভাবিক হয়নি ট্রেনের সময়সূচি

সিগন্যাল ত্রুটির কারণে একের পর এক দুর্ঘটনা

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

প্রকাশিত: ২৩:৪৩, ৫ মে ২০২৪

সিগন্যাল ত্রুটির কারণে একের  পর এক দুর্ঘটনা

.

রেলপথে সিগন্যাল (সংকেত) ত্রুটির কারণে একের পর দুর্ঘটনা ঘটছে। গত শুক্রবার গাজীপুরে একই লাইনে আসা দুই ট্রেনের সংঘর্ষের একদিন পর গত শনিবার সিরাজগঞ্জেও দুই ট্রেনের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা ঘটে। ভুল সিগন্যাল দেওয়ার কারণে একই লাইনে দুই ট্রেন চলে আসায় এই ঘটনা ঘটে বলে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান।

এদিকে রেলওয়ের পূর্ব পশ্চিমাঞ্চলে এখনোম্যানুয়ালসিগন্যাল ব্যবস্থায় চলছে ট্রেন। তাই বিভিন্ন সময় স্টেশন মাস্টার পয়েন্টসম্যানদের ভুল সিগন্যালের কারণে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এজন্য পুরো রেলপথের সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়নের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, বর্তমানে সারাদেশে ৩৫৫৩ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে রয়েছে ১৭৪২ দশমিক ১৯ কিলোমিটার। পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে ১৮১১ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার। সারাদেশে ডুয়েল গেজ রেলপথ রয়েছে মাত্র ৮৪২ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার। মিটার গেজ রেলপথ রয়েছে ১৭০২ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। পুরো রেলপথের অনেক স্টেশনে এখনো

ম্যানুয়ালসিগন্যাল ব্যবস্থায় চলছে ট্রেন। তবে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পসহ নতুন যেসব রেলপথ নির্মাণ হয়েছে সেগুলোর সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা হয়েছে। 

রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান, রেলপথের বিভিন্ন স্টেশনে দুই ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু আছে। এর মধ্যে আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা হলো, কম্পিউটার বেজড ইন্টারলকিং সিস্টেম (সিবিআইএস) অন্যটি হলো, নন-ইন্টারলকিং বা ম্যানুয়াল পদ্ধতি সেটি হলোপেপার লাইন ক্লিয়ার (পিএলসি)পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় যেসব স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে সেসব স্টেশনে কম্পিউটার বেজড ইন্টারলকিং সিস্টেম (সিবিআইএস) চালু করা হয়েছে। তবে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে এখনো সিবিআইএস চালু হয়নি। রেলপথ নির্মাণ কাজ পুরোপুরি শেষ হলে সিগন্যাল নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। সে হিসাবে নতুন রেলপথে এখনো সিবিআইএস পুরোপুরি চালু হয়নি।

পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে রেলপথের নির্মাণ কাজ চলমান থাকায় সেসব স্টেশনে নন-ইন্টারলকিং বা ম্যানুয়াল পদ্ধতি পেপার লাইন ক্লিয়ার (পিএলসি) মাধ্যমে ট্রেন চালানো হচ্ছে। একটি চলন্ত ট্রেন সামনের স্টেশন অতিক্রম করবে কি না অথবা ট্রেনটিকে ক্রসিংয়ের জন্য কোথায় থামতে হবে অথবা ট্রেনটির অনির্ধারিত স্টপেজ কোন স্টেশনে দেওয়া হয়েছে, এসব বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা একটি কাগজে লেখেন স্টেশন মাস্টার। কাগজটি নিয়ে লাইনের পাশে উঁচু করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। চলন্ত ট্রেনটি স্টেশন অতিক্রম করার সময় ইঞ্জিনে থাকা লোকোমাস্টার নেন সেটি। সেখান থেকে সামনের স্টেশন সম্পর্কে ধারণা মেলে। আর পয়েন্ট তৈরির কাজটি করেন পয়েন্টসম্যান। তাদের ভুলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

তাই একজন পয়েন্টসম্যানের কাজ হলো চারটি। এগুলো হলো- . কাজ শুরু করার আগে রেলপথের পয়েন্টসমূহ এবং সিগন্যালের বাতি ভালোভাবে তদারক করে নেওয়া। . নন-ইন্টারলকড্ পয়েন্টে অবশ্যই হাজির থাকা এবং প্রয়োজনীয় ক্ল্যাম্প এবং প্যাডলক লাগিয়ে স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে সংকেত বিনিময় করা এবং যতক্ষণ ট্রেন পয়েন্ট পার হয়ে না যায় ততক্ষণ পর্যন্ত পয়েন্টে হাজির থাকা। . ক্রসিংয়ের সময় পয়েন্টস সেটিংয়ের পূর্বে স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে লাইন লেবেল অবশ্যই বিনিময় করা। . ট্রেন স্টেশনে আসলে টেইলবোর্ড বা টেইলল্যাম্প আছে কি না তা অবশ্যই স্টেশন মাস্টারকে জানানো। বিশেষ করে পণ্যবাহী ট্রেনের ব্রেক ভ্যান আছে কি না তা নিশ্চিত করা। এক কথায় গাড়ি সম্পূর্ণ এসেছে কি নাÑ তা স্টেশন মাস্টারকে অবশ্যই অবহিত করতে হবে।

তবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির সিবিআইএস লাইন পরিবর্তনের সময়, পয়েন্ট ঠিক না হওয়া পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের অনুমতি দেয় না। পুরনো পদ্ধতিতে পয়েন্টসম্যানরা, ট্রেনকে এক লাইন থেকে অন্য লাইনে নিতে পয়েন্ট তৈরি করেন। এতে ভুল হলে এবং স্টেশন মাস্টাররা সঠিক সংকেত দিতে না পারলে, দুই ট্রেন একই লাইনে চলে আসে। আবার পয়েন্ট ঠিকভাবে তৈরি না হওয়ায় ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে। বর্তমানে রেলওয়ের বড় সমস্যা জনবলের অভাব। ২০২২ সালের আগ পর্যন্ত দীর্ঘদিন জনবল নিয়োগ বন্ধ ছিল। সহকারী স্টেশন মাস্টার পয়েন্টসম্যানসহ অপারেশনাল কাজে নিয়োজিতরা প্রশিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেননি। তাই বিভিন্ন সময় দক্ষতার অভাবে সিগন্যাল ভুল করার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

নির্মাণ কাজ চলায়ম্যানুয়ালসিগন্যালে চলছে ট্রেন যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু রেল সেতুর নির্মাণ চলছে। ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত তৃতীয় চতুর্থ রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছে। তাই ঢাকা থেকে বিভিন্ন লাইনে অনেক স্টেশনে কম্পিউটার বেজড ইন্টারলকিং সিস্টেম (সিবিআইএস) নেই। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু রেল সেতুর নির্মাণ চলছে। এখানে নির্মাণকাজের কারণে ট্রেন চলাচলে মাত্র দুটি লাইন সচল রয়েছে। তাই এই রুটেম্যানুয়ালসিগন্যাল ব্যবস্থায় ট্রেন চলাচল করছে বলে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান।

রেলের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘যমুনায় বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। এজন্য ট্রেন চলাচলে মাত্র দুটি লাইন সচল রয়েছে। সেখানে সিবিআইএস নেই। থাকলে দুই ট্রেন এক লাইনে আসতে পারত না। একই অবস্থা গাজীপুরে জয়দেবপুরেও। এখানে নতুন রেললাইন নির্মাণ চলছে, নেই সিবিআইএস।ম্যানুয়ালসিগন্যাল ব্যবস্থায় ট্রেন চলাচল করছে। নির্মাণ কাজ শেষ হলে পুরো রেলপথে সিবিআইএস কার্যকর হবে বলে জানান তিনি।

স্থানীয় সূত্র জানায়, গত শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম স্টেশনের নম্বর লাইন ধরে সেতুর দিকে আসছিল কলকাতা থেকে ঢাকাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস। তখন একই লাইন ধরে যাচ্ছিল ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস। অবস্থায় দুটি ট্রেনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে ৭৬৯ নম্বর ধূমকেতু এক্সপ্রেসের লোকোমাস্টার মহিদুল ইসলাম সহকারী লোকোমাস্টার হেদায়েতুল্লাহ আলামিন ট্রেন থামিয়ে দেন। এরপর মৈত্রী এক্সপ্রেসও থামে, তাতে রক্ষা পায় দুই ট্রেন। ভুল সিগন্যাল দেওয়ার কারণে একই লাইনে দুই ট্রেন চলে এসেছিল। বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকায় ট্রেনের গতি কম থাকায় ভুল সিগন্যালের বিষয়টি চালকদের পক্ষে ধরা সম্ভব হয়েছে বলে জানান রেল কর্মকর্তারা।

এর আগে গত শুক্রবারও গাজীপুরের জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশন এলাকায় মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে টাঙ্গাইল কমিউটারের পাঁচটি বগি দুমড়েমুচড়ে যায়, দুটি ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ১০টি বগি লাইনচ্যুত হয়। আহত হয় যাত্রীবাহী ট্রেনের চালকসহ অন্তত চারজন। এটাও ভুল সিগন্যালের কারণে হয়েছে বলে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান।

তাই বিভিন্ন সময় স্টেশন মাস্টার পয়েন্টসম্যানদের ভুল সিগন্যালের কারণে দুই ট্রেন মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এজন্য পুরো রেলপথের সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়নের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, রেলওয়েতে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হয় না। দুর্নীতির কারণে রেলওয়ের আজ এই অবস্থা। রেলপথে যত দুর্ঘটনা ঘটে সব সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটি রেলক্রসিংয়ের কারণে ঘটে। রেল দুর্ঘটনা ভারতেও হয়। তবে ভারতে রেলপথের অবকাঠামো অনেক ভালো, নিয়ম মেনে চলে। তাই সে দেশে রেল দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা হয়। কিন্তু আমাদের রেললাইনের অবকাঠামো ঠিক নেই, লাইনে পাথর থাকে না, ক্রসিংগুলো অরক্ষিত, সিগন্যাল ত্রুটিপূর্ণ, সিগন্যাল অমান্য করা হয় এবং রেলকর্মীদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে দুর্ঘটনা হয়। তাই বাংলাদেশের রেল দুর্ঘটনাটা মূলত কাঠামোগত হত্যাকা- কারণ সব অবকাঠামো ঠিক থাকলে, চালকের দক্ষতা রেললাইন ঠিক থাকাসহ সব নিয়ম-কানুন মেনে চলার পর যদি দুর্ঘটনা হয় তাকে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা বলা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে কোনোকিছু ঠিক নেই-তাই একে কাঠামোগত হত্যাকা- বলা যেতে পারে।

দুই দিনেও ঠিক হয়নি শিডিউল গাজীপুরের জয়দেবপুরে তেলবাহী ওয়াগন যাত্রীবাহী কমিউটার ট্রেনের সংঘর্ষের পর শিডিউল বিপর্যয়ে পড়ে রেলওয়ে। এরই মধ্যে ট্রেন দুটির লাইনচ্যুত বগির উদ্ধারকাজ শেষ হলেও এখনো স্বাভাবিক হয়নি রেল চলাচল। রবিবারও রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সব ট্রেন ছেড়ে গেছে বিলম্বে। এটা ঠিক হতে আরও একদিন সময় লাগবে বলে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান।

সরেজমিনে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ঘুরে দেখা গেছে, রবিবার ধূমকেতু এক্সপ্রেস সকাল ৬টায় ছাড়ার কথা থাকলেও ট্রেনটি দুপুর ১টার সময়ও স্টেশনে এসে পৌঁছায়নি। বুড়িমারী এক্সপ্রেস সকাল সাড়ে ৮টায় স্টেশন ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি দুপুর ১টার পরে ছেড়ে গেছে। রংপুর এক্সপ্রেস ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল সকাল ৯টা ১০ মিনিটে। ট্রেনটি সন্ধ্যা ৭টা মিনিটে স্টেশন ছেড়ে যায়। রাজশাহী কমিউটার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটি দুপুর ১টার পরও ছেড়ে যায়নি। শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে বেশকিছু ট্রেন বিলম্বে ছাড়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে যাত্রীদের। অনেকে দীর্ঘ সময় স্টেশনে অপেক্ষা করে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

কামাল নামের এক যাত্রী বলেন, সকাল থেকে স্টেশনে বসে আছি, এখনো ট্রেন ছাড়েনি। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি। ট্রেন কখন ছাড়বে তারও কোনো ঠিক নেই। এমন ভোগান্তিতে আগে কখনো পড়িনি।

বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার জানান, দুর্ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত। গাজীপুরের দুর্ঘটনার কারণে উত্তরাঞ্চলের কিছু ট্রেন বিলম্বে ছাড়ছে। তবে শুধু রংপুর এক্সপ্রেসের শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। আশা করছি সোমবার থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে।

×