
ছবিঃ সংগৃহীত
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখন আর কল্পবিজ্ঞান নয়—এটি ইতিমধ্যেই মানুষের শেখা, কাজ করা, যোগাযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতিকে বদলে দিয়েছে।
ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন, পরীক্ষার মূল্যায়ন কিংবা রোগ নির্ণয় পর্যন্ত—প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে এআই। প্রযুক্তির প্রতিটি অগ্রগতি কর্মক্ষেত্রের ভবিষ্যতকে এমনভাবে পরিবর্তন করছে যা আগে কল্পনাও করা হয়নি।
এআই যখন আরও জটিল কাজের দায়িত্ব নিচ্ছে, তখন অনেক প্রচলিত চাকরি হুমকির মুখে। এটি যেমন এক ধরনের চ্যালেঞ্জ, তেমনি নতুন সম্ভাবনাও। এখন বড় প্রশ্ন হলো—এই পরিবর্তনের জন্য মানুষকে কীভাবে প্রস্তুত করা হবে?
৫০ দেশের এআই প্রস্তুতি নিয়ে গবেষণা
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (UGA) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বের ৫০টি দেশ কীভাবে এআই-ভিত্তিক পরিবর্তনের জন্য তাদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নীতিতে রূপান্তর আনছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের কৌশল ও অগ্রাধিকার আলাদা হলেও লক্ষ্য একই—একটি এআই-প্রস্তুত কর্মশক্তি গড়ে তোলা।
চাকরি হারাবে, আবার নতুন চাকরিও তৈরি হবে
এআইয়ের কারণে শুধু শ্রমিক শ্রেণিই নয়, বরং সাদা পোশাকের পেশাজীবীরাও চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়ছেন। গবেষণায় আশঙ্কা করা হয়েছে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে প্রায় অর্ধেক চাকরি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
তবে এ পরিবর্তন শুধুই নেতিবাচক নয়। গবেষকেরা বলছেন, আজকের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৫% শিক্ষার্থী এমন পেশায় যুক্ত হবে যা এখনো তৈরি হয়নি। এসব নতুন পেশার জন্য প্রয়োজন হবে গভীর এআই জ্ঞান, যা এখন থেকেই গড়ে তুলতে হবে।
তবে মানুষ হিসেবে আবেগ, সৃজনশীলতা, সহযোগিতা ও যোগাযোগের দক্ষতা যা এআই দিয়ে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়, তা আগামীর কর্মজীবনে মানুষকেই এগিয়ে রাখবে।
কোন কোন দেশ এগিয়ে?
গবেষণার নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপক লেহং শি জানিয়েছেন, ৫০টি দেশের জাতীয় এআই নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে ছয়টি সূচকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়েছে—লক্ষ্য, বাস্তবায়নের পদ্ধতি, প্রকল্পের উদাহরণ, সফলতার মাপকাঠি, সহায়তা কাঠামো এবং সময়সীমা।
এতে দেখা গেছে, মাত্র ১৩টি দেশ ‘উচ্চ অগ্রাধিকার’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি ইউরোপীয় দেশ, বাকি দুটি মেক্সিকো ও অস্ট্রেলিয়া।
এই দেশগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছে, যাদের অনেকেরই শক্তিশালী শিক্ষা ব্যবস্থা ও জীবনব্যাপী শেখার সংস্কৃতি রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কোথায়?
যুক্তরাষ্ট্র এই তালিকায় ‘মাঝারি অগ্রাধিকার’ পাওয়া ২৩টি দেশের একটি। এর অর্থ, দেশটির জাতীয় এআই পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় বিশদতা ও সমন্বয় অনেকটাই অনুপস্থিত।
যদিও আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এআই ল্যাব গড়ে তুলছে এবং কিছু কোম্পানি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ের উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়তে পারে।
শিক্ষাক্ষেত্রে এআই প্রবর্তন
প্রায় সব দেশই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এআই প্রোগ্রাম বিস্তারের উদ্যোগ নিয়েছে। অনেক দেশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এআই অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা করেছে। অধিকাংশ দেশই চাকরির ক্ষেত্রেই এআইভিত্তিক প্রশিক্ষণের দিকে ঝুঁকছে, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাংকিং ও শিল্পক্ষেত্রে। তবে দুঃখজনকভাবে, বয়স্ক, বেকার ও কম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জাতীয় কৌশল থেকে প্রায় বাদ পড়ে গেছে।
জাতীয় অগ্রাধিকার ও ব্যতিক্রমী উদ্যোগ
কিছু দেশ এআইকে প্রতিরক্ষা বা স্বাস্থ্যখাতে ব্যবহারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। যেমন—জার্মানি একটি ‘এআই সচেতনতা সংস্কৃতি’ গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছে। স্পেন এমনকি শিশুদের প্রিস্কুল থেকেই এআই শেখাচ্ছে। এ ধরনের উদ্যোগ আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিশুদের প্রস্তুত করছে, ভয় কাটিয়ে আত্মবিশ্বাস গড়ছে।
মানবিক গুণাবলির গুরুত্ব উপেক্ষিত
গবেষণার সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হলো—মানবিক গুণাবলি যেমন সৃজনশীলতা, দলগত কাজের দক্ষতা ও যোগাযোগ দক্ষতা অধিকাংশ দেশের নীতিতে উপেক্ষিত। যখন প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ছে, তখন নরম দক্ষতার অভাব কর্মক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠতে পারে।
ভবিষ্যতের পথে
সব দেশই এক পথে হাঁটছে না—কেউ দ্রুত, কেউ ধীরগতিতে, কেউ শিক্ষা কেন্দ্রিক, কেউ নিরাপত্তা বা অর্থনীতির দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু লক্ষ্য একটাই—একটি প্রস্তুত জনগোষ্ঠী তৈরি করা। যে দেশগুলো শিখছে, অভিযোজিত হচ্ছে এবং সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করছে, তারাই হবে এআই যুগে সাফল্যের দিশারী।
সূত্র: Earth.com
নোভা