ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

ইসরায়েল তেহরানে হামলা চালালেই চুক্তি ভাঙত! কিন্তু কে দিল থামার সিগনাল?

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২৫ জুন ২০২৫

ইসরায়েল তেহরানে হামলা চালালেই চুক্তি ভাঙত! কিন্তু কে দিল থামার সিগনাল?

ছবি: সংগৃহীত

মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় আবেগে ভরপুর এক নাটকীয় ঘটনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন উত্তেজনা, ক্ষোভ আর বিজয়ের মাঝেই দোদুল্যমান ছিলেন। ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতি নিয়ে তার উদ্যোগ কখনও ধসে পড়ার পথে গিয়েছে, কখনও আবার তা বাস্তব রূপ পেয়েছে।

চুক্তি সম্পন্ন করতে গিয়ে ট্রাম্প ইসরায়েল ও ইরানের প্রতি প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন—যা একজন প্রেসিডেন্টের পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু নয়, তবে এবার যেন তা আরও বেশি তীব্র হয়ে উঠেছিল।

এই প্রচেষ্টায় সহায়তা করেছে ট্রাম্পের উপদেষ্টারা ও কাতারি মিত্ররা, যারা সোমবার ইরানের পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জবাবে একটি নিয়ন্ত্রিত, মুখরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া দেখতে পান। পাশাপাশি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার জনগণকে জানাতে পারেন, ১২ দিনের বোমাবর্ষণে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা দেন, “এটা এমন একটি যুদ্ধ, যা বছরের পর বছর চলতে পারত এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্য ধ্বংস করে দিতে পারত। কিন্তু তা হয়নি, আর কখনও হবেও না!”

নেতানিয়াহু ট্রাম্পের বার্তায় খুব একটা উচ্ছ্বসিত নন

চুক্তির ভিত্তি তৈরি হয় রোববার ভোরে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর আঘাত হানার পরপরই।

ট্রাম্প তখন তার দলকে নেতানিয়াহুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। হোয়াইট হাউসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন—আর কোনো সামরিক হামলা চালাবে না যুক্তরাষ্ট্র।

তিনি জানান, এখনই সময় যুদ্ধ থামিয়ে কূটনৈতিক আলোচনায় ফেরার। মার্কিন হামলায় ইরানের তাৎক্ষণিক হুমকি দূর করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ট্রাম্প।

নেতানিয়াহু ট্রাম্পের যুক্তি মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের লক্ষ্য অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছানোর কথা স্বীকার করেন। যদিও তিনি সরাসরি সমর্থন দেননি, তবু বুঝে নেন যে যুক্তরাষ্ট্র আর সামরিক জড়িততায় আগ্রহী নয়।

এ সময়েই ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ সরাসরি কথা বলেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে। তিনি জানান, ইরানকে আলোচনায় ফিরতে হবে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র দেখিয়েছে যে তারা কী করতে সক্ষম—এবং প্রয়োজনে আরও অনেক কিছু করতে পারে।

উইটকফ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শান্তি চায়—এবং ইরানেরও তাই করা উচিত।

ফক্স নিউজে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উইটকফ জানান, ট্রাম্প এখন এমন এক পূর্ণাঙ্গ শান্তিচুক্তি চান, যা যুদ্ধবিরতির চেয়েও বেশি কিছু নিশ্চিত করবে।

তিনি বলেন, “আমরা একে অন্যের সঙ্গে ইতোমধ্যে কথা বলছি—সরাসরি ও মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে। আলোচনা আশাব্যঞ্জক।”

‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতি’র ঘোষণা ট্রাম্পের

৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা দেন, “সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতি” কার্যকর হয়েছে।

এই যুদ্ধবিরতির ভিত্তি ছিল শুধুমাত্র সামরিক হামলা বন্ধের ওপর, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কিংবা অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে কোনো শর্ত এতে যুক্ত ছিল না। ট্রাম্প বিশ্বাস করছিলেন, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

তবে ট্রাম্প যখন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির কথা বলছেন, তখন ইসরায়েল ও ইরান দুই পক্ষই চুপচাপ—তাদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য আসেনি।

প্রথমে মুখ খোলেন আরাগচি। তিনি এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লেখেন, “এই মুহূর্তে কোনো যুদ্ধবিরতি বা সামরিক অভিযান বন্ধের ‘চুক্তি’ হয়নি। তবে ইসরায়েলি আগ্রাসন থেমে গেলে আমাদের পক্ষ থেকেও প্রতিক্রিয়া বন্ধ থাকবে।”

ইরান-ইসরায়েলের প্রতিশ্রুতি ছিল অস্পষ্ট

ট্রাম্পের ঘোষণার কিছুক্ষণ আগে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেই সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, “ইরান আত্মসমর্পণ করবে না।” তবে তিনি এই সমঝোতায় নিজে জড়িত ছিলেন কি না, তা স্পষ্ট নয়।

অন্যদিকে নেতানিয়াহুও চুপ ছিলেন। ট্রাম্পের ঘোষণার আট ঘণ্টা পর তিনি জানান, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে এবং ইরানের বিরুদ্ধে তাদের লক্ষ্য অর্জন হয়েছে।

কাতার ছিল মধ্যস্থতায় মুখ্য

কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আল থানির মতে, ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার পরেই যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ গতি পায়।

ইরান ওই দিন রাতে কাতারে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন ঘাঁটিতে ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। এর মধ্যে ১৩টি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ধ্বংস হয়। একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিরীহ দিকে যাচ্ছিল বলে ইচ্ছাকৃতভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট করা হয়।

ট্রাম্প দাবি করেন, ইরান ও কাতার আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছিল, যাতে সেনারা নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারে ও কাতার তার আকাশসীমা খালি রাখতে পারে।

কাতারের প্রধানমন্ত্রী জানান, ওই হামলার পর ট্রাম্প কাতারের আমির শেখ তামিমের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ফোনে কথা বলেন। ট্রাম্প তখন কাতারকে বলেন ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে, তারা যুদ্ধবিরতির জন্য কতটা প্রস্তুত।

মুহূর্তটাই কাজে লাগালেন ট্রাম্প

ট্রাম্প এরপর নেতানিয়াহুর সঙ্গে আবার যোগাযোগ করেন এবং যুদ্ধ বন্ধে তার সম্মতি নিশ্চিত করেন। নেতানিয়াহু শর্ত দেন, ইরান যদি আর হামলা না করে, তবে ইসরায়েলও থেমে যাবে।

এরপর দ্রুতই ঘটনাপ্রবাহ এগোয়।

সোমবার সন্ধ্যায় ফক্স নিউজের “স্পেশাল রিপোর্ট” অনুষ্ঠানে যখন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স উপস্থিত, তখনই ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। উপস্থাপক ব্রেট বাইয়ার ট্রাম্পের ঘোষণার কথা বললে ভ্যান্স কিছুটা অবাক হয়ে বলেন, “আমি হোয়াইট হাউস থেকে এখানে আসার সময়ই বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছিল। প্রেসিডেন্ট সেটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন, এটা ভালো খবর।”

যুদ্ধবিরতির মাঝেও হামলা চলতে থাকে

ট্রাম্পের ঘোষণার পরও হামলা থামে না। মঙ্গলবার ভোর ৪টা, অর্থাৎ ইরান নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর, ইরান আবার ইসরায়েলে হামলা চালায়।

এর আগে ইসরায়েলও তেহরানের ওপর বড় ধরনের হামলা চালায়। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় জানায়, “আমরা তেহরানের কেন্দ্রে শক্তিশালী হামলা চালিয়েছি, শাসক গোষ্ঠীর টার্গেট ধ্বংস করে শত শত বাসিজ ও নিরাপত্তা সদস্যকে হত্যা করেছি।”

ইরানি গণমাধ্যম জানায়, গিলান প্রদেশে ৯ জন নিহত হয়েছে। “চারটি আবাসিক ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে, আশেপাশের অনেক ঘরবাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত।”

ক্ষুব্ধ ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি

মঙ্গলবার সকালে ন্যাটো সম্মেলনে অংশ নিতে ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ছাড়ার কথা থাকলেও, এর আগেই সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি স্পষ্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “আমি ইরান নিয়ে খুশি নই, কিন্তু সবচেয়ে বেশি হতাশ ইসরায়েল নিয়ে। এতদিন ধরে যুদ্ধ করে তারা নিজেরাও যেন বুঝে না পাচ্ছে, কী করছে।”

এরপরই তিনি ট্রুথ সোশালে লেখেন:
“ইসরায়েল, ওই বোমাগুলো ফেলো না। ফেললে সেটা হবে বড় ধরনের চুক্তি লঙ্ঘন। তোমাদের পাইলটদের ফিরিয়ে আনো, এখনই!”

এরপর এয়ার ফোর্স ওয়ানে উঠেই ট্রাম্প ফোন করেন নেতানিয়াহুকে। হোয়াইট হাউস কর্মকর্তাদের মতে, তিনি ছিলেন “অত্যন্ত কঠোর ও সরাসরি”।

নেতানিয়াহু সেই বার্তা বুঝে নেন। তাঁর কার্যালয় জানায়, ট্রাম্পের অনুরোধে ইসরায়েল আর কোনো অতিরিক্ত হামলা চালায়নি।

এরপর ট্রাম্প আবার জানান, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে।
“ইসরায়েল আর ইরানে হামলা করবে না। সব বিমান ফিরে আসবে, বন্ধুত্বপূর্ণ ‘প্লেন ওয়েভ’ জানাবে ইরানকে। কেউ আহত হবে না, যুদ্ধবিরতি কার্যকর!”

ফ্লাইটের বাকি সময়টুকু ট্রাম্প কাটান নিজের অর্জন উদযাপন করে।

তিনি বলেন, “পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করে যুদ্ধ থামাতে পারাটা ছিল আমার জন্য বিরাট গর্বের বিষয়!”

আবির

×