ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২

যুদ্ধ চায় না ট্রাম্পের মন্ত্রিসভা, ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে কি প্রভাব পড়বে?

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ২০ জুন ২০২৫

যুদ্ধ চায় না ট্রাম্পের মন্ত্রিসভা, ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে কি প্রভাব পড়বে?

ছ‌বি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের মন্ত্রিসভা ও ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারা আগের তুলনায় অনেক কম যুদ্ধবাজ বা ‘হকিশ’। ফলে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র কী ভূমিকা নেবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকরা বিভক্ত।

সম্প্রতি ইসরায়েল আকস্মিকভাবে তেহরানে হামলা চালালে ইরান পাল্টা জবাব দেয়। শুরু হয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও বিস্ফোরণের পাল্টাপাল্টি ঘটনা, যা দ্রুত বিস্তৃত হয়ে বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে।

বিশ্লেষক ব্রায়ান ফিনুকান বলছেন, “এখনকার ট্রাম্প প্রশাসনে প্রচলিত রিপাবলিকান যুদ্ধপন্থীদের তুলনায় অনেক কম সংখ্যক রয়েছেন। বরং যারা আরও সংযত পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাস করেন, তাদের প্রভাব বাড়ছে।” তবে প্রশ্ন হচ্ছে— তারা কতটা জোরালোভাবে তাদের মতামত রাখতে পারবেন?

এখন পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসন এই সংঘাতে সরাসরি যুক্ত হয়নি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানিয়েছেন, ইসরায়েলের এই হামলাগুলো একতরফা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি পাঠালেও সরাসরি লড়াইয়ে নামেনি।

ট্রাম্প নিজেও হামলার আগে বলেছিলেন, তিনি কূটনীতিক পথকেই অগ্রাধিকার দিতে চান। তবে এবিসি নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে জড়াতে পারে, যদি সেখানে থাকা মার্কিন সেনাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে।

ট্রাম্প বলেছেন, ইসরায়েলের বোমা হামলাকে তিনি ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে চলমান আলোচনায় একটি চাপ তৈরির হাতিয়ার হিসেবেও দেখছেন, যদিও এসব হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ আলোচক নিহত হয়েছেন।

এদিকে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে অভিযুক্ত করে বলেন, “তিনি ট্রাম্পকে এবং মার্কিন জনগণকে বোকা বানাচ্ছেন।” তার দাবি, ট্রাম্প চাইলে একটি ফোন দিয়েই এই যুদ্ধ থামাতে পারেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প কী সিদ্ধান্ত নেন, তার উপর নির্ভর করবে সংঘাতের ভবিষ্যৎ। সেই সঙ্গে এটা প্রকাশ করবে, রিপাবলিকান পার্টির ভেতরের আদর্শিক বিভাজনে তিনি কোন দিকে ঝুঁকছেন।

একদিকে আছে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ মতবাদে বিশ্বাসীরা—যারা মনে করেন দেশের স্বার্থ আগে, বাইরের সংঘাতে না জড়ানোই শ্রেয়। অন্যদিকে আছে যুদ্ধপন্থী ‘নিওকন’ ধারার রাজনীতিবিদরা—যারা বিদেশে হস্তক্ষেপ ও সরকার পরিবর্তনে আগ্রহী।

ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে এই দুই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন দেখা যায়। যেমন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স প্রকাশ্যে যুদ্ধ বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের ওপর মার্কিন হামলার সময় তিনি এর বিরোধিতা করেন এবং বলেন, এটা ট্রাম্পের বৈশ্বিক নিরপেক্ষতার বার্তার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

ভ্যান্স বলেন, “আমাদের স্বার্থ হলো ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ না করা।” রিপাবলিকানদের মধ্যে এমন বক্তব্য খুবই বিরল বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ডও ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে সতর্কভাবে বলেছেন, “আমরা মনে করি ইরান এখনো পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে না।” মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ পর্যন্ত ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন।

তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মার্কো রুবিও অতীতে একজন কঠোর ‘ইরান বিরোধী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে প্রশাসনে যোগ দেওয়ার পর তিনি ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির বাইরে যাননি।

বিশ্লেষক ব্রায়ান কাতুলিস বলছেন, “ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের মন্ত্রিসভায় যোগ্যতার চেয়ে আনুগত্যই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ইরানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে হামলায় আগ্রহ দেখালেও বলছেন, প্রেসিডেন্ট এখনও শান্তিপূর্ণ সমাধান চান।

মধ্যপ্রাচ্য নীতি পর্যবেক্ষক রায়ান কস্টেলো মনে করেন, বর্তমান প্রশাসন এখনো আগের মতোই কিছুটা যুদ্ধপন্থী রয়ে গেছে।

উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল দূত মাইক হাকাবি ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলাকে মার্কিন স্বার্থের ওপর আঘাত হিসেবে দেখাতে চাচ্ছেন।

তবে কস্টেলো বলেন, এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। সামরিক নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট। মধ্যপ্রাচ্যে আরও সেনা পাঠানোর প্রস্তাবে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কমান্ডার জেনারেল মাইকেল কুরিলা আগ্রহ দেখালেও, প্রতিরক্ষা বিভাগের উপ-প্রধান এলব্রিজ কলবি তা নাকচ করে দেন।

এই দ্বন্দ্ব রিপাবলিকান পার্টির বড় পরিবর্তনেরই প্রতিফলন। অনেকেই এখন মনে করেন, আগের ‘যুদ্ধ নীতিগুলো’ শুধু ব্যর্থই নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকরও।

ফিনুকান বলেন, “২০১৯ সালে ট্রাম্পের সব উপদেষ্টাই ইরানকে হামলা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি নিজেই পিছিয়ে যান। তবে পরের বছর তিনি কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।”

সব মিলিয়ে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুদ্ধবিরোধী ধারা কিছুটা শক্তিশালী হলেও, মন্ত্রিসভার ভেতরের দ্বিধা এবং ট্রাম্পের নিজস্ব অবস্থান এই সংকট নিরসনে কোন পথে যাবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

সূত্র: আল জাজিরা

এম.কে.

×