
ছবি: সংগৃহীত
১৯৭৯ সালে ইরানে ঘটে যাওয়া ইসলামি বিপ্লব বিশ্ব রাজনীতিতে এক বড় মোড় এনে দেয়। পশ্চিমা-সমর্থিত রাজতন্ত্র ভেঙে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। সেই বিপ্লব শুধু ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেই পাল্টে দেয়নি, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতার সূচনা করে।
বিপ্লবের সময় ইরানের জনগণ ব্যাপকভাবে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়। বিলাসী জীবনযাপন, পশ্চিমাপন্থী সংস্কৃতি এবং সাধারণ মানুষের প্রতি অবহেলা ইরানিদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে ফ্রান্সে নির্বাসনে থাকা আয়াতোল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনি দেশে ফিরে বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বেই ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিপ্লবের আগেই ইরানে রাজনৈতিক উত্তেজনা শুরু হয়েছিল ১৯৫৩ সালের এক অভ্যুত্থান দিয়ে। তখন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং তেল সম্পদের জাতীয়করণ করেন, যা পশ্চিমাদের— বিশেষ করে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত হানে। ফলে সিআইএ ও ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এক যৌথ পরিকল্পনায় মোসাদ্দেক সরকারকে হটিয়ে ফের শাহকে ক্ষমতায় বসায়।
এই ঘটনার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে ইরানের রাজনীতিতে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে তার কৌশলগত মিত্র হিসেবে ব্যবহার করত। শাহ আমলে ইরান ছিল বিশ্বের অন্যতম তেল উৎপাদক দেশ এবং মার্কিন অস্ত্রের বড় ক্রেতা। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে একটি রক্ষাকবচ হিসেবে দেখত।
কিন্তু ১৯৭৯ সালের শুরুতে সেই চিত্র বদলে যায়। সারাদেশে শাহবিরোধী বিক্ষোভ ও ধর্মঘট শুরু হয়। অবশেষে শাহ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। আয়াতোল্লাহ খোমেইনি দেশে ফিরে আসেন এবং ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে পুরনো শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করা হয়।
শাহের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রে চরম ক্ষোভ জন্ম নেয়। কারণ তারা ইরানকে হারিয়েছে- যা শুধু এক বিশ্বস্ত মিত্র নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব বিস্তারের এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে— কূটনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে এবং কখনো কখনো সামরিকভাবে।
সাম্প্রতিক সময়ে এই চাপ আরও বেড়েছে। ইসরায়েল অভিযোগ করেছে, ইরান গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে, যা বিশ্বনিরাপত্তার জন্য হুমকি। যদিও ইরান তা অস্বীকার করে বলেছে, তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক।
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা ইরানের তেল ও গ্যাস স্থাপনায় নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও ইরানকে ঘিরে সামরিক কৌশল জোরদার করছে। তাদের মিত্র দেশগুলো ইরানকে ঘিরে রাখতে এবং রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
তবে ইরান এখন অনেক ক্ষেত্রেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশটি নিজস্ব প্রযুক্তিতে গাড়ি, জাহাজ, যুদ্ধবিমান নির্মাণ করছে। কৃষি ও খাদ্যশিল্পে তারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। নারী শিক্ষায়ও ইরান এগিয়ে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে।
ইরানের জনগণ দেশপ্রেমিক এবং আত্মনির্ভরশীল। তারা নিজেদের উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত এবং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চায় ইরান যেন বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার না করতে পারে।
৪৬ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই ইসলামি বিপ্লব এখনো ইরান ও পশ্চিমা বিশ্বের মাঝে এক গভীর বিভাজন তৈরি করে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের চোখে এই বিপ্লব ছিল একটি প্রতিক্রিয়াশীল পরিবর্তন, যা তাদের প্রভাব কমিয়ে দেয়। তাই আজও তারা যেন সেই বিপ্লবের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে আছে।
এই উত্তেজনার শেষ কোথায়, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে একথা স্পষ্ট— ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব শুধু দুই দেশের ব্যাপার নয়, বরং তা গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
এম.কে.