
ছবি: সংগৃহীত
শনিবার (১৪ জুন) রাতে প্রথমবারের মতো ইরানের তেল ও গ্যাস স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে এবং তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বৈশ্বিক জ্বালানি শিল্পে।
শুক্রবার (১৩ জুন) ইসরায়েল ইরানের বেশ কয়েকটি সামরিক ও পরমাণু স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়। এতে নিহত হন দেশটির কয়েকজন কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানী। ইরান বলছে, তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক উদ্দেশ্যে, যদিও ইসরায়েল দাবি করছে এটি পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা।
ইসরায়েলের এক হামলায় ইরানের দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে আগুন ধরে যায়। তাসনিম বার্তা সংস্থার মতে, ফেজ ১৪-তে চারটি ইউনিটের মধ্যে একটি ইউনিটে আগুন লাগায় দৈনিক ১ কোটি ২০ লাখ ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রটি ইরানের দক্ষিণ বুশেহর প্রদেশে অবস্থিত এবং ইরানের গ্যাস উৎপাদনের বড় অংশ এখান থেকে আসে।
দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্র বিশ্বের মোট গ্যাস মজুদের প্রায় ২০ শতাংশ ধারণ করে। এটি ইরান ও কাতার যৌথভাবে ব্যবহার করে। কাতার এ ক্ষেত্রকে ‘নর্থ ফিল্ড’ নামে ডাকে এবং এখান থেকে প্রতি বছর ৭৭ মিলিয়ন টন তরল প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন করে ইউরোপ ও এশিয়ায় রপ্তানি করে।
ইরানের তেল মন্ত্রণালয় জানায়, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে, তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে।
‘হিন্দুস্তান টাইমস’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরান ও ইসরায়েলের এই সংঘর্ষে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। ইরান ওপেক সদস্য দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী। ইসরায়েলের হামলায় ইরানের জ্বালানি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্লেষক জর্জ লিয়ন বলেন, এটি সম্ভবত ২০১৯ সালে সৌদি আরবের আবকাইক তেল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে হামলার পর সবচেয়ে বড় আঘাত। তখন তেলের দাম দ্রুত বেড়ে যায়। লিয়ন মনে করেন, এবারও এমনটা হতে পারে।
এনর্জি অ্যাসপেক্টসের রিচার্ড ব্রোঞ্জ বলেন, “এটি একটি গুরুতর সংঘাতের সূচনা হতে পারে।” তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ইসরায়েল হয়তো ইরানের আরও জ্বালানি স্থাপনায় হামলা চালাতে পারে।
এদিকে ইরানের এক জেনারেল এসমাইল কোসারি জানিয়েছেন, তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধের বিষয়টি বিবেচনা করছে। এই প্রণালী দিয়েই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিশ্ববাজারে তেল রপ্তানি করে। বিশ্ব তেলের প্রায় ২০ শতাংশ এখান দিয়ে পরিবাহিত হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, যদি ইরান প্রণালী বন্ধ করে দেয় কিংবা তেলবাহী জাহাজে হামলা চালায়, তবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ২০ ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
ন্যাশনাল ইরানিয়ান আমেরিকান কাউন্সিলের সভাপতি জামাল আবদি বলেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা ইরানের ‘ট্রাম্প কার্ড’। এটি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
ইরানের দৈনিক তেল উৎপাদন ৩০ লাখ ব্যারেলের বেশি। ওপেকের অন্য সদস্যদের মধ্যে কেবল সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতই তাৎক্ষণিকভাবে উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম। বাকিদের উৎপাদন প্রায় সীমায় পৌঁছে গেছে।
রাশিয়া ওপেক প্লাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদক হলেও, নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের উৎপাদন বাড়ানো কঠিন। জেপি মর্গান বলছে, রাশিয়া সাময়িকভাবে মাত্র ২.৫ লাখ ব্যারেল উৎপাদন বাড়াতে পারে।
ইরানের প্রধান তেল ক্রেতা চীন। মূলত বেসরকারি চীনা রিফাইনারিগুলো — যাদের ‘টিপট রিফাইনারি’ বলা হয় — ইরানের তেল কেনে। তাদের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর ইতিমধ্যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইরানের জ্বালানি অবকাঠামোতে আবার হামলা হলে চীনের আমদানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
ইসরায়েল তেহরানের উত্তর-পশ্চিমে ‘শাহরান’ জ্বালানি ডিপো এবং দক্ষিণে ‘শাহর রে’ তেল পরিশোধন কেন্দ্রে হামলা চালায় বলে ইরানি তেল মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। শাহরান ডিপোতে ১১টি ট্যাংকে প্রায় ২৬ কোটি লিটার জ্বালানি মজুত থাকে এবং এটি রাজধানী তেহরানের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
যদিও ইরানের ছাত্র সংবাদ সংস্থা দাবি করেছে শাহর রে তেল পরিশোধন কেন্দ্র আংশিকভাবে সচল আছে, তবুও বাইরে একটি ফুয়েল ট্যাংকে আগুন লেগেছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের তেল ও গ্যাস অবকাঠামোয় ইসরায়েলের এই হামলা বিশ্ব জ্বালানি বাজারে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। যুদ্ধ আরও গভীরে গেলে তেলের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে, যার প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে।
সূত্র: ডন
এম.কে.