ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

বিদায় হজের বাণীতে রক্তের নিষেধাজ্ঞা: আল-আজহার থেকে মানবতার এক অমর আহ্বান

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান, লেখক ও কলামিস্ট, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মিশর

প্রকাশিত: ০০:১৭, ১৫ জুন ২০২৫; আপডেট: ০০:২৬, ১৫ জুন ২০২৫

বিদায় হজের বাণীতে রক্তের নিষেধাজ্ঞা: আল-আজহার থেকে মানবতার এক অমর আহ্বান

ছবি: সংগৃহীত

কায়রোর আকাশের নিচে, এক ঐতিহাসিক মিম্বরে দাঁড়িয়ে যখন আল-আজহারের খতিব ড. মাহমুদ আল-হাওয়ারি জুমার খুতবায় বলছিলেন—‘রক্ত, সম্পদ ও সম্মান—এই তিনটি পবিত্রতা বিদায় হজে মহানবী (সা.) মানবজাতির চিরন্তন অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন’—তখন যেন পবিত্রতা ও মানবতার এক নবজাগরণ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল সেই শতাব্দীপ্রাচীন মসজিদের স্তম্ভে স্তম্ভে।

ড. হাওয়ারির কণ্ঠে ছিল এক আহ্বান—মার্জিত, দৃঢ় ও বিবেক-জাগানিয়া। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন সেই মহাসমাবেশের কথা, আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়ে মহানবী (সা.) যখন লক্ষাধিক সাহাবির সামনে ঘোষণা করলেন জীবনের মৌলিক অধিকারসমূহ, তখন তা ছিল না কেবল একটি ধর্মীয় বক্তব্য, ছিল এক বৈশ্বিক মানবঘোষণা, ছিল একটি নীতির সংবিধান, যা আজো পৃথিবীর প্রতিটি বিবেকবান মানুষের জন্য অনিবার্য শিক্ষা।

আধুনিক সভ্যতার মুখোশ যখন প্রতিদিনই রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে, গাজায় যখন শিশুদের কান্না স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে ধ্বংসস্তূপের নিচে, তখন ড. হাওয়ারি জিজ্ঞেস করেন, আজকের তথাকথিত উন্নত মানবজাতি কোথায় হারিয়ে ফেলেছে সেই সহজ সত্য—মানুষের জীবন পবিত্র, সম্মান অপরিহার্য, সম্পদ সুরক্ষিত হওয়া উচিত? তাঁর কণ্ঠে ক্ষোভ ছিল, বেদনা ছিল, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ছিল আশা—যে আমরা আবারো ফিরতে পারি বিদায় হজের বাণীতে।

তিনি বলেন, ইসলাম কেবল শান্তি নয়, শান্তির অবিচ্ছেদ্য ও সক্রিয় দর্শন। নবী মুহাম্মদ (সা.) মানবজাতিকে যে মূল তিনটি নিষিদ্ধ রক্তপিপাসা থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন—নিরপরাধ রক্তপাত, সম্পদের লুন্ঠন ও চরিত্র হনন—আজ ঠিক সেই জায়গায় সমাজ ফিরে যাচ্ছে, যেন জাহিলিয়াতের ধুলো আবারও ইতিহাসের চোখে পড়েছে। এবং এটা শুধু গাজা কিংবা কোন যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্যা নয়, এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ সমাজেও বিরাজমান। প্রতিদিন সংবাদে উঠে আসে চরম অমানবিকতার খবর—তুচ্ছ কারণে খুন, প্রতিশোধে আগুন, গোত্রীয় গর্বে উন্মত্ততা।

আল-আজহারের খতিব প্রশ্ন তোলেন—এই কি সেই মিসর? সেই মহান আলেমদের জন্মভূমি—যেখানে একদিন আল্লাহর নামেই উচ্চারিত হতো জ্ঞান, ন্যায় ও করুণা? তিনি বলেন, সমাজে শালীনতা ও শান্তির পরিবর্তে যখন জাহিলি গোত্রপ্রীতির আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করে, তখন একমাত্র নবীর বিদায় হজের শিক্ষাই পারে সে আগুন নেভাতে।

তিনি আরও বলেন, ইসলাম শুধু কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য নয়—এই ধর্ম বিশ্বমানবতার জন্য এক মুক্তির দিশারি। যে ধর্ম বলে, ‘যে একজন প্রাণ বাঁচালো, সে যেন গোটা মানবজাতিকে বাঁচাল’—সে ধর্ম কি মানুষ হত্যা সমর্থন করতে পারে? তিনি স্মরণ করান, নবীজি (সা.) নিজেই বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গোত্রীয়তার নামে লড়াই করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’

শেষাংশে খতিব একটি হৃদয়ছোঁয়া আহ্বান রাখেন—ঘৃণা নয়, ক্ষমা ছড়ান; রাগ নয়, সহিষ্ণুতা গড়ুন; বিভেদ নয়, ঐক্য ফিরিয়ে আনুন। কারণ মানবতার ভবিষ্যৎ রচিত হবে কেবল করুণার ছায়ায়, শান্তির ছন্দে। বিদায় হজের সেই বাণী, আজও আমাদের নৈতিক ও সামাজিক মুক্তির পথ দেখায়। সেই বাণীর প্রতিধ্বনি আজও আল-আজহারের গম্বুজ থেকে গড়িয়ে পড়ে মানবতার হৃদয়ে।

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান/রাকিব

×