
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রে সরকার, প্রযুক্তি, রাজনীতি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু সংখ্যক স্মার্টফোনে অস্বাভাবিক সফটওয়্যার ক্র্যাশ লক্ষ্য করার পর একটি জটিল সাইবার হামলার তথ্য উঠে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ব্যবহারকারীর একটিও ক্লিক ছাড়াই এই ফোনগুলোতে ঢুকে পড়েছিল হ্যাকাররা। সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান iVerify-এর গবেষকেরা জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা সবাই চীনা সরকারের আগ্রহের ক্ষেত্রেই কাজ করতেন এবং এর আগেও চীনা হ্যাকারদের নিশানায় ছিলেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্মার্টফোন ও এর অ্যাপগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তার অন্যতম দুর্বল লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনের সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িত হ্যাকাররা মার্কিন অভিজাতদের মোবাইল লক্ষ্য করে টেলিকম নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়ছে।
iVerify-এর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা রকি কোল জানান, “বিশ্ব এখন একটি মোবাইল সিকিউরিটি সংকটের মধ্যে আছে। ফোনগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না।”
ফোনেই রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য
স্মার্টফোনের মাধ্যমে এখন স্টক কেনা, ড্রোন চালানো থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা পর্যন্ত হচ্ছে। অথচ এসব ফোনেই রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি তথ্য, পাসওয়ার্ড ও নীতিনির্ধারণী আলোচনার তথ্য—যা একবার ফাঁস হলে ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা।
গত ডিসেম্বরে মার্কিন কর্তৃপক্ষ জানায়, একটি বিস্তৃত চীনা সাইবার হামলা চালানো হয়েছে, যার মাধ্যমে অজস্র মার্কিন নাগরিকের ফোন কল ও মেসেজে প্রবেশের চেষ্টা করা হয়। মার্কিন কংগ্রেসম্যান রাজা কৃষ্ণমূর্তি জানান, “হ্যাকাররা বাস্তব সময়েই ফোনকলে কান দিচ্ছে, মেসেজ পড়ছে।”
২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সঙ্গী জেডি ভ্যান্সের ফোনেও হ্যাকিংয়ের চেষ্টা চালানো হয় বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন সাইবার উত্তেজনা
চীনা সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্টা অভিযোগে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই বিভিন্ন দেশের সাইবার তথ্য চুরি করে থাকে এবং “জাতীয় নিরাপত্তা” অজুহাতে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, “আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে ঘৃণ্য পদ্ধতিতে অন্য দেশের গোপন তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে।”
তবে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, চীন একটি স্থায়ী ও ভয়াবহ সাইবার হুমকি। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল নজরদারি, মিথ্যা প্রচার এবং হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ যেকোনো সংঘাতে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে।
বিশ্বের মোবাইল নেটওয়ার্কেও চীনের প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র অনেক দেশ ইতোমধ্যে চীনা টেলিকম কোম্পানিগুলোকে নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি জার্মানিও তাদের অবকাঠামো থেকে ধীরে ধীরে চীনা প্রযুক্তি সরিয়ে ফেলছে। তবে অনেক দেশেই এখনো চীনা কোম্পানিগুলোর ক্লাউড স্টোরেজ ও নেটওয়ার্ক রাউটিংয়ের উপস্থিতি রয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসম্যান জন মুলেনার বলেন, “আমেরিকানদের জানা উচিত, বেইজিং আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো ব্যবহার করছে কি না।”
সতর্কতা না মানলে হ্যাকারদের সহজ শিকার
স্মার্টফোন যতটা নিরাপদই হোক না কেন, ব্যবহারকারী যদি নিরাপত্তা বিধি না মানে, তাতে বড় ধরনের তথ্য ফাঁসের আশঙ্কা থেকেই যায়। সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ ভুল করে সামরিক পরিকল্পনার একটি সিগনাল গ্রুপে সাংবাদিককে অ্যাড করে ফেলেছিলেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ আবার পেন্টাগনের নির্ধারিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাইপাস করে ব্যক্তিগত কম্পিউটারে সিগনাল ব্যবহার করতেন, যা বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মাইকেল উইলিয়ামস বলেন, “যখন নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম আছে, তখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে তথ্য আদান-প্রদান করাটা ভয়ংকর।”
চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র “সাইবার ট্রাস্ট মার্ক” নামের একটি প্রকল্প চালু করেছে, যাতে সরকারি মানসম্পন্ন নিরাপত্তা থাকা ডিভাইসগুলোকে চিহ্নিত করা যায়। তবে সাধারণ মানুষকেও সচেতন থাকতে হবে। যেমন হরাইজন৩.এআই-এর সিইও স্নেহাল অন্তানির ভাষায়, “বার্বি ডলের ভেতরেও ব্যাকডোর খুঁজে বের করছে হ্যাকাররা।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে স্মার্টফোন ও সংযুক্ত ডিভাইসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া এখন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য এক ভয়াবহ সংকেত হয়ে উঠেছে।
সূত্র: এপি।
রাকিব