
ছবি: সংগৃহীত
আফ্রিকা—বিশ্বের অন্যতম ধনী মহাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে। এখানে রয়েছে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ, হীরা, তেল, ইউরেনিয়াম, কোলটানসহ বহু মূল্যবান খনিজ ও খনিজ তেল। কিন্তু চিত্রের উল্টো দিক হলো—এই মহাদেশেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ বাস করে। প্রশ্ন উঠছে, এত সম্পদের মাঝে থেকেও কেন আফ্রিকানরা না খেয়ে দিন কাটায়? কেন তিনবেলা খেতে পারে না কোটি কোটি মানুষ?
আফ্রিকার বর্তমান দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ তার ঔপনিবেশিক অতীত। ১৯ শতক থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত আফ্রিকার বেশিরভাগ অঞ্চল ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, পর্তুগালসহ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে।
আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংক (AfDB)-এর মতে, ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য রেললাইন, খনি ও অবকাঠামো গড়েছিল, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কিছুই করেনি। স্থানীয় প্রশাসন ধ্বংস করে ইউরোপীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার ফলে স্বাধীনতার পর আফ্রিকা একটি ভঙ্গুর ও বিভক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা পায়।
AfDB প্রেসিডেন্ট আকিনউমি আদেসিনা বলেন, “আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, কিন্তু সেই সম্পদের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। আমরা কাঁচামাল রপ্তানি করি, কিন্তু প্রকৃত মূল্য সৃষ্টি হয় ইউরোপে।”
এই পরিস্থিতিকে অর্থনীতিবিদরা বলেন "resource curse" বা সম্পদের অভিশাপ। World Bank-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ বহু আফ্রিকান দেশ যেমন নাইজেরিয়া, কঙ্গো, সিয়েরা লিওন, সুদান—গভীর দারিদ্র্য, দুর্নীতি এবং সংঘাতের ফাঁদে আটকা পড়েছে।
নাইজেরিয়া বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল রপ্তানিকারক, কিন্তু এখানে প্রতি ১০ জনে ৪ জন চরম দারিদ্র্যে বাস করে। ডিআর কঙ্গো-তে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোলটান ও কপার খনি, কিন্তু ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে।
বিশ্বের বৃহৎ খনি ও জ্বালানিখাতের কোম্পানিগুলো যেমন Glencore, Shell, Total, এবং Barrick Gold আফ্রিকার সম্পদ আহরণ করে, কিন্তু আয় নিয়ে যায় নিজেদের দেশে। এর ফলে আফ্রিকার দেশগুলো পাচ্ছে কর্পোরেট করের অতি সামান্য অংশ, অথচ পরিবেশ ও সামাজিক ক্ষতির ভার তাদেরই বহন করতে হয়।
Transparency International বলছে, আফ্রিকার অনেক দেশে প্রশাসনিক দুর্নীতি, গণতান্ত্রিক দুর্বলতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে রোধ করছে। রাজনৈতিক দলগুলো সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে জাতীয় উন্নয়নের চেয়ে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে।
জাতিসংঘের FAO (Food and Agriculture Organization) ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আফ্রিকায় বর্তমানে প্রায় ২৫ কোটির বেশি মানুষ অপুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সহিংসতা, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং কৃষি অবকাঠামোর দুর্বলতা এই সংকটকে আরও তীব্র করেছে।
আফ্রিকার দারিদ্র্য শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং গ্লোবাল কাঠামোগত সমস্যার ফল। সম্পদের ভাণ্ডারে থেকেও এ মহাদেশ কেন দারিদ্র্যকবলিত, তার উত্তর লুকিয়ে আছে ঔপনিবেশিক শাসনের বিষবৃক্ষ, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন, বিদেশি করপোরেট দখলদারি এবং সামাজিক বৈষম্যের গভীরে।
ফারুক