ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শুভেন্দুর বক্তব্য কি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে?

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২ জুন ২০২৫

শুভেন্দুর বক্তব্য কি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে?

ছবি: সংগৃহীত

কলকাতার আকাশ যেন সেদিন কিছু একটা আঁচ করেছিল। ধুলোমাখা মেঘেরা এক অদৃশ্য ধোঁয়ার আভাস দিচ্ছিল—যেন কেউ ছাইচেপা আগুন উসকে দিতে চাইছে। হাওয়ার গতিও ছিল অস্বাভাবিক। আর শহরের রাস্তার বাতিগুলো যেন আগে থেকেই জানতো, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে শহরের প্রাণকেন্দ্রের এক কোণে গাড়ির জানালায় গ্লাস ভাঙার শব্দে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল রাতের নীরবতা। শুরু হলো গণধোলাই। শব্দটি যতটা বেদনাদায়ক, তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিকভাবে বিস্ফোরক। আর এবার সেই শব্দটির কেন্দ্রে উঠে এলেন পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী—একসময়ের তৃণমূল ঘনিষ্ঠ, এখন বিজেপির অন্যতম আগ্রাসী মুখ।

কিন্তু সেই গর্জন আজ যেন ঠুনকো প্রতিধ্বনিতে পরিণত হয়েছে। জনতার হাতে গণধোলাই খেয়ে শুভেন্দু পালাতে বাধ্য হয়েছেন। প্রশ্ন জাগছে—এ কি শুধুই একজন বিতর্কিত রাজনীতিকের জনরোষ, নাকি এ কোন নতুন যুদ্ধের ঢাকের শব্দ?

ঘটনার সূত্রপাত কলকাতায় নয়, বরং কাশ্মীরের পেহেলগামে। কয়েক মাস আগে পাকিস্তান সীমান্তের কাছে প্রাণঘাতী এক হামলায় নিহত হন ২৬ জন হিন্দু তীর্থযাত্রী। যখন ভারতের মিডিয়ায় এ ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে প্রচার করা হচ্ছিল, তখনই উস্কানিমূলক মন্তব্য করে ভাইরাল হন শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, “২৬ হিন্দুর বদলায় ২৬০ মুসলমানের দেহ চাই।”

এই বক্তব্য শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উত্তপ্ত রাজনীতিকে যেন তেলে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে তোলে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি নিছক হিন্দুত্ববাদী বক্তব্য নয়, বরং একটি কৌশলগত উত্তেজনার সৃষ্টি যা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতেও ছায়া ফেলেছে।

গত সপ্তাহে শুভেন্দুর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায় তার গাড়ি কলকাতার এক উত্তপ্ত বিক্ষোভে ঢুকে পড়ে। গাড়িটি চিনে ফেলতেই বিক্ষোভকারীরা ছুটে আসে। মুহূর্তেই শুরু হয় হুড়োহুড়ি, গালিগালাজ, জানালায় হামলা। তারপর সেই চিরচেনা দৃশ্য—জনতার হাতে রাজনীতিকের গণধোলাই।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে ভিন্নচিত্র। দেখা যাচ্ছে, একসময়ের গর্জনকারী নেতা রাস্তার পাশে চোরের মতো লুকিয়ে পড়েছেন। শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেন।

এই ঘটনার প্রেক্ষাপট আরও গভীর। কারণ, একই সময়ে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা। কাশ্মীর হামলার জবাবে মোদি সরকার সীমিত হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানে। এর মাঝেই শুভেন্দুর ‘২৬০ মুসলমানের দেহ’ মন্তব্য পরিস্থিতিকে আরও উসকে দিয়েছে। কূটনীতিকদের মতে, এই ধরনের বক্তব্য দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য গভীর হুমকি।

শুধু তাই নয়, শুভেন্দু অধিকারী সম্প্রতি বাংলাদেশকে টেনে এনেছেন তার রাজনৈতিক বক্তব্যে। এক জনসভায় তিনি বলেন, “বাংলাদেশ থেকে লোক এসে ভারতের ভোটনীতি পাল্টে দিচ্ছে।” এমন অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ না দিয়েই এই মন্তব্যকে কূটনৈতিক মহলে প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে উস্কানি হিসেবে দেখা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বক্তব্যগুলো শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ ভূরাজনীতিতে উত্তেজনা সৃষ্টির অপচেষ্টা। বিজেপির ভিতরেও এই মন্তব্য নিয়ে অসন্তোষ স্পষ্ট। কেউ কেউ বলছেন, দলের মধ্যেই শুভেন্দুর মত কট্টরপন্থী নেতাদের হঠানোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।

তবে গণধোলাই কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জন্য নেতাদের ওপর জনরোষ বা সহিংসতা সমর্থনযোগ্য নয়—এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এই ঘটনা কেবল জনবিক্ষোভ নয়, বরং ভারতীয় রাজনীতির ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এমন এক অদৃশ্য উত্তেজনা, যা দক্ষিণ এশিয়াকেও অস্থির করে তুলতে পারে।

বিশ্ব রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এখন বাংলাদেশও এক নতুন কৌশলী অবস্থানে। ড. ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার, চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক, ভারতের সঙ্গে ভিসা উত্তেজনা—সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় এক নতুন ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হচ্ছে।

এই পরিবর্তনের পটভূমিতে শুভেন্দু অধিকারীর মত নেতারা যেন কেবল বিগত যুগের ‘মাসল পলিটিক্স’-এর অবশিষ্ট চিহ্ন। এখন তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন তার মানসিক চিকিৎসা দরকার। কিন্তু চিকিৎসার চেয়ে বড় প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক: ভারত কি শুভেন্দুদের মত নেতাদের ব্যবহার করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে নিজেদের মত করে চালাতে চাইছে, নাকি এই গণধোলাই একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা?

উত্তর এখনই পাওয়া কঠিন। তবে রাজপথে ছিন্নভিন্ন শুভেন্দুর গাড়ি, প্রিজন ভ্যানের ছায়া আর পুলিশের নিস্পৃহ মুখ দেখে মনে হচ্ছে, শুরু হয়ে গেছে এক অদৃশ্য যুদ্ধ। যার ময়দান হয়তো কাশ্মীর নয়, নয় কোনো নির্দিষ্ট সীমান্ত—এই যুদ্ধ চলবে মনের ভিতরে, নীতির বুকে, রাষ্ট্রনীতির করিডরে।

ফরিদ 

×