ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

গাজায় জাতিসংঘের ৭৭টি খাদ্যবাহী ট্রাক লুট!কিছুই পৌঁছায়নি গন্তব্যে!

প্রকাশিত: ০০:২৮, ১ জুন ২০২৫

গাজায় জাতিসংঘের ৭৭টি খাদ্যবাহী ট্রাক লুট!কিছুই পৌঁছায়নি গন্তব্যে!

ইসরায়েল কর্তৃক মাসব্যাপী অবরোধ ও বিমান হামলার প্রেক্ষিতে চরম খাদ্যসংকটে পড়েছে গাজা উপত্যকার বাসিন্দারা। এমন এক সংকটময় পরিস্থিতিতে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) শনিবার জানিয়েছে, উপত্যকায় প্রবেশকারী কয়েক ডজন খাদ্যবাহী ট্রাক আটকিয়ে তা লুট করে নিচ্ছে ক্ষুধার্ত জনগণ।

সংস্থাটি জানিয়েছে, শুক্রবার ৭৭টি খাদ্য সহায়তাবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করে। এর বেশিরভাগেই ছিল ময়দা। গন্তব্যে পৌঁছার আগেই ক্ষুধার্ত জনগণ ট্রাকগুলো থামিয়ে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যায়।

প্রায় তিন মাসের অবরোধে গাজার জনগোষ্ঠী দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে কিছু সহায়তা প্রবেশ করতে পারলেও, তা মোটেও পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছে বিভিন্ন মানবিক সংস্থা।

এদিকে, শুক্রবার হামাস জানায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাবিত অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি পর্যালোচনা করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

হামাস ও মিসরীয় কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতির আওতায় ৬০ দিনের জন্য লড়াই বন্ধ থাকবে। এর বিনিময়ে গাজায় আটক থাকা ৫৮ জন জিম্মির মধ্যে কিছু সংখ্যককে মুক্তি দেওয়া হবে এবং বিপরীতে ফিলিস্তিনি বন্দি, খাদ্য ও জরুরি সহায়তা প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো গণমাধ্যমে নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে।

ডব্লিউএফপি জানিয়েছে, এখনো গাজায় দুর্ভিক্ষের ভয় প্রকট। সংস্থাটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, “পরবর্তী কয়েকদিন আমাদের গাজার জনগোষ্ঠীকে বিপুল খাদ্য সহায়তা দিতে হবে। এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভয় দূর হবে এবং তারা আস্থা ফিরে পাবে যে আরও সহায়তা আসছে।”

গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনুসে এক প্রত্যক্ষদর্শী অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে জানান, একত্রিত হাজারো মানুষ একটি অস্থায়ী ব্যারিকেডে ইউএন কনভয় থামিয়ে খাদ্যসামগ্রী লুট করে। অধিকাংশ মানুষ মাথায় বা পিঠে করে ময়দার বস্তা বহন করে নিয়ে যায়। এমনকি একটি ফর্কলিফট ব্যবহার করে ট্রাক থেকে প্যালেট নামাতেও দেখা গেছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে ওই ব্যক্তি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের বাধ্যবাধকতায় তারা রাফাহ ও খান ইউনুসের পূর্বাঞ্চলে সামরিক নিয়ন্ত্রিত অনিরাপদ পথ ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে, যেখানে সশস্ত্র গ্যাং সক্রিয়। এই এলাকায় ট্রাক থামিয়ে দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।এ বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এক অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রতিবেদন অনুযায়ী, মে মাসের শেষ তিন দিনে জাতিসংঘের চারটি স্থাপনা লুটপাটের শিকার হয়েছে। শনিবারের কনভয় হামলার ঘটনাটি এতে অন্তর্ভুক্ত নয়।

জাতিসংঘ বলছে, সংঘর্ষের কারণে তারা পর্যাপ্ত সহায়তা সরবরাহ করতে পারছে না। শুক্রবার জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টেফান ডুজারিক জানান, কেরেম শালোম সীমান্ত দিয়ে তারা মাত্র পাঁচটি ট্রাকের মাল উঠাতে পেরেছে। সংঘর্ষের কারণে বাকি ৬০টি ট্রাক ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

ইসরায়েলের এক কর্মকর্তা জানান, দেশটি জাতিসংঘকে লজিস্টিক ও পরিচালনায় সহায়তা দিয়েছে, তবে "জাতিসংঘ তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না।" তার বদলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে গঠিত নতুন সংস্থা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF) এই সপ্তাহে গাজায় কাজ শুরু করেছে। বিশৃঙ্খল পরিবেশে বিভিন্ন স্থানে খাদ্য বিতরণ করছে এই সংস্থা।

ইসরায়েলের দাবি, এই নতুন ব্যবস্থাপনা জরুরি হয়ে পড়েছে কারণ হামাস সহায়তার বড় একটি অংশ চুরি করে নিচ্ছে। যদিও জাতিসংঘ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

GHF সশস্ত্র ঠিকাদারদের সহায়তায় খাদ্য বিতরণ করছে। সংস্থাটি বলছে, নিরাপত্তার কারণে এটি জরুরি। তবে বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থা অভিযোগ করেছে, এই পদ্ধতি সহায়তাকে সামরিকীকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে, গাজাজুড়ে ইসরায়েলি সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৬০ জন নিহত হয়েছে। শনিবার ভোরে রাফাহ শহরে ইসরায়েলি গুলিতে তিনজন প্রাণ হারিয়েছে। গাজা শহরে এক পরিবারের সদস্য, মা-বাবা ও একটি শিশু গাড়িতে থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছে।

এই যুদ্ধ শুরু হয় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, যখন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে প্রায় ১,২০০ মানুষ হত্যা করে এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়। বর্তমানে ৫৮ জন জিম্মি গাজায় থাকলেও ইসরায়েল মনে করছে এদের মধ্যে ৩৫ জন ইতোমধ্যে মারা গেছে। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, কয়েকজন জিম্মির ভাগ্য সম্পর্কে “সন্দেহ” রয়েছে।
গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরু পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় ৫৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। যদিও এই হিসাব বেসামরিক ও যোদ্ধাদের মধ্যে পার্থক্য করে না।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর এখন গাজা পরিস্থিতির দিকে। একদিকে যুদ্ধবিরতির আলোচনা চলছে, অন্যদিকে মাঠে চলছে রক্তক্ষয় ও মানবিক বিপর্যয়। এই সংকট নিরসনে কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত উদ্যোগই পারে গাজার জনগণের পাশে দাঁড়াতে।


সূত্র:AP News

আফরোজা

×