
ছবি: সংগৃহীত।
আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে হিমালয়ের আরেকপ্রান্ত। অরুণাচল প্রদেশকে ঘিরে চীন ও ভারতের ভূরাজনৈতিক সংঘাত নতুন মাত্রা পেল বেইজিংয়ের সর্বশেষ পদক্ষেপে। চীনের বেসামরিক বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবার অরুণাচলের ২৭টি স্থানের নতুন নাম ঘোষণা করেছে। যার প্রতিবাদে ভারত কড়া ভাষায় বলেছে, “এই প্রচেষ্টা অকার্যকর ও হাস্যকর।”
চীনের এমন নামকরণ প্রচেষ্টা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই ধারা যত ঘন ঘন ঘটছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে— সীমান্তে শুধু সেনা নয়, চলছে ‘নামযুদ্ধ’ বা টপোনিমিক কূটনীতি।
১৪ মে (বুধবার) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন: “চীন বারবার অরুণাচল প্রদেশে নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন স্থানের নতুন নাম দিচ্ছে। আমরা স্পষ্টভাবে এই প্রচেষ্টা নাকচ করছি। অরুণাচল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, আছে এবং থাকবে।”
তিনি আরও বলেন, কৃত্রিম নামকরণ দিয়ে ভূ-বাস্তবতা পাল্টানো যায় না।
চীন অরুণাচল প্রদেশকে “জাংনান” বা “দক্ষিণ তিব্বত” বলে দাবি করে আসছে বহুদিন ধরে। এই দাবির পেছনে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক যুক্তির পাশাপাশি রয়েছে কৌশলগত স্বার্থও। নামকরণ পরিবর্তন চীনের "নেমিং সলিডারিটি স্ট্র্যাটেজি" বা "ভূখণ্ড দাবি প্রতিষ্ঠার সাংস্কৃতিক কৌশল" হিসেবে বিশ্লেষিত হচ্ছে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট অনুসারে, এবার যে ২৭টি স্থানের নতুন নাম দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে:
- ১৫টি পাহাড়
- ৫টি বসতি এলাকা
- ৪টি পাহাড়ি পথ বা গিরিপথ
- ২টি নদী
- ১টি হ্রদ
এই নামগুলো চীনা ভাষায় দেওয়া হয়েছে এবং তিব্বতি ঐতিহ্যের সূত্র ধরে সেগুলোকে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যেন অঞ্চলটি ‘ঐতিহাসিকভাবে চীনের অংশ’— এই বার্তা তুলে ধরা যায়।
২০১৭, ২০২১, ২০২৩, ২০২৪ ও সবশেষ গত ১১ মে অরুণাচলের কয়েকটি স্থানের নতুন নাম প্রকাশ করেছে বেইজিং।
প্রতিবারই ভারত এর কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে, কিন্তু চীনের প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এটি LAC (Line of Actual Control) সংলগ্ন এলাকাগুলোতে মনস্তাত্ত্বিক ও কূটনৈতিক চাপ তৈরির অংশ।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কোনো দেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে থাকা অঞ্চলের নাম পরিবর্তনের অধিকার শুধুই সেই দেশের। সেক্ষেত্রে ভারতের দাবি বৈধ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
কিন্তু চীন 'নাম দিয়ে দাবি প্রতিষ্ঠা' করতে চায়। এই কৌশল বিশ্বে নতুন নয়— রাশিয়া যেমন ইউক্রেনের অঞ্চলগুলোর নাম পাল্টাচ্ছে, ইসরায়েল যেমন পশ্চিম তীরে হিব্রু নাম বসাচ্ছে, তেমনি চীনও চাইছে তিব্বত ও অরুণাচলের ভূখণ্ডে নিজেদের চিহ্ন বসাতে।
কেন গুরুত্বপূর্ণ অরুণাচল?
ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব: অরুণাচল প্রদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বের ‘চিকেন নেক’-এর ওপর অবস্থিত। এখানকার পাহাড়ি পাসগুলো কৌশলগতভাবে সেনা চলাচলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তিব্বত সংযোগ: এই অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবে তিব্বতের সঙ্গে সাংস্কৃতিকভাবে যুক্ত, যেটা চীন নিজের দাবিকে শক্তিশালী করতে ব্যবহার করে।
গুপ্তচরগিরি ও অবকাঠামো যুদ্ধ: চীন এরইমধ্যে সীমান্তে অবকাঠামো নির্মাণ জোরদার করেছে। ভারতও পাল্টা সড়ক, সেনা ছাউনি ও নজরদারি বাড়িয়েছে।
চীন যতই নতুন নাম দিক না কেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং মাটির বাস্তবতায় অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অংশ। কিন্তু এই নাম যুদ্ধ ভবিষ্যতের সীমান্ত দ্বন্দ্বকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। একদিকে সেনা, অন্যদিকে মানচিত্র ও নাম— সীমান্ত এখন শুধু ভূখণ্ড নয়, তথ্য, প্রতীক ও প্রভাবের লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও রূপ নিয়েছে।
নুসরাত