ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

যে কোন সময় যে কোন পর্যায়ে সংলাপে প্রস্তুত উত্তর কোরিয়া

কোরীয় উপদ্বীপে ফের অস্থিরতা

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ২৬ মে ২০১৮

কোরীয় উপদ্বীপে ফের অস্থিরতা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং উনের সঙ্গে তার প্রস্তাবিত বৈঠক বাতিল করে দিলেও পিয়ংইয়ং শুক্রবার জানিয়েছে, তারা যে কোন সময় যে কোন পর্যায়ে কথা বলতে এখনও প্রস্তুত। বৃহস্পতিবার কিমের কাছে লেখা এক চিঠিতে ট্রাম্প বৈঠকটি বাতিল করার কথা জানান। কারণ হিসেবে তিনি উত্তর কোরীয় নেতার সম্প্রতি এক বিবৃতিতে তীব্র ক্ষোভ ও প্রকাশ্য শত্রুতার কথা উল্লেখ করেন। এই সিদ্ধান্তে কোরীয় উপদ্বীপে ফের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।- খবর এএফপি ও বিবিসির। ট্রাম্প-কিম বৈঠক বাতিল করে দেয়া সিদ্ধান্তের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় উত্তর কোরিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিম কাইই-গোয়ান রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম কোরিয়ান সেন্ট্রাল নিউজ এজেন্সিকে (কেসিএনএ) এক বিবৃতিতে জানান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণা অত্যন্ত দুঃখজনক। উত্তেজনা নিরসন ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে বিদ্যমান দূরত্ব কমাতে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে যে কোন সময় কথা বলতে পিয়ংইয়ং প্রস্তুত। শীর্ষ বৈঠক বাতিলে তার হঠাৎ একতরফা এ সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। আমরা অত্যন্ত দুঃখিতও। এ দিকে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়া উভয়পক্ষকেই শান্তি প্রক্রিয়া থেকে পিছিয়ে না আসতে অনুরোধ জানিয়েছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনও আশা প্রকাশ করেছেন যে, সংলাপ পুনরায় শুরু হবে এবং আলোচনাও শেষ পর্যন্ত হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তা পিয়ংইয়ং ধারাবাহিকভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে যাচ্ছিল অভিযোগ করে জানান, শীর্ষ বৈঠকের প্রস্তুতিতে সিঙ্গাপুরে মার্কিন ডেপুটি চীফ অব স্টাফকে পাঠানো হলেও উত্তর কোরিয়া তাদের প্রতিনিধিকে পাঠায়নি। প্রতিনিধি না থাকার বিষয়ে তারা কিছুই জানায়নি। শুধু আমাদেরকে অপেক্ষা করিয়েছে। ট্রাম্পের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে রিপাবলিকান পার্টির সিনেটর টম কটন বলেছেন, কিম জং উনের ভ-ামি দেখতে পেয়েছেন ট্রাম্প। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাট পার্টির সিনেটর ব্রায়ান স্কাটজ জানিয়েছেন, ট্রাম্পের মতো শিক্ষানবিশ যখন যুদ্ধবাজদের সঙ্গে জোড়া বাঁধে তখন এমনটা ঘটাই স্বাভাবিক। মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটিক নেতা ন্যান্সি পেলোসি ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের সমালোচনা করে বলেন, বৈঠকে তার প্রস্তুতির অভাব ছিল। যেজন্য তা ভেস্তে গেছে। এ ক্ষেত্রে কিম বিজয়ী হয়েছেন। এটা স্পষ্ট যে, কী হচ্ছে ট্রাম্প তার কিছুই জানত না। কিমকে লেখা ব্যক্তিগত চিঠিতে ট্রাম্প বলেন, আপনার সঙ্গে বৈঠক করতে খুবই উদগ্রীব ছিলাম। যদিও দুঃখজনক যে আপনার সাম্প্রতিক বিবৃতিতে তীব্র ক্ষোভ ও প্রকাশ্য শত্রুতা প্রকাশিত হওয়ায় আমি মনে করছি, এই সময়ে দীর্ঘ পরিকল্পিত এই বৈঠক সঠিক হবে না। ট্রাম্পের ঘোষণার পর হোয়াইট হাউসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, উত্তর কোরিয়ার দিক থেকে সদিচ্ছার অভাব প্রতীয়মান হওয়ার পরপরই তারা ১২ জুনের বৈঠকের পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইনের সঙ্গে কথা বলার পর কিমকে লেখা চিঠির প্রতিটি শব্দ ট্রাম্পই ঠিক করে দিয়েছেন। যদিও বিভ্রান্ত মুন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ট্রাম্প-কিম প্রস্তাবিত বৈঠক না হওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। দক্ষিণ কোরিয়াকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পিয়ংইয়ং তাদের পুঙ্গি-রি পারমাণবিক কেন্দ্র ভেঙ্গে ফেলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বৈঠক বাতিলের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। পারমাণবিক কেন্দ্রটি ধ্বংস করার পর তা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের যাচাই করতে দেয়া হয়নি। কেন্দ্রটি চীন সীমান্তের কাছে পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত। বিশেষজ্ঞরা বৈঠক বাতিল করায় খারাপ প্রভাব পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন। মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক আব্রাহাম ডেনমার্ক টুইটারে জানান, সিদ্ধান্তে দক্ষিণ কোরিয়াও ক্ষুব্ধ হতে পারে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, সিউল পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রাখবে। এমনকি যদি তা ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কে কোন চিড় ধরে তারপরও। রাজনৈতিকভাবে ট্রাম্প পরিকল্পিত বৈঠক সম্পর্কে আশাবাদী ছিলেন। তবে তারিখ যতই এগিয়ে আসছিল ততই উভয়পক্ষের দিক থেকে প্রত্যাশা ঘোলাজলের আবর্তে পতিত হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছিল যে, উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কর্মসূচীকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করুক। পিয়ংইয়ং চাচ্ছিল তারা মার্কিন আগ্রাসন থেকে পুরোপুরি নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত তাদের পারমাণবিক কর্মসূচী প্রত্যাহার করবে না। মে মাসের মাঝামাঝি দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়া নিয়ে পিয়ংইয়ংয়ের তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের ক্ষেত্রে লিবিয়া মডেল অনুসরণ করা হতে পারে এমনটা বললে বৈঠক নিয়ে অনিশ্চয়তা শুরু হয়। ২০০৩ সালে লিবিয়া পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচী ত্যাগ করার অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কও পুনঃস্থাপিত হয়। এর আট বছর পর ন্যাটো সমর্থিত বিদ্রোহী ও আধা-সামরিক বাহিনী হাতে ক্ষমতাচ্যুত হন কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি। ন্যাটো সমর্থিত বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ার পর তাকে নির্মমভাবে হত্যাও করা হয়। বোল্টানের দেয়া লিবিয়া মডেলের উদাহরণ উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিমকে আতঙ্কিত করতে পারে বলে তখনই ধারণা করেছিলেন পর্যবেক্ষকরা। পিয়ংইয়ং বোল্টনের মন্তব্যের কঠোর প্রতিক্রিয়া জানালে পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে ‘লিবিয়া মডেল’ অনুসরণের কথা ভাবছেন না তারা। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স একই প্রসঙ্গের অবতারণা করে বলেন, উত্তর কোরিয়ার পরিণতি সম্ভবত লিবিয়ার মতই ঘটবে। যার প্রতিক্রিয়ায় উত্তরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক উপমন্ত্রী পেন্সের মন্তব্যকে কা-জ্ঞানহীন বলে অভিহিত করেন। কূটনৈতিক তৎপরতা ব্যর্থ হলে পারমাণবিক অস্ত্র প্রদর্শনী শুরু হয়ে যেতে পারে বলেও সতর্ক করেন তিনি। এর পরপরই কিমকে চিঠি লিখে বৈঠক বাতিলের কথা জানান ট্রাম্প। কয়েক দশক ধরে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইনের সঙ্গে উত্তরের শীর্ষ নেতা কিম জং উনের বৈঠকের পর কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি ফেরার আশা করা হচ্ছিল। বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে কোরীয় উপদ্বীপকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করতে একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন দুই নেতা। ওই বৈঠকের ধারাবাহিকতায় কিম ও ট্রাম্পের সম্ভাব্য বৈঠকে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে আলোচনা হবে বলে আশা করেছিলেন পর্যবেক্ষকরা। পিয়ংইয়ং অবশ্য একতরফা কেবল নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র বিসর্জন দেয়া হবে না বলে জোর দিয়ে আসছিল। এ মাসের শুরুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও’র উত্তর কোরিয়া সফরের পরপরই কিমের সঙ্গে বৈঠকের তারিখ ও স্থান নির্ধারিত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। সিঙ্গাপুরে প্রস্তাবিত ১২ জুনের ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে তা হতো দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে উত্তরের কোন শীর্ষ নেতার প্রথম মুখোমুখি বৈঠক।
×