রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অপ্রত্যাশিতভাবে সিরিয়ায় রুশ সামরিক অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করে সেখান থেকে রুশ বাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সিরিয়ায় রুশ বাহিনীর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। পুতিনের বক্তব্য থেকে মনে হয় যে সিরিয়ায় যুদ্ধবিরতি ও জেনেভায় শান্তি আলোচনা শুরু হওয়া এগুলো সবই তার কৃতিত্ব। আর ওদিকে স্বদেশে পুতিন যা চেয়েছিলেন তাই হয়েছে। রুশ জনগণ মনে করছে রাশিয়া সিরিয়ায় বিশাল বিজয় অর্জন করছে। তাদের দেশটি আগের মত এক মহাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
কিন্তু সত্যিই কি সিরিয়ায় রুশ পরিকল্পনা জয়যুক্ত হয়েছে? একটু নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করলে রাশিয়ার এই সাফল্য দাবিকে ফাপা ও অন্তরারশূন্য দেখার। কারণ সিরিয়ায় আইএস মোটেও নিশ্চিহ্ন হয়নি বরং যথেষ্ট শক্তি নিয়ে এখনও রয়ে গেছে। যুদ্ধ বিরতির নামে শান্তি যেটুকু বিরাজ করছে তা যথেষ্ট ভঙ্গুর ও নাজুক এবং জেনেভায় সিরিয়া সংকট আলোচনায় কতটুকু কি অগ্রগতি ঘটবে তা নিয়ে আশাবাদীদের মধ্যেও যথেষ্ট সদশয় সন্দেহ বিদ্যমান। তারপরও রাশিয়ার মিডিয়ায় রুশ সাফল্যের কাহিনী ও পুতিন বন্দান পরিবেশিত হচ্ছে।
পুতিন সিরিয়ায় কি চেয়েছিলেন? বাশার সরকারকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করাই কি শুধু তার উদ্দেশ্য ছিল, নাকি উদ্দেশ্য ছিল এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় সামরিক সংকটের সমাধান করা? কোনটাই নয়, পুতিন সিরিয়া অভিযানের মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্যকে এই সত্যটি মেনে নিতে বাধ্য করতে চেয়েছিলেন যে রাশিয়া এখন এক বিশ্বশক্তি- দাবার বোর্ডের অপর প্রান্তের কুশীলন। সিরিয়ায় কি অর্জিত হল না হল তার চাইতে মহাশক্তি হিসেবে নিজেকে জাহির করার প্রক্রিয়াটি চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশে বিদেশে রাশিয়ার এই মহাশক্তির ভাবমুর্তি তুলে ধরতে পারা পুতিনের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যও প্রয়োজন। পরাক্রম ও শক্তি সামর্থ্যরে বিচারে দেশটি এখন আমেরিকার সামন এমন ধারণা পেলে রুশ জনগণের মধ্যে একটা জাতীয় অহংকার গড়ে উঠার এবং ভাববে পুতিনের নেতৃত্বের বদৌলতেই এটা সম্ভব হয়েছে। কারণ ইউক্রেন সংকটের সময় পুতিন অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি রাশিয়ার —- গৌরব ও পূর্বের মর্যাদা ফিরিয়ে আনবেন। পুতিনের ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার জন্য জনগণের এই জাতীয় অহংকারের নেশায় মেতে থাকা প্রয়োজন।
পুতিন প্রথম যখন প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তখন রাশিয়ার অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় ছিল না। বরং ২০০০ সালের পর থেকে তেলের ক্রমাগত মূল্যবুদ্ধির বদৌলতে ফাকতালে রাশিয়ার তেল থেকে ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রাপ্তিযোগ হয়েছিল। তা দিয়ে পুতিন ইচ্ছামত খরচ করতে পেরেছিলেন। এরপর থেকে তেলের দরপতন হয়। এমন রাশিয়ার তেল রাজস্ব তিন-চতুর্থাংশ কমে গেছে। রাশিয়ার তহবিলে টান পড়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুঁতিনের প্রথম দুটি মেয়াদে (২০০০ থেকে ২০০৮) রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল। তৃতীয় মেয়াদটি ২০১২ সালে যখন শুরু হয় তখন এ দুটোর কোনটাই ছিল না। বরং অর্থনীতির ক্রমঅবনতি ঘটছিল। গত বছর অর্থনীতির সংকোচন ঘটে ৪ শতাংশ। তার আগেই অর্থনৈতিক চাপে পিষ্ট হয়ে জনমনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জমা হচ্ছিল। পুতিনের শাসন বৈধতার সংকটে পড়েছিল। এ সময়ই শাপে বরের মত সৃষ্টি হয় ইউক্রেন সংকট। রাশিয়া ক্রিমিয়াকে গ্রাস করে নেয়। ্িউক্রেনে হস্তক্ষেপ করতে থাকে। সমস্যা ভারাক্রান্ত রুশ জনগণের দৃষ্টি সেদিকে চলে যায়। জনমতকে পক্ষে টেনে আনার জন্য পুতিন তাদেরকে হারানো গৌরব পুনপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাতে থাকেন। জনমত তার দিকে ঝুঁকে পড়ে। রুশ জাতির অহংকারবোধে অন্ধ জনগণের কাছে পুতিনের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। পরিস্থিতি তার অনুকূলে চলে আসে।
এদিকে ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য পাশ্চাত্য অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে বসে। একদিকে তেলের দরপতন অন্যদিকে পাশ্চাত্যের অবরোধ- এই দুইসের মিলিত প্রভাবে রুশ অর্থনীতি আরও তীব্র চাপের মুখে পড়ে। রুশদের অবস্থা আরও কাহিল হয়। তাদের জীবনযাত্রার মান হ্রাস পায় এবং এখনও পেয়ে চলেছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে রুশদের গড় বেতন ছিল ৮৫০ ডলার। এক বছর পরই তা ৪৫০ ডলারে নেমে আসে। এই সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাত সরানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে পুতিনের। সিরিয়া সংকট তাকে আপাতত। সংকী থেকে পবিত্রাণের পথ করে দেয়। ইউক্রেন ও রাশিয়া এই দুই জায়গায় হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে পুতিন বাহ্যত দেখাতে চেয়েছেন যে রাশিয়া তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকার সমান। মিডিয়ার প্রচারণার বদৌলতে রুশ জনগণও সেটা ভালমতই গিলেছে। তাদের কাছে পুতিনের জনপ্রিয়তার বেটিং এখন ৮০ শতাংশ কি তারও বেশি। সিরিয়ায় সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে রাশিয়া শুধু বাসার সরকারের পতনই ঠেকায়নি। আরও একটা কাজ করেছে। উদ্বাস্তুদেরকে তার শত্রু ইউরোপীয় দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিয়ে তাদের জন্য নতুন এক সংকট তৈরি করেছে এবং এইভাবে উদ্বাস্তদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। পুতিন স্পষ্টতই রাশিয়াকে ন্যাটোর এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চান। তবে তার চূড়ান্ত লক্ষ্য ন্যাটোর সঙ্গে পুরোদস্তুর যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া নয়। বরং অপেক্ষাকৃত ছোটখাট সংঘর্ষে জড়ানো। জার্জিয়া তাকে প্রথমে সেই সুযোগ দিয়েছে। তারপর ইউক্রেন ও ক্রিমিয়া এবং অবশেষে সিরিয়া। পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের কর্নধার পুতিন যে নিজে দেশকে পুরাতন সোভিয়েত প্রভাব বলয়েল ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
সূত্র : দি ইকনোমিস্ট
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: