
ছবি:সংগৃহীত
অশ্বগন্ধা – আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় শত শত বছর ধরে ব্যবহৃত একটি গাছের শিকড়, যা বর্তমানে স্ট্রেস কমানো, ঘুম ভালো করা, কর্মক্ষমতা বাড়ানো এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি বর্তমানে গামি, ক্যাপসুল, চা ও পাউডারের আকারে পাওয়া যায়।
কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এই ‘প্রাকৃতিক’ উপাদানটিই কিছু মানুষের ক্ষেত্রে মারাত্মক লিভার সমস্যার কারণ হতে পারে।
কি বলছে গবেষণা?
আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের (NIH) পরিচালিত ডাটাবেজ 'লিভারটক্স'-এ জানা গেছে, অশ্বগন্ধা খাওয়ার ২ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে কারও কারও শরীরে লিভার ক্ষতির লক্ষণ দেখা গেছে। লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- ত্বক ও চোখ হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস),
- গা চুলকানো,
- গা ম্যাজম্যাজে ভাব বা অবসন্নতা,
- প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হয়ে যাওয়া।
২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তত ২৩ জন রোগীর লিভারে অশ্বগন্ধা খাওয়ার পর সমস্যা দেখা দিয়েছিল—এবং তাদের মধ্যে ৮ জন কেবলমাত্র অশ্বগন্ধা খেয়েছিলেন, অন্য কিছু নয়। বেশিরভাগই সুস্থ হয়ে উঠলেও ৩ জন, যাদের আগে থেকেই লিভারের সমস্যা ছিল, মারা যান।
এর পেছনে কারণ কী হতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, অশ্বগন্ধায় থাকা একধরনের যৌগ—উইথানোলাইডস (বিশেষ করে উইথানোন) হয়তো লিভারের ‘ডিটক্স সিস্টেম’-এ ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। দীর্ঘদিন বা উচ্চমাত্রায় ব্যবহারে এটি লিভারের গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গ্লুটাথায়নের কার্যকারিতা নষ্ট করতে পারে।
এই সমস্যাটি শুধু ভারতে নয়—আইসল্যান্ড, ইউরোপ ও আমেরিকাতেও রিপোর্ট করা হয়েছে। ইউরোপের কয়েকটি স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যে ২২টি গুরুতর লিভার ইনজুরির রিপোর্ট নিশ্চিত করেছে, যার মধ্যে একজনকে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাতে হয়।
লিভার টক্সিসিটি বলতে কী বোঝায়?
লিভার টক্সিসিটি হলো এমন একটি অবস্থা, যখন লিভার অতিরিক্ত চাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের শরীরের ডিটক্স সেন্টার হিসেবে কাজ করে লিভার—অ্যালকোহল, ওষুধ, ফাস্ট ফুডের রাসায়নিক, এমনকি হারবাল সাপ্লিমেন্টও পরিশোধন করে। কিন্তু যখন এই পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন লিভার দুর্বল হয়ে পড়ে।
লিভার টক্সিসিটির লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে—
- অতিরিক্ত ক্লান্তি,
- জন্ডিস,
- পেট ব্যথা বা অস্বস্তি,
- রুচিহীনতা,
- প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হওয়া,
- ত্বকে চুলকানি।
ভালো খবর হলো, অনেক সময় লিভার নিজে নিজে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে—যদি সময়মতো সমস্যা ধরা পড়ে।
তাহলে কি এখন থেকেই অশ্বগন্ধা ছেড়ে দিতে হবে?
না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ অশ্বগন্ধা ব্যবহার করেন এবং তাদের কোনো সমস্যা হয় না। ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী শুধুমাত্র আমেরিকাতেই প্রায় ১০ লাখ মানুষ এটি নিয়মিত ব্যবহার করছেন—তবে রিপোর্ট করা ২৩টি কেস এক শতাংশের অনেক কম।
তবে এটা মনে রাখা জরুরি, প্রাকৃতিক মানেই নিরাপদ নয়। সবকিছুরই মাত্রা থাকা জরুরি।
আপনি কী করবেন? জেনে নিন কিছু পরামর্শ—
- মাত্রা মেনে চলুন: অধিকাংশ গবেষণায় দিনে ১৫০–৬০০ মি.গ্রা. পর্যন্ত নিরাপদ বলা হয়েছে। এর চেয়ে বেশি নেওয়া বিপজ্জনক হতে পারে।
- লিভারের সমস্যা থাকলে এড়িয়ে চলুন: আগে থেকেই যাদের লিভার সমস্যা রয়েছে, তারা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অশ্বগন্ধা ব্যবহার করবেন না।
- অন্য ওষুধ বা সাপ্লিমেন্টের সঙ্গে না মেশান: একাধিক লিভার-প্রভাবিত সাপ্লিমেন্ট একসাথে খাওয়া বিপজ্জনক।
- নিজের শরীরের কথা শুনুন: কোনো রকম অস্বাভাবিক ক্লান্তি, চুলকানি, জন্ডিস, বমিভাব দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- রক্ত পরীক্ষা করান: দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে লিভার ফাংশন টেস্ট করানো ভালো।
অশ্বগন্ধা সত্যিই কার্যকরী একটি হার্ব, কিন্তু তা ব্যবহার করার আগে আপনাকে জানতে হবে—আপনার শরীর কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়। যতই এটি প্রাকৃতিক হোক না কেন, সচেতনতা আর সীমাবদ্ধতার অভাবেই সমস্যা দেখা দেয়।
"হারবাল" মানেই নিরাপদ নয়—শুধু সচেতন ব্যবহারেই সুস্থ থাকা সম্ভব।
মারিয়া