ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নারী-পুরুষের যেসব রোগের চিকিৎসায় অবহেলা নয়

ডা. জাহেদ পারভেজ

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ৩১ অক্টোবর ২০২২

নারী-পুরুষের যেসব রোগের চিকিৎসায় অবহেলা নয়

.

নানা জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া পুরুষের যৌনাঙ্গসহ বিভিন্ন গ্রন্থি, যেমন- প্রোস্টেট গ্রন্থি, শুক্রনালি, এপিডিডাইমিসকে আক্রমণ করে তীব্র প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এমনই রোগের নাম গনোরিয়া, ক্লামাইডিয়া ইত্যাদি কিছু জটিল রোগ। গনোরিয়া দেশের স্বল্পশিক্ষিতদের মধ্যে ‘প্রমেহ’ নামে পরিচিত। আসলে এটি একটি জীবাণুবাহিত রোগ। নিসেরিয়া গনোরি নামক জীবাণুর কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। যৌন সংসর্গের কারণে এ রোগ বেশি ছড়ায়। পৃথিবীজুড়ে এ রোগটির বিস্তৃতি যৌন রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
যেভাবে ছড়ায়
রোগাক্রান্ত সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে দৈহিক মিলনের পর ৩ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এ রোগের প্রকাশ ঘটে। রোগের আক্রমণ স্থল পুরুষের ক্ষেত্রে মূত্রপথের সামনের অংশে জীবাণু সংক্রমণ শুরু করে এবং উপযুক্ত চিকিৎসা না হলে তা প্রস্টেট গ্রন্থি, এমনকি মূত্রথলি, উপান্ত বা শুক্রাশয় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
পুরুষের ক্ষেত্রে উপসর্গ
পুরুষের যৌনাঙ্গ বিভিন্ন গ্রন্থি প্রস্টেট গ্রন্থি, শুক্রনালি, এপিডাইডাইমিস আক্রমণ করে তীব্র প্রদাহ সৃষ্টি করে। এর দুই-একদিন পর প্রচুর পরিমাণ, ঘন সাদা বা সামান্য হলদে রঙের পুঁজ পড়তে শুরু করে। প্রস্রাব করতে তীব্র জ্বালা অনুভূত হয়। পুরুষাঙ্গের মাথায় পুঁজ জাতীয় পদার্থ লেগে থাকতে দেখা যায়। এ রোগে পুরুষাঙ্গের গায়ে কোনো রকম ঘা বা ক্ষত লক্ষ্য করা যায় না। হাত দিয়ে ধরলে হালকা ব্যথা অনুভূত হয়। কিছুদিন পর রোগের উপসর্গ আরও কমে যায়। তার মানে কিন্তু রোগটি ভালো হওয়া নয়; বরং রোগটি দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিকরূপ লাভ করে বলে ধরে নিতে হবে।
পুরুষের ক্ষেত্রে জটিলতা
শুক্রনালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, উপ-শুক্রাশয় (এপিডাইডাইমিস) নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে যৌনরসে বির্যকোষ থাকে না। ফলে ওই ব্যক্তি সন্তানের বাবা হতে পারে না। রোগটি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ফলে সে যার সঙ্গে দৈহিক মেলামেশা করবেন, সেই এই রোগে আক্রান্ত হবেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার ফলে প্রস্টেট গ্রন্থির প্রদাহ হতে পারে। ফলে প্রস্রাব আটকে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়।
নারীর ক্ষেত্রে উপসর্গ
আক্রান্ত হওয়ার পর যোনিপথের গ্রন্থি, বিশেষ করে জরায়ুর মুখের গ্রন্থিগুলো এ জীবাণু আক্রমণ করে থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে ডিম্বনালি আক্রমণ করে। যোনিপথের ঠিক সামনেই রয়েছে মূত্রপথ। সেখানেও আক্রমণ ঘটতে পারে। ফলে যোনিপথ ও মূত্রপথ উভয়ই আক্রান্ত হয় এবং অল্প বা অধিক পরিমাণে পুঁজ বের হতে দেখা যায়। প্রস্রাবে তীব্র ব্যথা, জ্বালা দেখা দেয়, পুঁজ নিঃসরণ হতে দেখা যায়। আবার ডিম্বনালি দিয়ে জীবাণু দেহের গভীরে প্রবেশ করতে পারে।
নারীর ক্ষেত্রে জটিলতা
দীর্ঘদিন আক্রান্ত থাকলে ডিম্বনালির ছিদ্রপথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে ভবিষ্যতে তার সন্তান হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে যেতে পারে। প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া, ব্যথা ছাড়াও মূত্রাশয়ের প্রদাহ হতে পারে। আক্রান্ত নারী সন্তান প্রসব করলে সন্তানের চোখ এ জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হতে পারে। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই হাঁটু বা গোড়ালিতে পুঁজ জমে গিরা ফুলে যেতে পারে এবং বাত ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
প্রতিরোধ করবেন যেভাবে
১. জনসাধারণকে যৌন রোগের কুফল সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এ ছাড়া প্রয়োজন উপযুক্ত যৌনশিক্ষার প্রচলন।
২. পতিতালয় বা বহুনারী গমনে নিরুৎসাহিত করতে হবে। কারণ বেশিরভাগ নারীরই এ রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না। তাই যে কোনো সময়ে এদের মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৩. রোগের লক্ষণ দেখামাত্রই চিকিৎসা করানো উচিত।
৪. আক্রান্ত অবস্থায় স্ত্রী মিলনের বা স্বামী সহবাসে বিরত থাকা উচিত। নইলে তারাও আক্রান্ত হতে পারেন।
৫. সর্বোপরি ধর্মীয় অনুষঙ্গ মেনে জীবন যাপন ও বিবাহিত যৌনজীবন সবার জন্যই বিভিন্ন যৌনরোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র পথ। তাই সচেতনতা ও চিকিৎসা জরুরি। এছাড়াও অপর রোগই খুব স্পর্শ কাতর।
যেসব রোগ পুষিয়ে রাখলেই বিপদ
আরেকটি রোগ ক্লামাইডিয়া,
অনেক পুরুষই ক্লামাইডিয়া রোগে আক্রান্ত হন। এটি অতি সাধারণ একটি যৌনবাহিত সংক্রমণ। অনেকে হয়তো জানেনই না, তাদের ক্লামাইডিয়া সংক্রমণ রয়েছে। কারণ এ রোগে তেমন উপসর্গ অনুভূত হয় না। যা-ই হোক, ক্লামাইডিয়া যৌনসঙ্গিনীকেও সংক্রমিত করতে পারে। জটিলতার শিকার হতে পারে নবজাতক শিশুও।
যেভাবে সংক্রমণ ঘটে
যে জীবাণুটি সংক্রমণ ঘটায়, এর নাম ক্লামাইডিয়া ট্রাকোমাটিস। এ জীবাণু ব্যাকটেরিয়ার মতো একই ধরনের। সংক্রমণ সাধারণত যৌনসঙ্গমের সময় একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে ছড়ায়। এগুলো অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য পায়ু এলাকায়ও হতে পারে। পুরুষের ক্ষেত্রে ক্লামাইডিয়া সাধারণত মূত্রনালিকে সংক্রমিত করে। মূত্রনালি হচ্ছে একটা নল, যা পুরুষাঙ্গের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে। মূত্রনালির মধ্য দিয়ে প্রস্রাব ও যৌনরস (বীর্য) বেরিয়ে যায়। ক্লামাইডিয়া এপিডিডাইমিস কিংবা প্রস্টেট গ্রন্থি সংক্রমিত করতে পারে। এপিডিডাইমিস হলো একটি ছোট গ্রন্থি, যা অ-কোষের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। এটা শুক্রাণু উৎপাদনে কাজ করে। প্রস্টেট গ্রন্থি থাকে পুরুষাঙ্গের গোড়ায়। এটা শুক্রাণুর জন্য পুষ্টি উপাদান তৈরি করে। পায়ুপথে সঙ্গম করলে মলদ্বার সংক্রমিত হতে পারে।
রোগের উপসর্গ
সচরাচর কোনো উপসর্গ থাকে না। যদি মূত্রনালি সংক্রমিত হয়, তাহলে যেসব উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে তা হলো পুরুষাঙ্গের মাথা থেকে রস নিসৃত হওয়া, প্রস্রাব করার সময় ব্যথা বা জ্বালাপোড়া করা, এপিডিডাইমিস সংক্রমিত হলে অ-কোষে ব্যথা অনুভূত হওয়া, প্রস্টেট গ্রন্থি সংক্রমিত হলে মূত্রনালি থেকে নিঃসরণ বা প্রস্রাব করার সময় কিংবা প্রস্রাব করার পর ব্যথা অথবা জ্বালাপোড়া করা বা অস্বস্তিবোধ করা অথবা যৌনসঙ্গমের সময় বা পরে ব্যথা করা বা পিঠের নি¤œভাগে কিংবা কোমরে ব্যথা করে। কখনো কখনো প্রস্টেট কিংবা এপিডিডাইমিসের সংক্রমণ হঠাৎ তীব্র হয়। এ ধরনের সংক্রমণের ফলে জ্বর হয় অথবা অসুস্থতার অন্য লক্ষণগুলো দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। পায়ুপথ সংক্রমিত হলে পায়ুপথের চারপাশে জ্বালাপোড়া করা বা পায়খানা করার সময় ব্যথা করে।
রোগ নির্ণয়
চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি রোগটি শনাক্ত করতে পারবেন। মূত্রনালির সংক্রমণ নির্ণয়ে মূত্রনালির মুখের নিঃসরণ পরীক্ষা করা হয়। এ ক্ষেত্রে পুরুষাঙ্গের মাথায় মূত্রনালির মুখে একটা সরু সোয়াব ঢোকানো হয়। ক্লামাইডিয়ার জন্য প্রস্রাব পরীক্ষাও করানো হতে পারে। যদি পায়ুপথে উপসর্গ থাকে, তাহলে পায়ুপথের নিঃসরণ পরীক্ষা করাতে হবে। এর পরই বোঝা যাবে সংক্রমণের ধরন এবং কোনো অ্যান্টিবায়োটিক সবচেয়ে ভালো কাজ করবে, তাও নির্ণয় করা সম্ভব হবে। তবে সচরাচর এপিডিডাইমিস ও প্রস্টেট গ্রন্থির সংক্রমণের জন্য দায়ী জীবাণুকে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
চিকিৎসা
সাধারণ সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে সংক্রমণ সেরে যায়। বেশির ভাগ মূত্রনালির সংক্রমণে সাত দিন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের প্রয়োজন হয়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খেতে হবে।
লেখক :  চর্ম, যৌন ও অ্যালার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ,
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল
চেম্বার : ডা. জাহেদস হেয়ার অ্যান্ড স্কিনিক সেন্টার,
সাবামুন টাওয়ার (৬ তলা) পান্থপথ মোড়, ঢাকা।
০১৭০৭-০১১-২০০, ০১৭১৫ -০৫০-৯৪৯

×