ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

লালনের গানের সুরে মানবিক সমাজ গড়ার প্রত্যয়

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ২ মে ২০২৪

লালনের গানের সুরে মানবিক সমাজ গড়ার প্রত্যয়

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লালন সংগীতের আসরে গাইছেন নবনীতা চৌধুরী

সম্প্রীতির এই দেশ বাংলাদেশ। তবে ধর্ম-বর্ণ কিংবা গোত্রীয় পরিচয় ছাপিয়ে মানবিক সমাজের সেই প্রত্যাশা বারবার ব্যাহত হচ্ছে।  বিভেদের বেড়াজাল  তৈরি করে  সৌহার্দ ও সম্প্রীতি বিনষ্টে তৎপার এই অপশক্তি। মানুষে মানুষে বিভেদের বীজ বুনে  চালিয়ে যাচ্ছে অপতৎপরতা। আর মানবিক সমাজ  বিনির্মাণবিরোধী সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সুরে সুরে জানানো হলো প্রতিবাদ। গানে গানে উচ্চারিত হলো সম্প্রীতি ও মানবিক সমাজ গড়ার প্রত্যয়।

আর সুরাশ্রিত সেই মানবিকতার আবাহনে আশ্রয় করা হলো ফকির লালন সাঁইয়ের গীতবাণীকে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হলো এই  সংগীতাসর। প্রখ্যাত থেকে নবীন-প্রবীণ শিল্পীরা গান গেয়েছেন এই সংগীতায়োজনে। তাদের সুরাশ্রিত কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে  লালনের দর্শনে উদ্দীপ্ত  মানবতার জয়গান। সঙ্গে ছিল ভাববাদ ও  আধ্যাত্মবাদী চেতনাশ্রয়ী গানের পরিবেশনা। সংীতানুষ্ঠানটির আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। 

পরিবেশনা পর্বে লালনের মানবতাবাদী দর্শনকে কণ্ঠে তুলে নেন নবনীতা চৌধুরী। গেয়ে শোনানÑ  শোনায়ে লাভের বুলি/নেবে না কেউ কাঁধের ঝুলি/ইতর আশরাফ বলি/দূরে  ঠেলে নাহি দেবে/এমন মানবসমাজ কবে গো সৃজন হবে ...। এছাড়া এই শিল্পী শুনিয়েছেন ‘মাওলা বলে ডাক রসনা’ ও ‘এমন মানব জনম আর কি হবে’ শিরোনামের গান। আসিফ ইকবাল সৌরভ পরিবেশন করেন ‘এসব দেখি কানার হাট বাজার’ ও ‘এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নেরে মন’ শীর্ষক সংগীত। মনিকা দেওয়ানের গাওয়া গানের শিরোনাম ছিল ‘পাপীর ভাগ্যে এমনকি আর দিন হবে’ ও ‘যেখানে সাঁইর বারামখানা’।  

এ ছাড়া  গান শুনিয়ে শ্রোতার হৃদয় রাঙান ফরিদা পারভীন, চন্দনা মজুমদার, ফকির শাহবুদ্দিন, অনিমা মুক্তি গোমেজ, দিল আফরোজ  রেবা, লাভলী দেব, পল্লবী সরকার, আবু বকর সিদ্দিকী, আয়নাল হক, খগেন্দ্রনাথ বৈরাগী,  দোয়েল রাজা, সরদার হিরক রাজা, রাফিয়া রুনা, লামিয়া ঐশ্বর্য ও তামান্না নিগার তুলি।
পরিবেশনার ফাঁকে ছিল কথন পর্ব।  সে আলোচনায় অংশ নেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও গবেষক মফিদুল হক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ প্রমুখ। 
আলোচনায় বক্তারা বলেন, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিতে   যে বাউল দর্শন, লালন সাঁইজি সেই দর্শনের কথা বলে গেছেন। জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি মানুষকে, মানবতাকে সর্বাগ্রে  দেখেছেন।

ভাতৃত্ব আর ঐক্যের বন্ধনে একে-অন্যকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাবে এই ছিলো তার দর্শনের মূলবাণী।  সেই অর্থে  মানবতাই হচ্ছে লালন দর্শনের মূল মর্মবাণী। কিন্তু সেই মানবতার বাণীকে বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে ধর্মের লেবাশধারী অশুভ শক্তি। এই মানবতাবিরোধী শক্তি মানুষকে নানাভাবে বিভাজিত করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায়। তারা লালনের মতো সাধককেও নানাভাবে বিতর্কিত করতে চায়। তারা কখনো সংগীতের বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলে আবার কখনো বাউল শিল্পীদের ওপর হামলা চালায়।  

পাশাপাশি তারা বাউলদের আস্তানা  ভেঙে দিচ্ছে, লালনের গান নিয়ে অপপ্রচার করছে। এমন বাস্তবতায়  মানবতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে লালনের গানই আমাদের প্রতিবাদের হাতিয়ার। কারণ, লালন আমাদের অস্তিত্বের অংশ,  প্রেরণা ও ঐক্যের প্রতীক। লালনের গান গাওয়ার মাধ্যমে আমরা নিজেদের যেমন শুদ্ধ করব,  তেমনি নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করব। একতাবদ্ধ হয়ে আমরা আমাদের এ  দেশ গড়ে তুলব। অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে মানবহিতৈষী সমাজ গড়ব।

×