ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

১০৯টি সামুদ্রিক প্রজাতির অভিবাসী পথচলা তুলে ধরল যে নতুন মানচিত্র

প্রকাশিত: ১৭:০২, ৩ জুন ২০২৫

১০৯টি সামুদ্রিক প্রজাতির অভিবাসী পথচলা তুলে ধরল যে নতুন মানচিত্র

ছবি: সংগৃহীত।

পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠ আমাদের চোখে বিস্তীর্ণ জলের সমাহার হলেও, কচ্ছপ বা তিমি হাঙরের মতো প্রাণীদের কাছে এটি এক বিশাল সড়কপথ। সেই অদৃশ্য জলপথগুলো এখন দৃশ্যমান হলো এক নতুন ইন্টারঅ্যাকটিভ মানচিত্রের মাধ্যমে।

অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি Migratory Connectivity in the Ocean (MiCO) নামের একটি ইন্টারঅ্যাকটিভ মানচিত্র প্রকাশ করেছেন, যেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে ১০৯টি সামুদ্রিক অভিবাসী প্রজাতি প্রতিবছর আন্তর্জাতিক জলসীমা অতিক্রম করে নির্দিষ্ট পথ ধরে চলাফেরা করে।

এই জলীয় করিডোরগুলো ওই প্রাণীদের জন্য ‘জীবনের রাস্তায়’ পরিণত হয়—যেখানে নির্দিষ্ট সময়, তাপমাত্রা, খাদ্য, ও অন্যান্য পরিবেশগত শর্ত তাদের অভিবাসনে সহায়তা করে। অথচ মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে সেই পথগুলোতে তৈরি করেছে মাছ ধরা অঞ্চল, জাহাজ চলাচলের রুট এবং জাতীয় জলসীমা—যা প্রাকৃতিক চলাচলের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

University of Queensland-এর পরিবহন প্রকৌশলী লিলি বেন্টলি বলেন, “এই টুল প্রায় ২,০০০ গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক আবাসস্থলের সংযোগ তৈরি করেছে এবং দেখিয়েছে যে আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।”

MiCO ডেটাবেইসটি তৈরি হয়েছে প্রায় ৩০ বছরের গবেষণাভিত্তিক তথ্য দিয়ে, যা পাখি, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী, মাছ, ও কচ্ছপসহ বহু প্রজাতির চলাচলের রুট নির্দেশ করে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, কোন প্রজাতি কোন দেশের জলসীমা অতিক্রম করে এবং কোথা থেকে কোথায় যায়।

বেশিরভাগ সামুদ্রিক অভিবাসী প্রজাতিই জীবনের কোনো এক পর্যায়ে একাধিক দেশের জলসীমা অতিক্রম করে, ফলে কোনো একক দেশই তাদের সম্পূর্ণরূপে রক্ষা করতে পারে না।

একটি উদাহরণ দিয়েছেন সামুদ্রিক সংরক্ষণ বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল ডান: “কোস্টারিকায় সবুজ কচ্ছপ সুরক্ষিতভাবে বাসা বাঁধে, কিন্তু পরে তারা যখন নিকারাগুয়ার জলসীমায় প্রবেশ করে, তখন সেখানকার আইন অনুযায়ী তাদের ধরা বৈধ—ফলে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক কচ্ছপ নিধন হয়।”

২০২৩ সালের এক জাতিসংঘ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন এই অভিবাসী প্রজাতিগুলোর জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনছে। খাদ্যশৃঙ্খলার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত ক্রিলের মতো প্রাণীর পরিমাণ, বিস্তার এবং প্রাপ্যতা বদলে যাচ্ছে, যা অভিবাসী প্রজাতির টিকে থাকার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

তাছাড়া সমুদ্রের স্রোত বদলে যাওয়া, মেরু অঞ্চলের দিকে প্রজাতির পরিসর সংকুচিত হওয়া, এবং প্রজনন ও খাদ্য সংগ্রহস্থলে ভিড় বেড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।

MiCO মানচিত্র এখনকার তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি হলেও গবেষকরা আশাবাদী, ভবিষ্যতে এটি সময়ভিত্তিক পরিবর্তন ধরতে সক্ষম হবে। যেমন, উত্তর মেরু বরফ গলে যাওয়ায় নতুন নৌপথ খোলা পড়ে, যা অনেক সামুদ্রিক প্রজাতির চলাচলে আমূল পরিবর্তন আনছে।

MiCO একটি বড় দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে: এখনো দুই-তৃতীয়াংশ সামুদ্রিক অভিবাসী প্রজাতির ওপর যথাযথ তথ্য নেই। গবেষকরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে এই মানচিত্র আরও প্রজাতি ও তথ্য যুক্ত করে বিশ্ব সমুদ্রের প্রকৃত সংযুক্তির চিত্র ফুটিয়ে তুলবে।

তাছাড়া মানচিত্র তৈরির প্রক্রিয়ায় গবেষকেরা বুঝতে পেরেছেন, তথ্য সংগ্রহেও রয়েছে পক্ষপাত। যেমন, সমুদ্রপাখির তথ্য প্রধানত মেরু অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত, অথচ প্রাণিবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ও মানুষের প্রভাবপ্রবণ ক্রান্তীয় অঞ্চল অনেকটাই উপেক্ষিত।

এছাড়াও মানচিত্রে উঠে এসেছে ভৌগোলিক ও আর্থিক বৈষম্য—বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের অবস্থান ও সম্পদের ভিত্তিতেই গবেষণার অঞ্চল নির্ধারিত হয়েছে।

এই মানচিত্র তাই শুধু এক টেকনিক্যাল উদ্যোগ নয়, বরং একটি বৈশ্বিক ডাক—যেখানে বলা হচ্ছে, প্রকৃতির সীমানা বুঝতে হলে আমাদের নিজেদের আঁকা সীমারেখা পেরোতে হবে।

সূত্র: https://l8.nu/-uoL

মিরাজ খান

×