ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চা-বাগানের চৌহদ্দি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে 

ইমন মাহমুদ

প্রকাশিত: ০১:৩৮, ৫ মার্চ ২০২৩

চা-বাগানের চৌহদ্দি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে 

রাজু নুনিয়ার জন্ম ও বেড়ে ওঠা মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানার মাজদিহি চা বাগানে

রাজু নুনিয়ার জন্ম ও বেড়ে ওঠা মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানার মাজদিহি চা বাগানে। বাবা,মা, ছোট দুই ভাই ও এক বোন নিয়েই রাজুদের সংসার। রাজইু তার বংশের প্রথম গ্রাজুয়েট। এর আগে তার বংশের কেউই পঞ্চম শ্রেণির গন্ডিও পেরোননি। ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতেন চা বাগানের চৌহদ্দি পেরিয়ে বাইরের দুনিয়া দেখবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবেন। বাবা-মাও স্বপ্ন দেখিয়েছেন সবসময়। ছোটবেলা থেকেই রাজু নুনিয়া আত্মমর্যাদার সাথে বাঁচতে চেয়েছেন। স্বপ্ন দেখেছেন স্বচ্ছল ও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের। রাজু মনে করেন, চা বাগানের বঞ্চনার গণ্ডি থেকে মুক্তির একমাত্র মাধ্যম শিক্ষা। 
অভাবকে সঙ্গী করেই পথচলা
“কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলেই প্রথমে অর্থনৈতিক সংকটের কথাটাই সবসময় মাথায় এসেছে। অর্থনৈতিক অভাব সবক্ষেত্রেই আমাদের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।” 
চা বাগানের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে ভর্তি হন ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুলে। ডানকান ব্রাদার্স লিমিটেড কোম্পানীর আওতাভুক্ত চা-বাগানের বাচ্চাদের নিয়ে এই স্কুলটি পরিচালিত হতো। এটি আবাসিক বিদ্যালয়। এখানে কোনো খাবার খরচ ছিলোনা। তারা তাদের কোম্পানীর সব চা-বাগান থেকে পরীক্ষা নিয়ে বাছাই করে শিক্ষার্থী ভর্তি করতো। এই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০১৩ সালে এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন রাজু। এরপর মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০১৫ সালে এইচএসসিতে জিপিএ ৪.৪২ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। 
দশম শ্রেণি থেকেই টিউশনি করেই নিজের খরচ নিজেই চালাচ্ছেন রাজু। এসএসসির ভালো ফলাফলের কারণে পান ডাচ বাংলা ব্যাংক শিক্ষা বৃত্তি। কলেজে উঠে টিউশনি করে উপার্জিত টাকার একটা অংশ জমিয়ে রেখেছিলেন বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা বাবদ ব্যয়ের জন্য। কেননা মানসিক শক্তি দিলেও অর্থনৈতিক সহযোগিতা পরিবারের জন্য আসলেই বেশ দুরূহ ছিলো। রাজু জানান, বিশ^বিদ্যালয়ে একপ্রকার সম্বলহীন অবস্থাতেই এসেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর আমার স্কুলের (ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুল) ‘আবু সোবহান ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ থেকে শিক্ষা লোনের আবেদন করি। দ্বিতীয় বর্ষ থেকে প্রতি মাসে এখান থেকে ১৫০০ টাকা করে পাই।”
৫ বছরের জন্য লোনটা পাবেন রাজু। বিশ^বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে চাকরি পেয়ে টাকাটা শোধ দিতে হবে।
পাশে ছিা পরিবার
প্রথমবার কোনো বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে হতাশায় ভেঙে পড়েন রাজু। ভেবেছিলেন এবার হাল ছেড়ে দিবেন, আর পড়াশোনা করবেননা। ছোটখাটো কোনো চাকরিতে ঢুকে সংসারের হাল ধরবেন। তখন আবারও মানসিক শক্তি যোগাতে পাশে এসে দাঁড়ালো পরিবার। বাবা পিঠে হাত রেখে বললেন, “রেহদে যা হইল হইল। আবারসে চেষ্টা কর ভালাসে। দেখা যাক, ভাগুয়ান আশীর্বাদ সে কা হয়....।”
বাবা ভরসা দিলেন, যেভাবেই হোক প্রয়োজন হলে টাকা যোগাড় করবেন। পরিবারের অকুণ্ঠ সমর্থন ও নিজের অধ্যবসায়ের কারণে দ্বিতীয়বারের প্রচেষ্টায় ভর্তির সুযোগ পেলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে। “ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর বাবা-মা অনেক খুশি হয়েছিলেন। তারা হয়তো আরও খুশি হতেন যদি জানতেন, বিশ^বিদ্যালয় কী! বাবা-মা তো জানেনই না বিশ^বিদ্যালয় কী! তারা ভাবেন এটা হয়তো বড় স্কুল, যেখানে পড়লে ভালো চাকরি পাওয়া যায়।”
গণরুমে নষ্ট হওয়া স্বপ্নের ভিড়ে নিজেকে খোঁজা
“বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির পর আমি কীভাবে কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, মাথার উপরে এমন কেউই ছিলোনা যে একটু নির্দেশনা দিতে পারে। সবারই দেখতাম কেউ না কেউ পরিচিত আছে। আমি আবিষ্কার করলাম এই ক্যাম্পাসে আমার পরিচিত কেউই নাই। আমার খারাপ লাগার অনুভূতিগুলো বলার মতো একজনকেও পেতাম না। তার উপর গণরুমের র‌্যাগিংয়ের কারণে প্রচন্ড ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। মনে হতো আমি ভিন্ন কোনো গ্রহ থেকে এসেছি। গণরুমের স্মৃতি মনের ভিতর আসলে আমি এখনও শিহরিত হই।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সবচেয়ে খারাপ লাগার অনুভূতি- গণরুম। এটার কোনো প্রয়োজনই ছিলো না। ওই অবস্থার জন্য যারা দায়ী তাদের উপর নিজে নিজে ক্ষোভ ঝাড়ি। তাদেরকে কখনও ক্ষমা করতে পারিনি। ওই একটা বছর আমার জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। প্রান্তিক এলাকা থেকে উঠে আসা আমার পক্ষে এই পরিবেশে মানিয়ে নেওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো। কোনো উপায় না পেয়েই গণরুমেই থাকতে হয়েছে।”
চমৎকার কিছু বন্ধু পেয়েছি
“বিশ^বিদ্যালয়ে আমার সবচেয়ে ভালো লাগার অনুভূতি হলো, এখানে এমন কিছু ভালো বন্ধু পেয়েছি যারা আমাকে কখনও আমার পরিবারের শূন্যতাটুকু বুঝতে দেয়নি। চা-বাগানের মতো প্রান্তিক জায়গা থেকে উঠে এসে বাইরের দুনিয়াতে খাপ-খাওয়াতে আমাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময়ও অনেক কিছু ভাবতে হয়। যদি আমি আড্ডার সময় টাকা খরচ করি তাহলে হয়তো আমাকে একবেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। বাইরে যারা বড় হয়েছে, তাদেরও বলতে চাই প্রান্তিক জায়গা থেকে উঠে আসা ব্যক্তির প্রতি মানবিক ও সহনশীল হোন।”
অনুজদের প্রতি দায়বদ্ধতা 
রাজু জানান, প্রায় দুইশ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় চা বাগানেই থাকার কারণে বাইরের দুনিয়াতে আসার সুযোগ থাকলেও হীনমন্যতা, ভাষার ভিন্নতা কিংবা সমাজ ছেড়ে না আসার পিছুটান থেকেই অবর্ণণীয় কষ্টে দিন কাটানোর পরেও সেখানে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন চা-বাগানে বসবাসরত মানুষগুলো। তারা বাইরে নিজেদেরকে ঠিক যথোপযুক্তভাবে প্রকাশ করতে পারেননা। সবসময় ভয় ও হীনমন্যতায় ভোগেন। 
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
চা-বাগানের ভিতরে বসতভিটা সংক্রান্ত ঝামেলার কারণে প্রায় চার বছর হলো বাবার কাজ নেই। ছোট দুই ভাইয়ের একজন এইচএসসি ও অন্যজন এসএসসি পাশ করলেও পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক সংকটসহ আরও নানা জটিলতায় তারা আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি। ছোট ভাই দুইটা কাজ করে নিজেদের খরচ চালানোর পাশাপাশি উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে পরিবারের খরচ চালাতে সাহায্য করে। 
“স্নাতক পাশ করা এবং এর কিছুদিন পরেই সমাবর্তন পাওয়াটা আমার জন্য চমৎকার একটা অনুভূতি। পরিকল্পনা ছিলো স্নাতক পাশের পরপরই ফার্মাসিউটিক্যালস সেক্টরে চাকরির চেষ্টা করবো। তবে, অনেক চাকরিতেই স্নাতকোত্তর প্রয়োজন হচ্ছে। এজন্য স্নাতকোত্তর শেষ করেই একটা চাকরি খুঁজে নিবো,” ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে বলছিলেন রাজু নুনিয়া।
“এখনও আমি বেশ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। তাছাড়া ছোটভাইদের উপরেও চাপ যাচ্ছে। সরকারি চাকরির জন্য আলাদা করে পড়াশোনা করা প্রয়োজন, তবে পরিবারকে দ্রুততম সময়ে সাপোর্ট দেয়াটাও আমার জন্য জরুরী। ছোটবোনটি মাধ্যমিকে পড়ছে। তাকেও বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।”

×