
দেশের সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চামড়া শিল্পের গুরুত্ব দিনে দিনে বাড়ছে। রফতানি বাণিজ্যে জাতীয় অর্থনীতিতে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্যের অবস্থান তৃতীয়। স্থানীয় বাজারসহ দেশের বাইরেও চামড়া-চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা প্রচুর। পরিকল্পিতভাবে এ খাতের উন্নয়ন করতে পারলে আমাদের রফতানি আয়ের পরিমাণ আরও বাড়ানো সম্ভব। চামড়া শিল্পের যথাযথ বিকাশ ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এত সম্ভাবনাময় খাতটির প্রতি যতটা মনোযোগ দেয়া উচিত ছিল ততটা মনোযোগ দেয়া হয়নি দীর্ঘদিনেও। অনেকটা অযতœ, অবহেলা আর বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে চামড়া শিল্প ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। দেশের যে কটি পণ্যের রফতানি বিশ্ববাজারে ভাল অবস্থানে রয়েছে তারমধ্যে অন্যতম চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে গার্মেন্টস শিল্পের মতো চামড়া শিল্পও হতে পারে আরেকটি শক্তিশালী রফতানি খাত।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বছরের ৪৮ ভাগ চামড়া পাওয়া যায় কোরবানির ঈদে, ১০ ভাগ রোজার ঈদ ও শবেবরাতে, ২ ভাগ হিন্দুদের কালিপূজার সময়। তাই এসব উৎসব পূজা পার্বণে বাংলাদেশ থেকে পশুর চামড়া সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় ভারতের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে দেশের কিছু ভুঁইফোড় মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী রাতারাতি বেশি মুনাফার লোভে পাচার করেন কাঁচা চামড়া। চামড়া পাচারকারীরা কোরবানির ঈদের কয়েকদিন আগে বিভিন্ন সীমান্তের গ্রামে আশ্রয় নেয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, চোরাকারবারিসহ সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে তারা। পরবর্তীকালে তাদের সহায়তায় অপকৌশল অবলম্বন করে সারাদেশ থেকে সংগ্রহ করা গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষের চামড়া পাচার করে দেয় ওপারে। অতএব, চামড়া পাচার রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
চাহিদার তুলনায় দেশে চামড়া উৎপাদন কম। চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম কোরবানির ঈদ। কোরবানির সময় যে চামড়া সংগ্রহ করা হয়, তা দিয়েই সারা বছর ট্যানারি শিল্পের কারখানাগুলো চলে। এ অবস্থায় কাঁচা চামড়া রফতানি করা হলে বছরের অর্ধেকের বেশি সময় কারখানাগুলো বন্ধ রাখতে হবে। এতে চামড়া শিল্পের সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগ মানুষ বেকার হবেন। তাছাড়া দামের দিক থেকে কাঁচা চামড়া ও ফিনিশ্ড লেদার বা লেদার গুডসের ব্যবধান অনেক। কাঁচা চামড়া রফতানি করে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় ঠিক একই পরিমাণ কাঁচা চামড়া থেকে উৎপাদিত ফিনিশ্ড লেদার বা লেদার গুডস রফতানি করে আয় হবে কয়েকগুণ। বছরে ৩০ মিলিয়ন স্কয়ার ফিট চামড়া উৎপাদন হয়। কিন্তু চাহিদা দ্বিগুণের বেশি। চামড়া শিল্পে চীনের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এদেশে যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। পরিকল্পিতভাবে চামড়া শিল্পে বিভিন্ন উৎপাদনমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে বাংলাদেশ। পরিবেশবান্ধব আধুনিক চামড়া শিল্প গড়ে আমাদের অর্থনীতিতে আরও চাঙ্গাভাব সৃষ্টি করা যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুণগত মানের চামড়া, সস্তা মজুরির শ্রমিক ও কাঁচামালের সহজপ্রাপ্যতাসহ অন্যান্য তুলনামূলক সুবিধা ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারে। রফতানি প্রবৃদ্ধির ধারা জোরদার করতে চামড়া শিল্প খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রশিক্ষণ সুবিধার প্রসার ও বিদেশী ক্রেতাদের কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে ট্যানারি শিল্পে গুণগত পরিবর্তন আনার জোরালো উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
প্রতিবছরই পবিত্র ঈদ-উল-আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শতশত কোটি টাকা ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বিভিন্ন ব্যবসায়ীর ঋণ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এসব ঋণের বিষয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে । আগেকার কোন খেলাপি প্রতিষ্ঠান যেন ঋণ না পায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকে ব্যাংকগুলো। সম্ভাবনাময় রফতানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বেশি রফতানির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিতকে আরও মজবুত করতে হলে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। চামড়া শিল্পের মানোন্নয়নে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির লক্ষ্যে আরও লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপন, চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ, চামড়া শিল্পের জন্য আলাদা শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা, চামড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে বোঝাপড়া ও সমন্বয় গড়ে তোলা, ব্যবসায়ীদের চামড়া রফতানির বিপরীতে পাওনা শুল্ক ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা নেয়া, চামড়া সংরক্ষণে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব নিরসন, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে লবণ ও অন্যান্য ব্যবহৃত কেমিক্যালের মূল্য না বাড়ানো, চামড়ার রফতানি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে আরও কার্যকর করাসহ প্রয়োজনীয় বিষয়ে বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্পে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতে এ শিল্প বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমাদৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।