ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

স্থাপত্যের অনন্য প্রতীক: মোগল আমলের নিদর্শন শাহ শরীফ মসজিদ

নাজমুল হাসান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সরসপুর, মনোহরগঞ্জ, কুমিল্লা

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ৩১ মে ২০২৫

স্থাপত্যের অনন্য প্রতীক: মোগল আমলের নিদর্শন শাহ শরীফ মসজিদ

ছবি: জনকণ্ঠ

সবুজে ঘেরা মাঠ, পাখির কিচিরমিচির, নদীর শান্ত স্রোত আর ইতিহাসের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনিএই সব কিছু যেন একসাথে মিশে আছে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার শরীফপুর গ্রামে। প্রকৃতি ইতিহাসের অপূর্ব মেলবন্ধনে গড়া এই জনপদে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো মোগল স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন শরীফপুর শাহী জামে মসজিদ।

এই মসজিদ শুধু একটি উপাসনালয় নয়, এটি এক যুগের সাক্ষীধর্ম, সংস্কৃতি স্থাপত্যকলার এক অনন্য দলিল। তার পাশেই রয়েছে নাটেশ্বর দীঘি, পীর শাহ শরীফ (রহ.)-এর মাজার এবং নানা ইতিহাসভিত্তিক স্থাপনাযা একত্রে গড়ে তুলেছে একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র।

কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার বাইশগাঁও ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামে অবস্থিত এই মসজিদ তার আশপাশের এলাকা দীর্ঘদিন ধরেই ইতিহাসপ্রেমী পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে হায়াত আবদে করিম নামে একজন মুসলিম পুরুষ মসজিদটি নির্মাণ করেন। সে সময় এই অঞ্চল শাসন করতেন রাজা নাটেশ্বর। হায়াত আবদে করিম রাজবাড়িতে চাকরি করতেন এবং পরবর্তীতে শাহ শরীফ বাগদাদী (রহ.) নামক একজন পীরের প্রভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। রাজা নাটেশ্বরও ইসলামের ছায়াতলে আসেন।

নিঃসন্তান হায়াত আবদে করিম নিজের বেতনের অর্থে দীর্ঘ ২৭ বছর সময় নিয়ে নির্মাণ করেন এই তিন গম্বুজবিশিষ্ট ঐতিহাসিক মসজিদ। মসজিদটির নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে খাঁটি চুন-সুরকি টালি ইট, আর নিখুঁত খোদাইয়ে ফুটে উঠেছে মোগল স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব নিদর্শন।

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ৩৬০টি মসজিদের মধ্যে শরীফপুর শাহী জামে মসজিদ একটি। এটি কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি স্থাপত্যের এক জীবন্ত নিদর্শন। মসজিদের উত্তরে রয়েছে পীর শাহ শরীফ হাফেজিয়া মাদ্রাসা আয়েশা হালিম এতিমখানা। এখানকার শিক্ষক ছাত্ররাই মসজিদের নিয়মিত দেখভাল করে থাকেন।

আট বছর আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটি অধিগ্রহণ করে এবং একে একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা দেয়। এই ঐতিহাসিক স্থানকে কেন্দ্র করে এলাকার মানুষদের মধ্যে পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠার প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।

মসজিদের পাশেই রয়েছে বিশাল নাটেশ্বর দীঘি। রাজা নাটেশ্বর তার নামানুসারে দীঘিটি খনন করেন, যার আয়তন প্রায় ২৭ একর। দীঘিটির দক্ষিণ পাশে রয়েছে একটি বিস্তীর্ণ মাঠ, আর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে রয়েছে পীর শাহ শরীফ বাগদাদী (রহ.)-এর মাজার। প্রতিবছর এখানে আয়োজিত হয় বড় পরিসরের ওরস ওয়াজ মাহফিল। মসজিদের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ডাকাতিয়া নদী, যা এই স্থানটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও গভীরতা দিয়েছে।

দর্শনার্থীরা মনে করেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে শরীফপুর হতে পারে একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন স্পট। স্থানীয় লোকজনের মতে, যথাযথ সরকারি সহায়তা প্রচারণার মাধ্যমে এই এলাকা হয়ে উঠতে পারে পর্যটকদের একটি নতুন গন্তব্য।

বিষয়ে মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইউসুপ আলী বলেন, “শরীফপুর শাহী জামে মসজিদ নাটেশ্বর দীঘিকে ঘিরে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এগুলোকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. তাজুল ইসলামের সহযোগিতা চাওয়া হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে প্রতিদিন কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু দর্শনার্থীর আগমন ঘটবে।

মুমু

×