ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

দারিদ্র্য বিমোচনে এজেন্ট ব্যাংকিং

প্রকাশিত: ২১:০৫, ২৯ নভেম্বর ২০২১

দারিদ্র্য বিমোচনে এজেন্ট ব্যাংকিং

এজেন্ট ব্যাংকিং ধারণার উৎপত্তি লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে। দ্রæততম সময়ের মধ্যে এ ব্যাংকিং ধারণা ছড়িয়েছে চিলি, কলম্বিয়া, পেরু ও মেক্সিকোয়। বিস্তৃত হয়েছে কেনিয়াসহ আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে সেবাটি চালু করা হয়েছে। একই উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা-সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে পাইলট কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রথম এজেন্ট নিয়োগ দেয় ব্যাংক এশিয়া। এরপর অন্যান্য ব্যাংকও দ্রæততম সময়ের মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২৮টি ব্যাংক লাইসেন্স নিয়েছে। এর মধ্যে আউটলেট চালু ও ব্যাংক হিসাব খোলার দিক থেকে শীর্ষস্থানে আছে ব্যাংক এশিয়া। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানটি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের। এজেন্টদের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ ও রেমিটেন্স আহরণে শীর্ষস্থানে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। আর এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের শীর্ষস্থান ব্র্যাক ব্যাংকের। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মধ্যে এজেন্ট নিয়োগ, নতুন নতুন আউটলেট ও ব্যাংক হিসাব খোলা নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে। সেবাটিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গিও বেশ উদার বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী গ্রাহকদের কাছে সুলভে বিভিন্ন রকম আর্থিক সেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভ‚মিকাটি পালন করেছে ডিজিটাল প্রযুক্তির কার্যকর প্রয়োগ। এক্ষেত্রে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক দশক আগে এমএফএসের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে ‘ব্যাংক লেড মডেল’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তিন-চার বছরের মধ্যেই সর্বস্তরের নাগরিকদের এমএফএস সেবার আওতায় নিয়ে এসে সারা বিশ্বের ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডারদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে সময়ের সাহসী ও সুবিবেচনাপ্রসূত উদ্যোগের সুফল পাওয়া গেছে করোনা পরিস্থিতিতে। করোনার মাসগুলোয় প্রতি মাসেই এমএফএস লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। কারণ, আংশিক লকডাউনের সময় প্রায় সর্বস্তরের মানুষই নির্ভর করেছে মোবাইলভিত্তিক আর্থিক লেনদেনের ওপর। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের পরিবর্তে যেখানে ব্যবসা ও অর্থের প্রবাহ বেশি, সেখানেই খোলা হচ্ছে এজেন্ট আউটলেট। মানা হচ্ছে না আর্থিক সেবাটির আউটলেটগুলোর মধ্যকার দূরত্বসংক্রান্ত রীতিনীতিও। ব্যাংকগুলো আর্থিক সক্ষমতায় এগিয়ে থাকা বিভিন্ন এলাকায় এজেন্ট নিয়োগ দিচ্ছে কোন বাছবিচার না করেই। দারিদ্র্যপ্রবণ ও দুর্গম এলাকাগুলোয় নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না এজেন্ট। খোলা হচ্ছে না এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটও। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, শুধু ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনেই খোলা হয়েছে ৬১০টি এজেন্ট আউটলেট। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় চালু আউটলেটের সংখ্যা ৯৩। ঢাকা জেলায় সব মিলিয়ে আউটলেট রয়েছে ৯৭৭টি। চট্টগ্রাম জেলায় রয়েছে ৬৫০টি। অথচ দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা কুড়িগ্রাম জেলায় এজেন্ট আউটলেট খোলা হয়েছে মাত্র ২২৪টি। লালমনিরহাটে এ সংখ্যা ১২৪। নীলফামারীতে ১৮৬, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৯১ ও পঞ্চগড়ে ১৩৯টি আউটলেট চালু হয়েছে। সুনামগঞ্জ, হাওড়-বাঁওড়সমৃদ্ধ জেলাটিতে এজেন্ট আউটলেট খোলা হয়েছে মাত্র ২১৭টি ও শুধু কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায়ই বিভিন্ন ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেট রয়েছে ১০৪টি। দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ৬৬ শতাংশ ও ঋণের ৭৯ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলায় সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার ব্যাংক শাখাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে মোট ব্যাংকঋণের ৬৩ শতাংশ। শুধু মতিঝিল ও গুলশান থানার ব্যাংকের শাখাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে মোট ঋণের ৪৫ শতাংশ। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রতিটি থানায় বিভিন্ন ব্যাংকের অনেক শাখা রয়েছে। এমনকি কোন কোন থানা এলাকায় একই ব্যাংকের একাধিক শাখাও দেখা যায়। এরপরও খোদ রাজধানীতে ৬১০টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট চালুর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন উত্তর পাওয়া যায় না। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের সরকারী-বেসরকারী ২৮টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেট রয়েছে ১৭ হাজার ৪৬৪টি। আউটলেটগুলোর মাধ্যমে মোট ১ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার ৩৫৮টি হিসাব খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩২৯টি হিসাব নারীদের। হিসাবগুলোয় জমা আমানতের পরিমাণ ২০ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। এছাড়া এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৩ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে দেশের এজেন্ট আউটলেটগুলোর মধ্যে ২ হাজার ১৯৯টি শহর এলাকায়, যা মোট আউটলেটের প্রায় ১৩ শতাংশ। বাকি ১৪ হাজার ৯৪৬টি গ্রামে। সে হিসাবে এজেন্ট আউটলেটের ৮৭ শতাংশেরও বেশি গ্রামাঞ্চলে থাকার কথা। তবে নগর অঞ্চলকেও গ্রাম হিসেবে দেখানোয় প্রান্তিক এলাকাগুলোয় এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যা বেশি দেখাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের তিন পার্বত্য জেলার বাসিন্দারা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির দিক থেকে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামনের সারিতে। যদিও এ তিন জেলায় ব্যাংকগুলোর চালু করা আউটলেটের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে কম আউটলেট রয়েছে বান্দরবানে। এ জেলায় চালু করা আউটলেটের সংখ্যা ৩৬। এছাড়া খাগড়াছড়িতে ৬৯টি ও রাঙামাটিতে ৭৩টি আউটলেট চালু করেছে ব্যাংকগুলো। রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার বেশি। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতেও এ বিভাগের জেলাগুলো পিছিয়ে। এর মধ্যে লালমনিরহাটে ১২৪টি, পঞ্চগড়ে ১৩৯, নীলফামারীতে ১৮৬, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৯১ ও কুড়িগ্রামে ২২৪টি এজেন্ট আউটলেট চালু হয়েছে। অথচ পাঁচটি পৌরসভা ও ৪৩টি ইউনিয়নের ফেনী জেলায় এজেন্ট আউটলেট খোলা হয়েছে ২৬১টি। ঢাকার পার্শ্ববর্তী দুই জেলা গাজীপুর ও এজেন্ট ব্যাংকিং মডেলটি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। যেমন : ১. প্রত্যন্ত অঞ্চলের এজেন্ট নিয়োগ নিয়ে ব্যাংকগুলোর মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে যা এই ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর ২. বিচার বিবেচনা না করেই কোন ব্যবসায়ীকে এজেন্ট নিয়োগ দেয়ায় সেবাটিকে ঘিরে এরই মধ্যে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে যা কাম্য নয় ৩. নিয়ম অনুযায়ী গ্রাহক টাকা জমা দিলে আউটলেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী তা কম্পিউটারের মাধ্যমে সফটওয়ারে ইনপুট দেবেন এবং টাকা জমা হওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিন্টার থেকে প্রিন্ট হবে টাকা জমার রসিদ আর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক থেকে গ্রাহকের মুঠোফোনে চলে যাবে খুদে বার্তা। কিন্তু এ নিয়মের ধার ধারেনি অনেক এজেন্ট ব্যাংক শাখা ৪. বাংলাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ব্যবসায় উদ্যোক্তারা রাতারাতি ঝুঁকে বসেছে এবং এরই মধ্যে ২৮টি সরকারী-বেসরকারী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স নিয়েছে। আরও একাধিক ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স নেয়ার কথা ভাবছে। এ সম্পর্কে প্রদানকারী সংস্থা অবশ্যই সতর্ক থাকবেন। নচেৎ এই অপার সম্ভাবনার জায়গাটি মুখ থুবড়ে পড়বে বলে প্রতীয়মান হয় ৫. এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার শৃঙ্খলা যাতে ভেঙে না পড়ে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর হওয়ার সময় এসেছে ৬. এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় দুই কিলোমিটারের মধ্যে একটি আউটলেট স্থাপনের বিধান কার্যকর করা দরকার ৭. বড় বাজারগুলোতে এজেন্ট নিয়োগ দিতে ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতা করছে অথচ অর্থের প্রবাহ তুলনামূলকভাবে কম এমন এলাকায় এজেন্ট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে সজাগ থাকতে হবে ৮. ব্যাংক ভেদে একটি ব্যাংকের এজেন্টশিপ গ্রহণ ও আউটলেট তৈরিতে উদ্যোক্তাদের ১৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। আউটলেটগুলো পরিচালনা, ভাড়া পরিশোধসহ অন্যান্য ব্যয় সংযুক্ত করে প্রতি মাসেই এজেন্টদের ব্যয় হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংক হিসাব খোলা, আমানত গ্রহণ, অর্থের লেনদেন, রেমিটেন্স গ্রহণ, বিভিন্ন সেবার মাশুল গ্রহণ, ঋণ বিতরণসহ নির্দিষ্ট কিছু ব্যাংকিং সেবা দিতে পারছেন এজেন্টরা। এসব সেবার বিপরীতে ব্যাংক থেকে এজেন্টরা কমিশন পান যা অনেকক্ষেত্রে অপ্রতুল বলছেন এজেন্টরা। সর্বোপরি বলা যায় এই মডেলটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে দারিদ্র্য মানুষের দুঃখ ঘুচবে ও দেশের আর্থি অন্তর্ভুক্তি এক ধাপ এগিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা রইল। লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি ও সাবেক জাস্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা
×