ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সময় এখন সচেতনতা সৃষ্টির

প্রকাশিত: ২০:১৬, ১২ জুন ২০২০

সময় এখন সচেতনতা সৃষ্টির

বিশ্ববাতাসে কোভিড-১৯ মহামারী রক্তপদ্মের মন্ত্রপূত লহমায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আর মানবজীবনকে লকডাউনের খাঁয়ের ঢেকে ফেলেছে ভয়ঙ্কর মৌন আঁতাতরূপে! দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ, বাংলাদেশও দীর্ঘ এই লকডাউনে কার্যত সাধারণ ছুটি জনগণ উপভোগ করেছে মাত্র! আর দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশের লকডাউন শিথিল কিংবা উঠিয়ে নেয়ার সময় জনস্বাস্থ্য বিধিগুলো সঠিকভাবে মেনে নেয়া হয়নি। প্রণয়ন হয়নি সঠিক নীতিমালা। এমনকি বাস্তবায়ন কিংবা প্রচারিত হয়নি সঠিক আইন, সতকর্তাবাণী! প্রকৃতপক্ষে, সংক্রামিত কোন মহামারীর বিরুদ্ধে লকডাউন তো কখনো কোন সমাধান ছিল না! তা ছিল কেবল জনসাধারণের হাতে সান্ত¡না পুরস্কার তুলে দিয়ে সরকারের প্রায় সমস্ত মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকগণের সময় পাওয়ার একটি সুযোগমাত্র। যাতে তারা নিজেরা মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত হতে পারে, দক্ষ জনবল বা কর্মী তৈরি করতে পারে এবং জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্জিত সক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ করতে পারে। অন্তত সর্বস্তরে প্রতিষেধক পৌঁছানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। আমাদের নীতিনির্ধারকগণ প্রস্তুত প্রস্তুত বুলিতে নাক-মুখ না ঢেকে থুঁতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে ফটোসেশন করেই ভার্চুয়াল মাধ্যমকে উত্তপ্ত করেছেন সারাক্ষণ! তারা কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে হা করে থেকেছেন বৈ বেশি কিছু করেছেন বলে চোখে পড়েনি। সেখানেও কি হয়েছে তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপই বারংবার ভরসা হয়েছে জনসাধারণের। অথচ বিশেষায়িত হাসপাতাল থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকর্মী পর্যন্ত সবকিছুরই অবস্থানে আমরা প্রায়ই অন্ধকারে নিক্ষেপিত হয়েছি। ইতোমধ্যেই পোশাক কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে সংক্রমণ বেড়েছে। যখন লকডাউন উঠে গেল তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই সংক্রমণ আরও বেশি হবে। আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। সেইসঙ্গে মৃতের সংখ্যাও বহুগুণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একথা নিশ্চিত, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। ভেঙ্গে পড়বে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কারণ আক্রান্তের সংখ্যার সঙ্গে ভোগান্তির সংখ্যাও বাড়বে। কারণ দেখা যাবে নিজের অজান্তেই জনসংখ্যার একটি বড় অংশ উপসর্গ বিহীন ভাইরাসবাহী হয়ে সমাজে ঘুরছে। আর আনুপাতিকহারে কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন বয়স্ক কিংবা বিভিন্ন রোগাক্রান্তদের অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। এতে করে মহামারীতে অসুস্থতায় সরকারের সঙ্গে পরিবারের অর্থনৈতিক খরচ বাড়বে। সেক্ষেত্রে বলা যায়, লকডাউন উঠে যাওয়ায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু করার মধ্য দিয়ে যতটা না আমাদের লাভ হওয়ার কথা, স্বাস্থ্য খাতে খরচ এবং ভারসাম্যহীনতা বেড়ে যাওয়ায় তার চাইতে কিছুটা হলেও বেশি পরিমাণে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। দীর্ঘ এই লকডাউনে সরকারের সব মন্ত্রণালয়গুলোর প্রায় নিষ্ক্রিয় অবস্থান আমাদের সুশীল সমাজকে কিছুটা হলেও ব্যথিত করেছে। কারণ দীর্ঘ এই সময়ে সামাজিক মাধ্যমে এই মহামারী কিংবা সংক্রমণের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির জন্য বিশেষ কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তার সবচাইতে বড় প্রমাণ সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের অন্ধকার উপস্থিতি। গণমাধ্যমে (রেডিও, টেলিভিশন) সাংস্কৃতিক উপস্থাপনায় গান, কবিতা, নাটক, তারকাদের সরব কথপোকথনের জ্যামিতিকহারে উপস্থিতি না থাকা এবং মাইকিং বা অন্যান্য প্রচারণার তুলনামূলক কম ব্যবস্থা। বিভিন্ন ফোন কোম্পানির মহামারী প্রতিরোধের প্রচারণায় নীরবতা জনমনে আশাহীনতার উদ্রেক করেছে বৈ ভিন্ন কিছুই নয়! কারণ যে কোন ক্রান্তিকালে কিংবা মহামারীতে জয়লাভের মূলমন্ত্র হচ্ছে সমন্বিতভাবে সচেতনতা সৃষ্টি। আনুপাতিকহারে করোনা আমাদের অনেক সময় দিয়েছে। এখনও সময় আছে লকডাউন যদি আর না দেয়াও হয় তবুও অন্যান্য মাধ্যমে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কারণ, উপার্জন ছাড়া বেঁচে থাকাও তো সম্ভব নয়। তাই মানুষকে বাইরে বের হতে হবে, কাজ করতে হবে। তবে অবশ্যই সচেতন হয়ে। সচেতনতাকে সর্বস্তরের করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে পেছনে ফেলে নীতিনির্ধারকগণকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাধারণ মানুষের যতটা না আবেদন তারচাইতে বহুগুণ বেশি নিবেদন বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে। তার যথোপযুক্ত হস্তক্ষেপই সচেতন প্রচারণায় অনেক বেশি প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরী অবস্থা মোকাবেলা ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের আইনের প্রয়োগ ও প্রচারণা আবশ্যক। সেক্ষেত্রে সমগ্র বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিটি এনালগ বিলবোর্ড থেকে শুরু করে ডিজিটাল বিলবোর্ডে আইন এবং তা অমান্যে শাস্তি, জরিমানা, জেল সংক্রান্ত বিষয়গুলো আইন মন্ত্রণালয় কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রচার করা উচিত। টেলিভিশন, রেডিওতে একসময় এইচআইভি এইডসের সচেতনতায় শোন মানুষ’ শিরোনামে একটি ভিজ্যুয়াল গান প্রচারিত হতো। সেভাবে কিংবা আরও সুন্দরতম উপস্থাপনায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কবি-গীতিকবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীদের প্রেরণাদায়ী কিংবা সচেতনতামূলক লেখা-কবিতা-আবৃত্তি-গান-গল্প প্রচার করতে পারে। দেশের এই ক্রান্তিকালীন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কমপক্ষে প্রায় দশ মিনিট পরপর বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান তাদের অন্যান্য বিজ্ঞাপনের বিস্তৃতি কমিয়ে সচেতনতামূলক গান-কবিতা-আবৃত্তি বা দৃশ্যে কেবল নির্ধারিত মনোগ্রাম ব্যবহার করে তা প্রচার করতে পারে। টকশো তো আমাদের দেশে এখনও বোদ্ধা মহলের বাইরে একেবারে সর্বস্তরের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনিও তাই তারকাদের মাধ্যমেও সচেতনতামূলক বক্তব্য প্রচার করা যেতে পারে। পত্রিকাতেও প্রতিদিন সচেতনতামূলক কিছু প্রচার হতে পারে। মোবাইল কোম্পানিগুলো তো সারাদিনই কোন না কোন ক্ষুদে বার্তা কিংবা সরাসরি ফোন করে বিভিন্ন তথ্য পাঠাতে থাকে গ্রাহকের কাছে। এক্ষেত্রে তারা সপ্তাহে অন্তত চারদিন বিভিন্নভাবে গ্রাহকের কাছে প্রতিটি আলাদা সচেতনতামূলক তথ্য পৌঁছাতে পারে। নির্বাচনী প্রচারণায় বিভিন্ন প্রার্থীগণ যেভাবে মাইকিং করে প্রচারণা চালায়, সেভাবেও সচেতনতা প্রচারের কাজটি নেতা-কর্মীগণ করতে পারলে এই মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা অনেক এগিয়ে যেতে পারব নিশ্চয়ই। মহামারী করোনার প্রভাব যেন এক বিধ্বংসী জোয়ার, যেখানে ভাটার টানে চলে যাচ্ছে পৃথিবীর ধনী থেকে দরিদ্র সমস্ত মানুষ। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ সাজ সাজ রবের উদাসীন কিংবা নিশ্চিন্ত লকডাউনে ইতোমধ্যেই হয়ে গিয়েছে ভঙ্গুর। সেখানে স্বল্পোন্নত দেশের খাতায় নাম তোলা উন্নয়নশীল একটি দেশ হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ, দীর্ঘ প্রায় মাস দুইয়ের লকডাউন শেষে গণপরিবহন চালু থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই সচল হয়েছে। কিন্তু এই সচলায়ন কতটা সুফল বয়ে আনবে আমাদের জাতীয় জীবনে তা ভাববার বিষয় তো বটেই, সেইসঙ্গে চিন্তারও বিষয়! সেই দুশ্চিন্তার ছায়াপথে দৃপ্তকণ্ঠে সচেতনতার আহ্বানই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় মুক্তির বাঁশি হয়ে বেজে উঠবে, সেই প্রত্যাশায়। লেখক : কথাসাহিত্যিক ও নারীনেত্রী
×