ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী

বাংলা সালের ভিত্তিতেই অর্থবছর নির্ধারিত হোক

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৪ এপ্রিল ২০১৮

বাংলা সালের ভিত্তিতেই অর্থবছর নির্ধারিত হোক

বাংলা নববর্ষের উদ্যাপন আজ বিশ্বজন স্বীকৃত। আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো মানব জাতির এক অনন্য ঐতিহ্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের জন্য তা এক বিরল গৌরবের বিষয়। পহেলা বৈশাখ আমাদের বাংলা পঞ্জিকার নতুন বছরের প্রথম দিন। সারাদেশে আমরা বিপুল উৎসাহে দিনটি পালন করব। বর্ণিল মিছিল বেরোবে, তরুণ-তরুণীরা রঙিন কাপড় পড়বে, আমরা আদি ও অকৃত্রিম বাঙালী খাবার খেয়ে দিনটি পালন করব। তারপর কোলাহল বন্ধ হবে, বাংলা পঞ্জিকা আমাদের জাতীয় জীবন থেকে সরে যাবে। ইংরেজী সালেই আমাদের দৈনন্দিন জীবন ফিরে যাবে। কেন স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা সাল এত অবহেলিত? বাংলা নববর্ষের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৫০ দশকের গোড়ায়। বাবা তদানীন্তন গোপালগঞ্জ মহকুমার প্রশাসক (এসডিও)। আমরা বাসার ছোটরা ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠানে যেতাম। দোকানিরা মিষ্টি খাওয়াতেন, দোকান সাজাতেন। সে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। একবার অনুষ্ঠান শেষে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম হালখাতার বিষয়টি আসলে কী? বাবা বোঝালেন বাংলা নববর্ষের কথা। বোঝালেন রীতিনীতি অনুযায়ী আমাদের সব অর্থনৈতিক অঙ্গনে কিভাবে এই দিন থেকে নববর্ষের সূচনা হয়। দোকানদারদের গত বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন বছরে খাতা খোলার কাহিনী, যার ভিত্তিতে ‘হালখাতা’ নামকরণ। শিশু বয়সেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন আজ আমাদের স্কুল বাংলা নববর্ষের জন্য ছুটি দিল না। বাবা বোঝালেন, পাকিস্তান সরকার বাংলা পঞ্জিকা জাতীয় জীবনে মানে না। গোটা বিষয়টি আমার বেশ রহস্যময় মনে হয়েছিল সে বয়সেই। এক রকম নিষিদ্ধ পঞ্জিকা নিয়ে নতুনভাবে জড়িত হলাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। পাকিস্তান সরকার দিনটির উদ্যাপন করা থেকে বিরত রাখার জন্য বিভিন্ন রকম অপপ্রচার চালাত। বলত, এই পঞ্জিকার সঙ্গে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের কোন সম্পর্ক নেই। দিনটি উদ্যাপন করা এক রকম নিষিদ্ধই ছিল। কিন্তু নিষিদ্ধ ফলের আকর্ষণ দুর্বার। আমরা দল বেঁধে দিনটি উপভোগ করতাম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতাম, গাইতাম, নাচতাম, আবৃত্তি করতাম। পরে রমনার বটমূলের ছায়ানটের অতি ছোট সাংস্কৃতিক বীজ থেকে আজ আমাদের এত বড় নববর্ষের উদ্যাপন। সত্যিই কি বাংলা পঞ্জিকার উৎস ‘অমুসলমান’ কৃষ্টি থেকে ? বই ঘেঁটে যা দেখা যায়, মোগল সম্রাট আকবর তাঁর শাসনামলে (১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) বাংলা সাল নিয়ে এসেছিলেন আমাদের জাতীয় জীবনে। এর আগে মোগল সাম্রাজ্য আমাদের চাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করত চন্দ্রভিত্তিক হিজরি সাল হিসেবে। একটা বিরাট অসুবিধা ছিল, হিজরি সাল পরিবর্তনশীল এবং তা আমাদের ফসলি সালের সঙ্গে মিলত না। আমাদের চাষীরা ঘরে ফসল না তুলে কিভাবে খাজনা দেবেন ? তাদের তো কোন আর্থিক সামর্থ্য নেই। সম্রাট আকবর বিচক্ষণ ব্যক্তি। তাঁর মহাজ্ঞানী পরিষদ আমির ফাতেহ উল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে আলোচনা করে একটা বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নিলেন। বাংলা ফসলি সালের ভিত্তিতেই খাজনা বছর চালু করলেন সম্ভবত ১৫৮৪ সালের মার্চ মাস থেকে। কিন্তু সম্র্রাটের নির্দেশে এই পঞ্জিকার হিসাব শুরু হলো ১৫৫৬ থেকে। কারণ ওই সালেই আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। মোদ্দাকথা, সম্র্রাট আকবরের বাস্তবমুখী সিদ্ধান্তের ফলে বাংলা পঞ্জিকার আমাদের জাতীয় জীবনে আগমন। এ বিষয়ে অবশ্য দ্বিমত আছে। কিছু ঐতিহাসিক বলেন, রাজা শশাঙ্ক অনেক আগে তাঁর শাসন আমলে (৬০০-৬২৫ খ্রিস্টাব্দে) এই বাংলা পঞ্জিকা প্রথম বাংলা ও উড়িষ্যায় প্রবর্তন করেন। তার ভিত্তিতেই সম্র্রাট আকবর ও সিরাজী চন্দ্রভিত্তিক হিজরি সাল ছেড়ে সূর্যভিত্তিক ফসলি বাংলা সালেই ফিরিয়ে আনেন তাঁর খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে। মোগল আমলে সরকারি কাজকর্ম চলত এই বাংলা পঞ্জিকার ভিত্তিতে আর বিভিন্ন ধর্মের লোকজন তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদ্যাপন করতেন নিজ নিজ ধর্মীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী। ব্রিটিশরা উপমহাদেশ দখল করেই বাংলা পঞ্জিকাকে হটিয়ে গ্রেগরিয়ান ইংলিশ পঞ্জিকা আমাদের জাতীয় জীবনে আনলেন। শুধু সারা বাংলায়ই জমির খাজনা চলল বাংলা সালের ভিত্তিতে। বাকি সব জাতীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাজ চলল ইংরেজী পঞ্জিকার ভিত্তিতে। আগের প্রথা অনুযায়ী ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলল নিজ নিজ পঞ্জিকার ভিত্তিতে। পাকিস্তান আমলে মোটামুটি একই প্রথা চালু থাকল, তবে সরকারী আর্থিক বছর পরিবর্তন করে জুলাই থেকে পরবর্তী জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হলো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এ প্রথা চলছে। আমাদের জাতীয় জীবন আজও ইংরেজী সালের ভিত্তিতে চলে। শিক্ষা বছর চলে এই ভিত্তিতে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়েও আর্থিক বছর চলে জুলাই থেকে জুন ভিত্তিতেই। শুধু জমির খাজনা ও দোকানিরা হিসাব রাখেন বাংলা সালের ভিত্তিতে। কিভাবে জাতীয় জীবনে বাংলা সাল আনা যায়? বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজী পঞ্জিকা আমাদের মানতেই হবে। কিন্তু আর্থিক বছর মানার ব্যাপারে আমাদের ও অন্যান্য দেশের কিছুটা স্বাধীনতা আছে। প্রতিটি দেশের নিজ নিজ আবহাওয়া ও অর্থনৈতিক কর্মকা- বিবেচনা করে নিজ নিজ আর্থিক বছরে নিরুপণ করে আসছেন। নিচে বর্ণিত তালিকা থেকে তা বোঝা যাবে ঃ যুক্তরাষ্ট্র ঃ ১ অক্টোবর-৩০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, ১ এপ্রিল-৩১ মার্চ চীন, রাশিয়া, ইত্যালি ঃ ১ জানুয়ারি-৩০ ডিসেম্বর। নেপাল ঃ ১৬ জুলাই-১৫ জুলাই পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ঃ ১ জুলাই-৩০ জুন মালদ্বীপ ও ভুটান ঃ ১ জানুয়ারি-৩১ ডিসেম্বর ভারত ও শ্রীলঙ্কা ঃ ১ এপ্রিল-৩১ মার্চ আফগানিস্তান ঃ ২১ মার্চ-২০ মার্চ (ফার্সী পঞ্জিকা) পাকিস্তানী আমলে প্রবর্তিত ১ জুলাই থেকে ৩০ জুনের আর্থিক বছরের হিসাব তাদের দেশের আবহাওয়ার ভিত্তিতেই করা হয়েছিল। কারণ তাদের তো আমাদের মতো সুদীর্ঘ বর্ষাকাল নেই। কিন্তু আমাদের প্রচলিত আর্থিক বছর সরাসরি আমাদের বর্ষাকালের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে, এতে অর্থনৈতিক কর্মকা- বিঘিœত হয়। নতুন বাজেট পাস করে নতুন বছরের সরকারী অনুদান পেতে আগস্ট মাস হয়ে যায়। তখন বর্ষাকাল, কোন উন্নয়নের কাজ শুরু করা যায় না। শুকনো আবহাওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয় এবং উন্নয়নের কাজ শুরু করতে মাস তিনেক বিলম্ব হয়ে যায়। ফলে উন্নয়ন কার্যক্রম প্রতিবছর দেরিতে শুরু হয়। কিন্তু জুনের মধ্যেই শেষ করতে হবে বলে তাড়াহুড়ো করে বৃষ্টির মধ্যেই জুন মাসে সব কাজ শেষ করা হয়। ঢাকা শহরে যারা থাকেন তারা প্রতিবছর জুন মাসে এই খোঁড়াখুঁড়ি ও রাস্তা মেরামত দেখেন। কাজ ভাল হয় না। অর্থের অযথা অপচয় হয়। অন্যদিকে যদি আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমরা অর্থবছর নিরূপণ করি, তাহলে এই অপচয়ের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যদি আমরা বাংলা সালের ভিত্তিতে আমাদের আর্থিক বছর নির্ধারণ করি, তাহলে শুকনো মৌসুমেই আর্থিক বছর শুরু ও শেষ করতে পারব। মূলত ভারত ও শ্রীলঙ্কা তা-ই করেছে। যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই কারণে তাদের আর্থিক বছর পুনর্নির্ধারণ করেছিল। এরা সবাই শুকনো মৌসুমেই আর্থিক বছর শুরু ও শেষ করে। এই পদক্ষেপের ফলে বাংলা সাল জাতীয় জীবনে তার গুরুত্ব ও হৃত গৌরব ফিরে পাবে। তা না হলে পঞ্জিকা শুধু আনুষ্ঠানিক উদ্যাপনের মধ্যেই সীমিত থাকবে। আগে সমস্যা ছিল বাংলা সাল ইংরেজী সালের সঙ্গে মিলত না, কিন্তু সে সমস্যার সমাধান বাংলা একাডেমি দ্বারা গঠিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কমিটি ১৯৬৬ সালেই করে গেছে। এখন বাংলা সাল আর পরিবর্তনশীল নয়। প্রতি বছরই ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে ও ১৩ এপ্রিল শেষ হচ্ছে। সে হিসাবেই আমাদের আর্থিক বছর করা যেতে পারে। শুধু প্রথম বছরের বাজেট ১২ মাসের জায়গায় ৯ দশমিক ৫ মাসে সঙ্কুচিত করতে হবে। এছাড়া আর কোন অসুবিধা আছে বলে মনে হয় না। স্বাধীন বাংলাদেশে যদি বাংলা পঞ্জিকাকে জাতীয় জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়, তা-ই হবে বাঙালী সংস্কৃতি, ভাষা, চেতনাভিত্তিক গঠিত বাংলাদেশের আরও এক সফল উত্তরণ। তা না হলে বাংলা সাল শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যাপনের মধ্যেই সীমিত থাকবে। লেখক : ভরতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (মতামত লেখকের নিতান্তই ব্যক্তিগত)
×