ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

৭ মার্চের ভাষণের পটভূমি

ড. হারুন-অর-রশিদ

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ৭ মার্চ ২০১৮

ড. হারুন-অর-রশিদ

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কেন ‘বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ’ ৭ মার্চ ১৯৭১ বাঙালী জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। এদিন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালীর ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সমাবেশে জাতির উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ রাখেনÑ ইতিহাসখ্যাত ৭ মার্চের ভাষণ। তৎকালীন পাকিস্তানের জনগণই শুধু নয়, বিশ্বের বহু মানুষ ঔৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে ছিলÑ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে কী বলেন। ঢাকায় তখন বিদেশি সকল গুরুত্বপূর্ণ পত্রপত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিবর্গ উপস্থিত। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য সেটি ছিল অন্তিম মুহূর্ত। অপরদিকে, স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত বাঙালী জাতির জন্য ছিল পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শৃঙ্খল ছিন্ন করে জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত সংগ্রামের আহ্বান। এর পটভূমিতে ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালীর একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী দল আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বাঙালী জাতিকে সমূলে নির্মূল করার ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ। এর প্রতিবাদে একদিকে চলছিল বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারা বাংলায় সর্বাত্মক শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনÑ অপরদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ ও হতাহতের ঘটনা। ৭ মার্চ নির্ধারিত সময়ে বঙ্গবন্ধু বিক্ষোভে উত্তাল রেসকোর্সের লাখো জনতার সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন। হৃদয়ে তাঁর বাঙালীর হাজার বছরের মুক্তির আন্দোলন-সংগ্রাম ও স্বপ্ন। মাথার ওপর আকাশে ঘুরছিল পাকিস্তানী যুদ্ধবিমান। এমনি এক সন্ধিক্ষণে তিনি তাঁর ১৮ মিনিটের সংক্ষিপ্ত অথচ জগদ্বিখ্যাত ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাঙালীদের অবস্থা সবিস্তার ব্যাখ্যা, বাঙালীর জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে পূর্ণ দিক-নির্দেশনাদানের পর ঘোষণা করেন : ‘... ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে (৪৩১ খ্রিঃ পূর্ব) শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোনাল্ড রিগান-এর ১৯৮৭ সালে বার্লিন ওয়ালের সম্মুখে প্রদত্ত ভাষণ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে অধিক প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন সামরিক-বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ঔধপড়ন ঋ ঋরবষফ, ডব ঝযধষষ ঋরমযঃ ড়হ ঞযব ইবধপযবং : ঞযব ঝঢ়ববপযবং ঞযধঃ ওহংঢ়রৎবফ ঐরংঃড়ৎু শিরোনামে যে গ্রন্থ রচনা করেছেন (লন্ডন ২০১৩), তাতে অন্যান্য শ্রেষ্ঠ ভাষণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ভাষণের ইউনেস্কো-স্বীকৃতি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো প্যারিসে অনুষ্ঠিত এর দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ৩০ অক্টোবর ২০১৭ তারিখ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ^-ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা সংস্থাটির ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা/বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক দু’বছর ধরে প্রামাণ্য দালিলিক যাচাই-বাছাই শেষে ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের সম্মতিক্রমে এটি সংস্থার নির্বাহী কমিটি কর্তৃক চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর পরে হলেও জাতিসংঘের মতো বিশ্বসংস্থার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গীকৃত ৩০ লাখ শহীদ আর সম্ভ্রম হারানো কয়েক লাখ মা-বোনসহ আমাদের সকলের জন্য এটি এক মহা-আনন্দ ও বিরল সম্মানের ঘটনা। স্মর্তব্য, ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা-শহীদ দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ফলে এখন বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর নিজ ভাষার অধিকার সংরক্ষণের প্রতীক হিসেবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই ভাষা-আন্দোলনে শুধু সংগঠকের ভূমিকাই পালন করেননি, তিনি ভাষা-আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দীদেরও একজন ছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯৯২ সাল থেকে ইউনেস্কো বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে আসছে। এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা-র কথায়, ‘আমি গভীর ও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দালিলিক ঐতিহ্য ও স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য এ কর্মসূচী পরিচালিত হওয়া উচিত, যাতে করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সংলাপ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শান্তির চেতনা মনে লালন করতে পারে।’ যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধর্মীয় উন্মাদনা, লুণ্ঠন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ইত্যাদি কারণে দেশে-দেশে বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ বিনষ্ট বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। আবার সম্পদের অপ্রতুলতার কারণেও যথাযথভাবে তা সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণেও তা বিনষ্ট বা বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। এসব দিক বিবেচনায় ইউনেস্কোর এ কর্মসূচীর গুরুত্ব অপরিসীম। কেন বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ যেসব দিক বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এক অনন্য সাধারণ ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত এবং মানবজাতির অমূল্য সম্পদ হিসেবে গৃহীত, তা হচ্ছে এরূপ- এক. জাতিসংঘের বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে (১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮) ঔপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, জাতি-নিপীড়ন ইত্যাদি থেকে পৃথিবীর সর্বত্র জাতি-জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি গৃহীত ও স্বীকৃত হয়। পাকিস্তানী অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও জাতি-নিপীড়নের নিগড় থেকে বাঙালীর জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে নির্দেশিত বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ছিল ওই নীতি-আদর্শের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ; দুই. একটি রাষ্ট্রের বন্ধন ছিন্ন করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ ছিল তৃতীয় বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম নজির সৃষ্টিকারী ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল এর সকল প্রেরণার মূলে। বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত দীর্ঘ ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা রেখেও এ-কথা বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে, একটি ভাষণে (৭ মার্চ) একটি জাতি-রাষ্ট্রের (বাংলাদেশ) সৃষ্টি এবং তাও মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, যা বিশে^র ইতিহাসে নজিরবিহীন। উল্লেখ্য, ১৯৪৫ সালে ভিয়েতনামের জনগণের বিপ্লবী নেতা হো চি মিন কর্তৃক বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে তাঁর দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ফরাসি ও মার্কিন-বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নিয়ে দীর্ঘ ত্রিশ বছর যুদ্ধ শেষে ১৯৭৫ সালে তা সফলতা লাভ করে; তিন. আমেরিকার বর্ণবৈষম্যবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রিয় নেতা, বিশ্বনন্দিত মার্টিন লুথার কিং (১৯২৯-১৯৬৮)-এর মতো জনগণকে শুধু ‘ও যধাব ধ ফৎবধস’ বা একটি ‘স্বপ্নের কথা’ (দাসপ্রথা বিলুপ্তি) বলতে নয়, বরং ৭ মার্চ বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জনতার উত্তাল মহাসমুদ্রে হাজির হন বাঙালীর হাজার বছরের লালিত স্বাধীনতার স্বপ্নের বাস্তবায়ন তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামের উদাত্ত আহ্বান নিয়ে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধের, বিশেষ করে গেরিলা যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণে বাঙালীদের দিক-নির্দেশনা দান শেষে বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ছিল, ‘... ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেয়ার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা সত্ত্বেও তাঁরই নামে পরিচালিত নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাঙালীর লালিত স্বপ্ন, মহান স্বাধীনতা; চার. ঢাকায় উপস্থিত বিদেশী সাংবাদিকসহ প্রায় সর্বমহলের ধারণা ছিল, বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, যাকে বলা হয় টউও (টহরষধঃবৎধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব) ঘোষণা করবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ, অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক। স্থায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্ব রাজনীতির গতিধারা বা মেরুকরণ সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বহির্বিশ্বে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে তিনি যাতে কোনো অবস্থায় চিহ্নিত না হন, সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন সদা-সর্বদা অত্যন্ত সতর্ক। তেমনটি ঘটলে, তৎকালীন বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়তো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। তাঁর সম্মুখে দৃষ্টান্ত ছিল কীভাবে নাইজেরিয়ার বিয়াফ্রা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন (১৯৬৭-১৯৭০) আদর্শিক বিভাজন নির্বিশেষে বৃহৎ শক্তির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে কঠোরভাবে দমন করা হয়। তাই বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ছিল : মেজরিটি (বাঙালী) মাইনরিটি (পশ্চিম পাকিস্তানী) থেকে বিচ্ছিন্ন হবে কেন? বরং মাইনরিটিই ‘সিসিড’ করছে বা আক্রমণকারী এটাই বিশ্ববাসীর কাছে প্রতিভাত বা দৃষ্ট হোক; পাঁচ. বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতারই ঘোষণা। তবে বিদ্যমান বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তবতায় তিনি কৌশলের আশ্রয়ী হন- এই যা। ভাষণের শেষভাগে তিনি এমনভাবে ‘স্বাধীনতার’ কথা উচ্চারণ করেন, যাতে ঘোষণার কিছু বাকিও থাকে না, অপরদিকে তাঁর বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার (টউও) অভিযোগ উত্থাপন করাও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে আদৌ সহজ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর এ কৌশলী অবস্থান সুদক্ষ সমরকুশলীদেরও অবাক করার মতো। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ কোনক্রমে টউও হিসেবে চিহ্নিত হলে, সে অবস্থায় এটি বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো না; ছয়. বাঙালীর জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় চূড়ান্ত পর্বে এসে একটি ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যেভাবে দ্রুত তাঁর নিরস্ত্র জাতি-জনগোষ্ঠীকে তাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার স্বপ্ন অর্জনে সশস্ত্ররূপে আবির্ভূত হতে উদ্বুদ্ধ করেন, সেটিও এক বিরল ঘটনা; সাত. ৭ মার্চ এক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সর্বদিক বিবেচনায় রেখে ধীরস্থির অথচ তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু এমনি এক ভাষণ রাখলেন, যার নজির ইতিহাসে বিরল। ভাষণে একদিকে যেমন ছিল শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান, অপরদিকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাঙালীদের অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টা (‘আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি’), গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ (‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব’), মানবিকতা (‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য ...’), অসাম্প্রদায়িক আদর্শ ও সম্প্রীতি (‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে’) -ভাষণের এসব দিক তথা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দায়িত্ববোধের প্রকাশ ছিল সকলের নজর কাড়ার মতো; আট. ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে পরিগণিত অধিকাংশ নেতৃত্বের বক্তব্য যেখানে লিখিত (আব্রাহাম লিঙ্কনের ১৮৬৩ সালের বহুল উচ্চারিত এবঃঃুংনঁৎম অফফৎবংং-টি সম্পূর্ণ এবং ওয়াশিংটন ডিসির লিঙ্কন মেমোরিয়াল চত্বরে মার্টিন লুথার কিংয়ের ১৯৬৩ সালের বিখ্যাত ‘ও যধাব ধ ফৎবধস’ অফফৎবংং-টির প্রথম দিকের বক্তব্য ছিল লিখিত), সেখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অলিখিত, স্বতঃস্ফূর্ত, যা এ ভাষণকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যম-িত করেছে; নয়. বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর একাধিক ভাষায় ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এতো দীর্ঘ সময় ধরে (৪৬ বছর) পৃথিবীর কোন দেশে কোন নেতার ভাষণ সে দেশের মানুষ শ্রবণ করে আসছে কি-না সন্দেহ। এটি এমনি ব্যঞ্জনাপূর্ণ ও গীতিময় যে, যতবার শ্রবণ করা হয়, ততবারই মনে হবে এই প্রথমবার শোনা হলো, কখনও পুরনো মনে হয় না। ৭ মার্চের ভাষণের সাম্প্রতিক ইউনেস্কো-স্বীকৃতির ফলে এখন আর তা শুধু বাঙালীর নয়, বিশ্ব মানবতার জন্যও অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় এক মহামূল্যবান দলিল বা সম্পদ। গণতন্ত্র, উচ্চ মানবিকতা, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল আদর্শ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম, জাতিভেদ-বৈষম্য ও জাতি-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্ব মানবতার মুক্তির সংগ্রামে যুগে-যুগে এ ভাষণ অনুপ্রেরণা যোগাবে। সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে নবীন প্রজন্ম, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাষ্ট্রনায়ক, সমরকুশলী সবার জন্যই এ ভাষণে রয়েছে অনেক কিছু শিক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি জাতি-জনগোষ্ঠীর মুক্তির কালজয়ী সৃষ্টি, এক মহাকাব্য। বহুমাত্রিকতায় তা বৈশিষ্ট্যম-িত। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ যে এক ও অবিচ্ছেদ্য, ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে এটিই পুনর্ব্যক্ত। লেখক : উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
×