ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনী মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

শারদ উৎসব ও মানবিকতার ডাক

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

শারদ উৎসব ও মানবিকতার ডাক

আগে আমরা শরতে অরুণ আলোর অঞ্জলি দেখে বুঝতাম পূজা আসছে। মাটিতে শিশির পাতায় জল, আকাশে কুয়াশা গায়ে হালকা চাদর, মা আসছেন। মা মানে দুর্গা। যিনি দুর্গতি নাশ করেন। আর এখন বাংলাদেশে পূজা আসার পূর্বসূত্র যেন অজানা আশংকা, জঙ্গী ভীতি। এভাবেই এখন পূজাকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশ। না এটা নতুন কিছু না। স্বাধীনতার ঠিক পর পর আমি তখন গোঁফগজানো তরুণ। নিউমার্কেট এলাকায় পূজা দেখে বাড়ি ফিরছি। তখন মাত্র সন্ধ্যা। হঠাৎ দেখি লোকজন ছুটোছুটি করছে। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। প্রথমটায় না বুঝলেও একটু পর বুঝে গেলাম মূর্তি ভাঙ্গার উল্লাস আর মিছিল চলছে। আমিও মিশে গেলাম স্রোতে। কে জানে আমি হিন্দু না মুসলমান? প্রশ্ন করেছিলাম বাম ধারার নেতাকেÑ দারুণ সেই প্রশ্ন, মুক্তিযুদ্ধ যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদের লড়াই হয়ে থাকে তো একবছর যেতে না যেতে সে গাছে মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িকতার ফল ধরল কিভাবে? সে প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। এছাড়া আরও কত কা- দেখলাম পূজা নিয়ে। বছরের পর বছর রাজনৈতিক শাসন ও কোন্দলের শিকার হয়েছে পূজা। এরশাদ আমলে একরকম বেগম জিয়ার আমলে আরেক। এরশাদ আমলে নিতাই রায় বাবুরা ভাবতেন এরশাদ দুর্গার ভাই। পরে গয়েশ্বর বাবুরা বললেন নাতো। মা দুর্গা আর খালেদা জিয়ার কাছের লোক। এরপর এলো আওয়ামী আমল। আমি তখন দেশ ছেড়েছি। কি হচ্ছে না জানলেও কয়েক বছর পর একবার পূজায় গিয়ে দেখি তোরণের পর তোরণ। মনে আছে? আগে পাড়ায় মহল্লায় গলিতে গলিতে শারদীয় উৎসব লিখে ব্যানার টানানো হতো। সেবার দেখি ওমুক মেয়র তমুক নেতা অমুক লীগারের ছবির পাশে মূর্তির ছবি ঝুলছে। এতে অবশ্য হিন্দুদের কিছু যায় আসে না। প্রাচীনতম বলে অথবা অসংখ্য দেবদেবী বলে তারা ভাবে একটা পূজা গেলে আরেকটা তো আছে। তাছাড়া একদল একেকটার মান মর্যাদা নিয়ে জ্বলে উঠে বলে কিছুই দানা বাঁধে না। তাদের অনেকেই ভাবে প্রতিবাদ মানে প্রতিমাহীন পূজা। যে বছর তা হলো সে বছর আরও একধাপ এগিয়ে তখনকার সরকার ধূমধাম সহকারে বাড়তি পুলিশ লাগিয়ে বলল, কে বলে? কোন ব্যক্তি বলে পূজা হয় না? দেখ যত পূজা তত পুলিশ। এমন কাহিনী চলতে চলতে পূজা যেন বাজার আর নিজেদের ঘরোয়া আনন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে কিভাবে পূজা হবে না হবে তার নির্ধারক মূলত রাজনীতি। অবশ্য এটা এখন কেবল পূজায় নয়, ঈদের বেলায়ও সত্য। দুর্গা পূজার এই বাহ্যিক দিকগুলো বাদ দিলে আমরা দেখি ভেতরেও পরিবর্তন হয়েছে। হিন্দুরা কি কম? তারা আগের দিনে সুচিত্রা সেন বা মধুবালার আদলে প্রতিমা মানলেও এখন চায় আরও আধুনিক। সে আধুনিকতা মাঝে মাঝে উৎকট। যেহেতু গাইডলাইন হীন সেহেতু ইচ্ছেমাফিক দুর্গার আদলও একেকরকমের। এখন দেখি সামাজিক মিডিয়ায় সবাইকে অনুরোধ জানানো হয় শাস্ত্র মতে প্রতিমা গড়ার। সেটাই তো সমস্যা। শাস্ত্র মানতে গেলেই তো শুরু হবে বাদানুবাদ। তার চেয়ে ঢের ভাল নিজেদের মনের দুর্গাকে জাগিয়ে তোলা। একটা সময় ছিল যখন আমরা এসব বুঝতাম না। বুঝতাম পূজার সবকটা দিন ভোরে ঘুম থেকে জেগে খাতায় মা দুর্গার নাম লিখতে হবে একশ আট বার। এখন যে যুগ পড়েছে লিখলেই ডিলিট করে দেবে আর কেউ। আর যদি লেখেও দুঘা লিকে তাকে একশ’ আট দিয়ে গুণ করতে লিখে দেবে চতুর নতুন প্রজন্ম। আজকাল পূজা বা উৎসবে বাজারের দিকটাই প্রবল। বহুজাতিক বাজার বহুজাতিক কোম্পানির রমরমা এখন। ফলে কোন আতর কোন পারফিউম কোন সুগন্ধি কোন পোশাক চলবে তাতেই বোঝা যাবে পূজা কতটা জমজমাট। একটা বিষয় চমৎকার উৎসবের আমেজে ভাল ব্যবসা আর মুনাফা। তবে মানতেই হবে এখনও ধর্মের চেয়ে শক্তিশালী কোন অবলম্বন আসেনি। মানুষ ও প্রকৃতির এটাই তফাৎ। মানুষ যেসব জিনিস বানায় তার একটা ব্যবহারযোগ্য তারিখ বা মেয়াদ থাকে। যাকে বলি এক্সপেয়ারি ডেট। অথচ আপনি কলা বেগুন আলু পটল কোন মেয়াদের তারিখ জানেন? না আছে? এই যে মেয়াদহীন সর্বজনীনতা এর কারণে আমরা মতো অনেকেই সেই স্রষ্টার কাছে নতজানি যিনি সবপ্রশ্নের ওপরে দাঁড়িয়ে। যাঁকে আমরা বলিÑ চরণ ধরিতে দিওগো আমারে নিও না নিও না সরায়ে। দুর্গাকে আমি মানি দুটি কারণে। তাঁর দশভূজা মূর্তিটি আমার দারুণ পছন্দের। মূলত জগত সংসারে সব মা দশ হাতে কাজ করেন। তাদের কাছে আমরা কিছু না। সন্তান পরিবার সংসার সব একসঙ্গে সামলানো মায়ের হাতগুলো অদৃশ্য আর দুর্গার হাত প্রকাশ্য। দ্বিতীয় কারণটি হলো তাঁর উদারতা। যাকে তিনি বধ করলেন সেই মহিষাসুরকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন। সেই অসুরও যেন পূজা থেকে বঞ্চিত না হয়। বাহ! এই না হলে মা? সঙ্গে হয়তো দেখিবে দিতে চান দেখ বাপু তেড়িমেড়ি করলে এভাবে ত্রিশূলে গেঁথে মারব। এবার আমাদের পূজা এসেছে এক কঠিন সময়ে। পাশের দেশ মিয়ানমার আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে এক বিশাল বোঝা। প্রতিদিন অকাতরে আসছে শরণার্থী। মানুষের এই স্রোত বহন করার দায় আমাদের না হলেও বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে তাঁর ভাষণের পর যে ছয় দফা দিয়েছেন তার আলোকে সমাধান বেরিয়ে আসলেই মুক্তি। এই ছয়দফা হয়তো একদিন ইতিহাস হবে। তবে একটা কথা না বলে পারছি না এই দফায় রোহিঙ্গা মুসলমান শব্দটির পাশাপাশি হিন্দু বা পালিয়ে আসা যে কারো কথা থাকলে আরও মজবুত হতো। তারপরও এই আহ্বান এই ডাক সময়ের। এর সাথে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কন্ঠ যোগ হোক। যোগ হোক বিশ্বমানবতা। আজকাল মানবতা শব্দটি বড় ঠুনকো। তাই ভরসা রাখা কঠিন। চীন বা ভারত বিষয়টি দেখছে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। কে জানে কবে কার সুমতি হবে? আপাতত পূজার আনন্দে ভাসমান সবাইকে অনুরোধ জানাই এবার কেনাকাটা কিছুটা কম করে দেশের পাশে দাঁড়ান। মানুষের পাশে থাকার চাইতে বড় ধর্ম আর কী হতে পারে? দেশে বিদেশে বাংলাদেশীদের জৌলুস ও আড়ম্বর কিছুটা কমিয়ে সবাই এগিয়ে আসলে চাপ কমবে। বাঙালীর অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা নির্বিঘ্নে হোক। শান্তি ও কল্যাণের পাশাপাশি এবার মানবিকতায় জ্বলে উঠুক শারদীয়া।
×