ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৩০ আগস্ট ২০১৭

বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

সর্বস্তরের মানুষের অপরিসীম ত্যাগ ও জীবনের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বিশ্ব-মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। তিরিশ লাখ মানুষের জীবনদানসহ এ দেশের স্বাধীনতার জন্য সরকারী হিসেবে দুই লাখ, বেসরকারী হিসেবে প্রায় পাঁচ লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন। পনের লাখেরও বেশি মানুষ পাকিস্তানী সামরিক জান্তা এবং তাদের সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি দলের বিভিন্ন ঘাতক বাহিনীর হাতে নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এক কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে শরণার্থীর বিড়ম্বিত জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। দেশের অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত ছিলেন প্রায় তিন কোটি মানুষ। স্বাধীনতার জন্য বিশ্বের অন্য কোন দেশের মানুষ এত জীবনদান, নির্যাতন ও ত্যাগ স্বীকার করেননি। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এরই ভিত্তিতে এক পক্ষকাল সময়ের ভেতর ’৭১-এর ১০ এপ্রিল প্রণীত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যা ছিল নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনগত ভিত্তি। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি ভূ-খণ্ড লাভ কিংবা পতাকা বদলের জন্য হয়নি। ৯ মাসব্যাপী এই যুদ্ধ ছিল প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধ। দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সার্বিক মুক্তির আশায়। জনগণের এই আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধানে। পাকিস্তানী শাসকচক্র ২৪ বছরের শাসনকালে বাঙালীর যে কোন ন্যায়সঙ্গত দাবি ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করেছে ধর্মের দোহাই দিয়ে। এদেশের মানুষের সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন অথবা স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল পাকিস্তানের বিবেচনায় ইসলামবিরোধী ও ভারতের চক্রান্ত। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের। জন্মলগ্নেই এই কৃত্রিম অস্বাভাবিক রাষ্ট্রটির মৃত্যুঘণ্টা বেজেছিল যখন ’৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান আইনসভার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছিলেন। কারণ, বাংলা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবির ভেতর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বিচ্ছিন্নতা ও ভারতের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে তাঁকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিল। ধর্মভিত্তিক কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তান সম্পর্কে বাঙালীর মোহভঙ্গ হতে সময় লেগেছিল মাত্র সাত মাস। ’৪৮-এর মার্চে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঢাকা সফরে আসেন, তখন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকে বঙ্গবন্ধু কিভাবে এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিভাবে তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক ভিত এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন নির্মাণ করেছেন তার কিছু বয়ান পাওয়া যাবে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’য়। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে আন্দোলনের সূচনা হয়, ’৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে তার চূড়ান্ত রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি রফিক, জব্বার ও বরকতসহ অগণিত ভাষা শহীদের আত্মদানে। এই ভাষা আন্দোলনের পলল জমিতে বেড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নব আঙ্গিকে বাঙালী জাতীয়তাবাদ। বাঙালিত্বের পরিচয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে বেড়ে উঠলেও অচিরেই বাংলার রাজনীতিও এই চেতনার আলোয় উদ্ভাসিত হয়। ইউরোপে জাতীয়তাবাদকে মূল্যায়ন করা হয় সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক চেতনা হিসেবে। ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছে। হিটলারের নাৎসিবাদের জন্ম হয়েছিল জার্মান জাতীয়তাবাদের উগ্রতা থেকে। এই জাতীয়তাবাদের প্রধান প্রতিপক্ষ সেমেটিক ইহুদীরা হলেও যা কিছু প্রগতি ও উদারনৈতিকতার সমার্থক সবই নাৎসিদের আক্রমণের লক্ষে পরিণত হয়। আধুনিক বাঙালী জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক উন্মেষ ঘটেছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে। বাঙালিত্বের চেতনা মূর্ত হয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে ও অন্যান্য রচনায়। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি,’ ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘স্বার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’Ñ প্রভৃতি গানে বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা নানারূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। নাৎসি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাঙালী জাতীয়তাবাদ সব সময় বিদ্বেষ নয় সম্প্রীতির কথা বলেছে। সাত শ’ বছর আগে বাংলার কবি চণ্ডিদাস লিখেছিলেনÑ ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ দেড় শ’ বছর আগে বাংলার আরেক মরমী কবি লালন শাহ লিখেছেন; ‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ আর খ্রিস্টান/ জাতিগোত্র নাহি রবে।’ প্রায় এক শ’ বছর আগে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন/ কাণ্ডারী বলে ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।’ বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূলভিত্তি ছিল এই অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী বাঙালী জাতীয়তাবাদ। পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাঞ্জাবী শোষক চক্র বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক শোষণের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। ২৩ বছরের সীমাহীন শোষণে পশ্চিম পাকিস্তানের উষর মরুভূমি হয়েছে শস্য শ্যামল এবং সোনার বাংলা পরিণত হয়েছিল শ্মশানে। সোনার বাংলা শ্মশান কেন এই প্রশ্নের উত্তর বাঙালী খুঁজে পেয়েছে মধ্য ষাটে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফায়। বাঙালীর জাতিরাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়েছে ’৭০-এর নির্বাচনে। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয় পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সকল হিসাব ও চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়েছিল। ’৭০-এর নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতাকে দলের অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ষাটের দশকে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনে বামপন্থীদের ব্যাপক প্রভাব সমাজতন্ত্রের ধারণা জনপ্রিয় করেছে। বঙ্গবন্ধু নিজেও বিশ্বাস করতেন শোষিতের গণতন্ত্র এবং শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থায়। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’য় সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার বার বার মূর্ত হয়েছে। পাকিস্তানকেন্দ্রিক বাইশ পরিবারের নির্মম শোষণ থেকেই সাধারণ বাঙালীর চেতনায় শোষণহীন সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন বিকশিত হয়েছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা, বাঙালী জাতিসত্তার বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং বাংলাদেশে গণহত্যার প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে যখন বঙ্গবন্ধু ’৭১-এর ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণে ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবার আহ্বান জানান। ৭ মার্চের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব।’ তারপরই বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই একটি আহ্বান সমগ্র জাতির চেতনায় স্বাধীনতা ও শোষণ-পীড়ন মুক্তির যে বোধ সঞ্চারিত করে তা মূর্ত হয়েছে পরবর্তী ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে, যা ছিল সার্বিক অর্থে একটি গণযুদ্ধ। বাংলাদেশকে স্বাধীন করবার প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু অনেক আগেই নিয়েছিলেন এবং সমগ্র বাঙালীকে জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। জন্মের পর থেকেই পাকিস্তান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শাসিত হয়েছে উর্দিপরা জেনারেলদের দ্বারা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বারবার প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যূত করা হয়েছে। যে কারণে গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা এদেশের মানুষের মনে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। ’৭০-এর নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়ী হওয়ার পরও যখন পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি তখন এটা আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানে কখনও গণতন্ত্র সম্ভব নয়। বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকল বাংলাভাষী মানুষ এই জাতীয়তাবাদকে অবলম্বন করে একজোট হয়েছে। এভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার বোধ নতুন মাত্রায় বাঙালীকে উজ্জীবিত করেছে। সমাজতন্ত্রের চেতনা এসেছে শোষণমুক্তির চিরন্তন আকাক্সক্ষা থেকে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক প্রেরণা হিসেবে যে সব মূল্যবোধ ও স্বপ্ন যুদ্ধরত বাঙালীকে তাড়িত করেছে ’৭২-এর সংবিধানে তা মূর্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সামরিকজান্তা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত রাখবার জন্য নৃশংসতম গণহত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, নির্যাতন ও জনপদ ধ্বংসসহ যাবতীয় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। তাদের এই নৃশংসতার প্রধান দোসর ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম নামক উগ্র মৌলবাদী ও ধর্মব্যবসায়ীদের দল। ইসলামের দোহাই দিয়ে এসব দল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে যেভাবে গণহত্যা ও নারীনির্যাতনসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞে প্ররোচিত করেছেÑ নিজেরাও উদ্যোগী হয়ে গঠন করেছে ‘শান্তি কমিটি’, ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’, ‘আলশামস’ প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী। এসব ঘাতক দলের নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বাঙালীদের হত্যা করতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং দলের কর্মীদের প্ররোচিত করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে সেই সময় প্রকাশিত জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’-এর প্রতিদিনের পাতায়। জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম পাকিস্তানকে ইসলামের সমার্থক বানিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তান না থাকলে দুনিয়ার বুকে ইসলামের নাম নিশানা থাকবে না। পাকিস্তান রক্ষার দোহাই দিয়ে জামায়াতীরা তখন যাবতীয় গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করেছে ইসলামের নামে। এভাবেই তারা ইসলামকে হত্যা, ধর্ষণ নির্যাতন ও ধ্বংসের সমার্থক শব্দে পরিণত করতে চেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমান যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন তারাও জামায়াতের গণহত্যা ও নারীনির্যাতনের ইসলাম ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন। রণক্ষেত্রে বহু মুক্তিযোদ্ধা ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ রণধ্বনির সঙ্গে ‘আল্লাহু আকবর’ও বলেছেন। কিন্তু তারা ইয়াহিয়া-গোলাম আযমদের ইসলামের নামে আহাজারির প্রতি কর্ণপাত করেননি। পাকিস্তানের ৯০ হাজারেরও বেশি নৃশংস সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়েও জামায়াতীরা তাদের প্রাণপ্রিয় পাকিস্তান রক্ষা করতে পারেনি। পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা তালিকা তৈরি করে শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যা করেছে। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগেই জামায়াতের শীর্ষ নেতারাÑ যারা সুযোগ পেয়েছিলেন পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন, অন্যরা দেশের ভেতর আত্মগোপন করেছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশে ধর্মব্যবসায়ী জামায়াতীদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছিল। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বদেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লীতে যাত্রাবিরতিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর জন্য এক বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। এই সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধীÑ দুজনের ভাষণই ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহান বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জনগণের উদ্দেশে বলেছিলেনÑ আমি আপনাদের তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আমার প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের শরণার্থীদের আমি সসম্মানে ফেরত পাঠাব। আমার দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে আমি সবরকম সহযোগিতা করব। আমার তৃতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল শেখ মুজিবকে আমি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের করে আনব। আমি আমার তিনটি প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছি। শেখ সাহেব তাঁর দেশের জনগণকে একটিই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেনÑ তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দেবেন। তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাকে বলা হয়েছে ভারতের সঙ্গে আপনার কিসের এত মিল? আমি বলেছি, ভারতের সঙ্গে আমার মিল হচ্ছে নীতির মিল। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায়। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীও তাই বিশ্বাস করেন। আমাদের এই মিল হচ্ছে আদর্শের মিল, বিশ্বশান্তির জন্য...। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু একই দিনে দেশে ফিরে রমনার বিশাল জনসমুদ্রে আবারও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’ ১৯৭২-এর ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের গণপরিষদের প্রস্তাবক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল গণপরিষদ, যাদের দায়িত্ব ছিল সংবিধান প্রণয়ন। বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ছিলেন। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর ন্যাপ) থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ’৭২-এর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসের প্রথমবার্ষিকীর দিন। ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান গণপরিষদে উত্থাপন করা হয় এবং বিস্তারিত আলোচনার পর ৪ নবেম্বর তা গৃহীত হয়। ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদের সদস্যবৃন্দ এই সংবিধানে স্বাক্ষর প্রদান করেন। ’৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে। এই সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ধর্মপালন ও প্রচারের অবাধ স্বাধীনতা ছিল। বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর মুসলমানপ্রধান দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শের এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাঁদের ’৭২-এর সংবিধান রচনার দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন তাঁদের সামনে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সংবিধান। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংবিধানসমূহ তাঁরা অধ্যয়ন করেছেন। তাঁরা পর্যালোচনা করেছেন এসব সংবিধানের সবলতা ও দুর্বলতা। লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের জন্য শ্রেষ্ঠতম সংবিধানটি তাঁরা রচনা করবেন। শুধু বিভিন্ন দেশের সংবিধান পর্যালোচনা নয়, জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাসহ মানবাধিকার সংক্রান্ত অন্যান্য দলিলসমূহের আলোকে আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ শীর্ষক অধ্যায়ে ২১টি অনুচ্ছেদ রয়েছে একাধিক উপচ্ছেদসহ। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে ‘রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি’ শীর্ষক অধ্যায়ে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যাসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মালিকানার নীতি, কৃষক শ্রমিকের মুক্তি, মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা, সুযোগের সমতা, নাগরিক ও সরকারী কর্মচারীদের কর্তব্য, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, জাতীয় সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন বিষয়ক বিধিমালায় একটি প্রগতি ও শান্তিকামী আধুনিক রাষ্ট্রের যাবতীয় অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে। সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের কারণে মালিকানার নীতির ক্ষেত্রে ১৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টনপ্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ এবং এই উদ্দেশ্যে মালিকানা ব্যবস্থা নিম্নরূপ হইবে : ক. রাষ্ট্রীয় মালিকানা, অর্থাৎ অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্র লইয়া সুষ্ঠু ও গতিশীল রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারী খাত সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা, খ. সমবায়ী মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে সমবায়সমূহের সদস্যদের পক্ষে সমবায়সমূহের মালিকানা এবং গ. ব্যক্তিগত মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তির মালিকানা।’ বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুসৃত হলে নিঃসন্দেহে আমাদের স্থান আজ উন্নত দেশসমূহের পঙ্ক্তিতে স্থান পেত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থনদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন, শোষণ ও পীড়নের বিরুদ্ধে অব্যাহত সংগ্রাম ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশ মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না এ বিষয়েও ’৭২-এর সংবিধান প্রণেতারা সচেতন ছিলেন। ষাটের দশক থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনায় সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরোধিতার পাশাপাশি বিশ্বশান্তির প্রতি সুচিন্তিত বক্তব্য পাওয়া যাবে তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থ দুটিতে। ’৭২-এর ৪ নবেম্বর গণপরিষদে গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এই সংবিধান যে সমগ্র বিশ্বের যাবতীয় সংবিধানের ভেতর অনন্য স্থান অধিকার করে আছেÑএ কথা পশ্চিমের সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও স্বীকার করেছেন। বিশ্বের কোন দেশ কতটুকু সভ্য ও আধুনিক তা বিচার করবার অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ-গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সেই দেশটির সাংবিধানিক অঙ্গীকার এবং তার প্রয়োগ। বিশ্বের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানের জনক হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- যে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল ১৭৭৬ সালে। মানবাধিকার শব্দটিরও জন্মদাতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এই যুক্তরাষ্ট্রের একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ‘সেন্টার ফর ইনক্যয়ারি’র পরিচালক ড. অস্টিন ডেসি বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ হিসেবে বাংলাদেশের ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠনের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানেও নেই। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় মৌলবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হচ্ছে।’ চলবে...
×