ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

রাজদূতের সভা ও বিদেশের বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৪ জুন ২০১৬

রাজদূতের সভা ও  বিদেশের বাংলাদেশ

এখন অষ্ট্রেলিয়ায় শীতকাল। জমাট ঠা-া পড়ছে সিডনিতে। প্রয়োজন না হলে সপ্তাহান্তের আগে অফিস আর বাড়ি ছাড়া কোথাও যাওয়া হয় না। হঠাৎ করে দূতাবাসের ফোন, সঙ্গে স্থানীয় এক অনুজ মোহাম্মদ আলী শিকদারের দাওয়াত। বিষয়টা ভাবনার, মতবিনিময় হবে রাজদূতের সঙ্গে। ভদ্রলোক দায়িত্বভার নেয়ার পর দু’একবার কথা হলেও সেভাবে মতবিনিময় করা হয়ে ওঠেনি। নিয়মমতো জাতীয় দিবসগুলোর নিমন্ত্রণপত্র পেলেও ছুটির দিনে পড়ে না বা অন্যান্য পারিবারিক কারণে সাড়ে তিন ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ক্যানবেরা যাওয়া হয়ে ওঠে না। ফলে এবার তাদের আমন্ত্রণ পেয়ে মনে হলো যাওয়া যেতেই পারে। শীতার্ত বিকেল এখানে প্রায় সন্ধ্যা। উদ্যোক্তারা যে সময়টা বলেছিলেন তার প্রায় এক ঘণ্টা পর অতিথিরা এসে পৌঁছালে স্বাভাবিক কারণে মন হয়ে উঠেছিল বিদ্রোহী। এটা তো এখানকার নিয়ম না। এখানে আমরা এক মিনিট দেরিতে অফিসে যাই না। কোন পার্টি বা সাদাদের সঙ্গে কোন প্রোগ্রামে দেরি করি না। তবে এ বেলায় কেন? কিন্তু অভিমান বা রাগ বেশি সময় টিকল না। প্রাণবন্ত আড্ডা আর সিডনিবাসী বাংলাদেশীদের প্রশ্নবাণে অনুষ্ঠানটি হয়ে উঠেছিল উষ্ণ আর জমজমাট। রাজদূতের কাছ থেকে অনেক তথ্য জানা গেল। এদেশে কিভাবে বাংলাদেশের মানুষ আরও বেশি আসতে পারে বা কোন ভিসার কি গুরুত্ব সেখানে দূতাবাসের কি ভূমিকা এসব নিয়ে দারুণ সব আলাপ হলো সে রাতে। আমি তা নিয়ে লিখতে চাই না। ভাবনা ও বিশ্বাসে বাংলাদেশের দূতাবাসের যে চেহারা হওয়া উচিত তা কি আসলে আমরা দেখতে পাই? আর যদি না পাই তো এর জন্য কি দূতাবাস দায়ী? আমি তা মনে করি না। বিষয়টি নির্ভর করছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দলগুলোর ওপর। যে দুটো বড় দল ঘুরে-ফিরে দেশ শাসনে আসে তাদের নেতারা দেশের চেয়ে দলের কথা বেশি ভাবেন আর সেভাবে কাজ করেন বলে ইতিহাস এখনও দোদুল্যমান। এদেশের ইতিহাসের বীর সেনানীদের নিয়ে যে তর্ক যে দ্বন্দ্ব তার কি নিষ্পত্তি হয়েছে আদৌ? যতদিন না হবে ততদিন বাইরের দূতাবাসে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা থাকবেই। তাঁরা চাকুরে, সরকারী কাজ করেন। দল করা তাঁদের কাজ না। কিন্তু দল চাইলেই তাদের সাইজ করতে পারে। করেও। কে চায় তার চাকরিজীবন হোক উদ্বিগ্নতায় ভরা? কে তাদের গ্যারান্টি দেবে সরকার পরিবর্তন হলে তাদের গায়ে আঁচড় পড়বে না? ফলে তারা শোক দিবসে যেমন কালো কোট গায়ে চাপিয়ে জাতির জনকের প্রতি নিবেদিত থাকেন, তেমনি জিয়াউর রহমানের জন্য তৈরি থাকতে হয় তাদের। প্রতিবেশী কোন দেশের বেলায় এমন কোন ঝামেলা নেই। তাছাড়া আছে সরকারী দলের উৎপাত। কত ধরনের আবদার কত জাতীয় মানুষের আগমন-প্রস্থান সব তাদের সামাল দিতে হয়। বলতে চাইছি এসব উটকো ঝামেলা কাজকর্মকে শ্লথ করে। থামিয়ে দেয়। ইদানীং একটা উপদ্রব অবশ্য কমেছে। এই সেদিনও যে কোন অজুহাতে দূতাবাস ঘেরাও করার নামে আত্মহননের খেলা চলত। লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে যানবাহন ভাড়া করে ক্যানবেরা গিয়ে দূতাবাসকে অসম্মান করার ভেতর দিয়ে কোন কিছু অর্জন না হলেও এ প্রক্রিয়া চলত সমানে। বিদেশীদের কাছে নিজেদের হেয় করার এই প্রবণতা যেন আর ফিরে না আসে। রাজদূত যখন এক এক করে আমাদের দেশের সাফল্য ও দূতাবাসের ভূমিকা তুলে ধরছিলেন, আমি ভাবছিলাম আজ যে আমরা নিজেদের মান সম্মান নিয়ে ভাবছি, কথা বলছি এর পেছনে কত মানুষের ত্যাগ কত মানুষের অবদান লুকিয়ে আছে। আমরা যে দেশের অভিবাসী, যে দেশের নাগরিক, নানা পরিচয়ে এদেশে বসবাস করছি সে মাটিতেই শুয়ে আছেন একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড। এ ভদ্রলোক তখন ঢাকায় বাটার সিইও। কি করেননি তিনি? মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেয়া, সাহায্য করার পাশাপাশি নিজেও জানবাজি রেখে লড়াই করেছিলেন। মতবিনিময় অনুষ্ঠানটিতে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল আমার। কেন জানি ওডারল্যান্ডের কথা বলা হয়নি। বলতে পারলে ভাল লাগত। কৃতজ্ঞতাও জানানো হতো তাঁকে। সেদিনের মতবিনিময় সভার রাজদূত কাজী ইমতিয়াজ হোসাইন গুরুত্ববহ কয়েকটি কথা বলেছেন। বিদেশে কার্গো পরিবহনে যে অসুবিধা তার উৎসও দেশ। এ রকম অনেক বিষয় জটিলতার জট খুলতে হবে দেশ থেকে। তবে অবাক হয়েছি এই জেনে, অস্ট্রেলিয়ায় কত বাংলাদেশী আছেন তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নাকি দূতাবাসেরও জানা নেই। এ কাজটি কঠিন নয়। চাইলেই করা যেতে পারে। যেমন কঠিন নয় সব মত ও দলের লোকদের এক সূত্রে এক মঞ্চে নিয়ে আসা। সেদিন তাই হয়েছিল। দল মত রাজনীতি নির্বিশেষে এক মঞ্চে বসেছিলাম আমরা। বিদেশে বাংলাদেশের ছবিটা তো এমনই হওয়া উচিত।
×