ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

খন্দকার ইসমাইল

শান্তিবাহিনীর অস্ত্রসমর্পণের স্মৃতি-২

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ২৯ জানুয়ারি ২০২২

শান্তিবাহিনীর অস্ত্রসমর্পণের স্মৃতি-২

(গতকালের পর) আমি প্রায় সময় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ভাবি। প্রতিদিন আমাদের দেশে এখানে-সেখানে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছেই। কত নারী, পুরুষ, শিশু মারা যাচ্ছে। আমরা কেউ তাদের খোঁজখবর রাখি না। এ বিষয়টা আমরা কখনই ভাবি না যে, একটা পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী পুরুষ বা মহিলাটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে পরবর্তীতে ওই পরিবারের কী করুণ অবস্থা হয়? প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গাড়ি চলছে, হঠাৎ চোখে পড়ল ‘বিধ্বস্ত সেতু ধীরে চালান। সড়ক ও জনপথ বিভাগ।’ দুঃখ হলো সেতু বিধ্বস্ত অথচ মেরামত করা হচ্ছে না। গাড়ি চলছে- সড়ক ও জনপথ বিভাগের আরেকটি লেখা চোখে পড়ল ভাষাগত চমৎকারিত্বের জন্য- ‘একেবারে না যাওয়ার চেয়ে দেরিতে যাওয়া ভাল।’ লেখাটি দেখে চালককে আস্তে চালাতে বললাম। ফেনী পার হয়ে আমরা রামগড় দিয়ে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। রামগড়ে চুক্তিবিরোধী ৮/১০টি কালো পতাকা চোখে পড়েছে। কিছুদূর যাওয়ার পর অনেক সাদা পতাকা চোখে পড়ল। শঙ্কামুক্ত হলাম। আগে কখনও খাগড়াছড়ি যাইনি। অনেকগুলো পাহাড়, টিল উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে আমরা খাগড়াছড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি। ভীষণ ভাল লাগছে। হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল। ড্রাইভার বললেন, এটা সবচেয়ে বড় পাহাড়। এ পাহাড়ের ওপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হবে। গাড়ির পানি শেষ। ইঞ্জিন গরম। ঠা-া না হওয়ার আগে যাওয়া যাবে না। আরও ৭/৮ মাইল পথ বাকি। আমাদের সঙ্গে অন্যরা আগেই চলে গেছে। কি করি, কোথায় পানি পাব! হাসান ভাই, হারুন আমরা সবাই চিন্তিত। ১০/১৫ মিনিট পর রোডস এ্যান্ড হাইওয়ের ২টি ট্রাক আমাদের ক্রস করে যাওয়ার সময় হাসান ভাইকে দেখেই গাড়ি থামাল। হাসান ভাইকে তারা সবাই চেনে, তাদের পছন্দের শিল্পী, কিন্তু আমি বা হারুন স্যারকে কেউ চেনে না। তারা গাড়ি থামিয়ে আমাদের গাড়ির জন্য পানি এনে দিল দুই বালতি। আধাঘণ্টা পর আমাদের গাড়ি পাহাড়ের ওপর দিয়ে যাত্রা শুরু করল। পাহাড়ের ওপর থেকে পুরো খাগড়াছড়ি শহরের নবনির্মিত স্টেডিয়াম দেখতে পেলাম। হাসান ভাই এই পাহাড়ী এলাকার তার চলচ্চিত্র জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। খাগড়াছড়ি শহরে ঢুকতেই ট্রাফিক আমাদের গাড়ি থামাল। দূরেই দেখতে পেলাম ৩/৪টি আর্মির গাড়ি, আর তার পেছনে আসছে ১৪/১৫টি বড় বাস। কাছাকাছি আসতেই তারা হাত বাড়াল, আমরাও হাত উঁচিয়ে তাদের অভিবাদন জানালাম। তারাই জনসংহতি সমিতির সদস্য। আগামীকাল অস্ত্র জমা দেবে। তাদের পেছন পেছন আমাদের গাড়িও চলল। তারা স্টেডিয়াম অভিমুখী, আমরা প্রেসক্লাব। বিকেল ৫টায় প্রেসক্লাবে গিয়ে দেখি আগামীকালের অনুষ্ঠান সম্পর্কে সাংবাদিকদের মাঝে মতবিনিময় হচ্ছে। আমরাও যোগ দিলাম। সেখানে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সায়িদ, বিটিভির ডিজি সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, ডিডিজি মোস্তফা কামাল সৈয়দ ও বেতারের ডিজি এম আই চৌধুরীসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা থেকে আমরা যে ক’জন রওনা দিয়েছিলাম প্রেসক্লাবে সবাই একত্রিত হলাম। এবার আমাদের জন্য থাকার জায়গা খোঁজা শুরু হলো। তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সায়িদের নেতৃত্বে একটি বাসা দেখতে গেলাম। উল্লেখ্য, ১০ তারিখের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে সব সরকারী কোয়ার্টার খালি করা হয়েছিল। কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়ি, নানার বাড়ি, দাদার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের এই সাময়িক কষ্টের জন্য আমরা দুঃখিত। যাহোক দোতলা বাড়িতে আমরা সবাই গেলাম। সবারই মোটামুটি পছন্দ হয়েছে। বাদ সেধেছেন ছটলু ভাই (আলী যাকের)। সমস্যা একটা, তাঁর হাই কমোড চাই। স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে খোঁজা শুরু হলো হাই কমোডওয়ালা বাসা। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোথাও পাওয়া গেল না। এরই মধ্যে রাত ৮টা বেজে গেল। পরে আলী যাকের, রুনু ভাই (আবেদ খান) এবং শাহরিয়ার কবির হাই কমোডের সন্ধানে সম্ভবত রাঙ্গামাটি চলে গেলেন। আমি, হাসান ভাই, ড. হারুন থেকে গেলাম অন্য একটি দোতলা বাড়ির নিচতলায়। দুটো রুম তিনটি খাট। হাসান ভাই সিনিয়র মানুষ, উনাকে একটা বাথরুমসহ সিঙ্গেল রুমটি দিয়ে আমি ও ড. হারুন ভাই অন্যটি নিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে রুমে গল্প করতে বসলাম। এর মধ্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের খোঁজ নিলেন। পাশের বাসায় স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার থাকেন। তিনি তার বাচ্চাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। ২ ছেলেমেয়ে। ছোট ছেলের বয়স ৭/৮ বছর, মেয়েটি সম্ভবত দশম শ্রেণীর ছাত্রী। হাসান ভাই একজন বড় মাপের শিল্পী। মেয়েটি হাসান ভাইকে দেখে ভীষণ খুশী হলো। আর আমাকে অনুষ্ঠান ঘোষণায় দেখেছে বলে জানাল। মেয়েটি ছোটবেলায় ভাল নাচ করত। বছর দুয়েক আগে ছাদ থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছে, এখন আর নাচতে পারে না- হাসান ভাইকে জানাল। হাসান ভাই চা খেতে চাইলেন, সঙ্গে সঙ্গে চা করতে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর গাড়ি আসবে আমাদের সার্কিট হাউসে নিয়ে যাবে। ডিনার ও মিটিং হবে। এরই মধ্যে হাসান ভাইকে বলে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যেতে চাইলাম। ঢাকা থেকে শুনেছি এখানে সুন্দর সুন্দর উপজাতীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায়। হাসান ভাই বললেন-‘খন্দকার We Are On Duty, তাড়াতাড়ি চলে এসো’। আমাদের রেস্ট হাউস থেকে আধা কিলোমিটারের কম দূরে শহরের বেশ কয়েকটি ভাল দোকান। সেখানে যাব। সঙ্গে নিচ্ছি আমাদের কেয়ার টেকার চান্দুকে (চাকমা)। দ্রুতগতিতে ছুটলাম দোকানে। একটা দোকানে ঢুকতেই মনে হলো আমি ঢাকার কোন দোকানে। আমার সামনেই নৃত্যশিল্পী নীপা, শিবলীসহ আরও অনেকে। আগামীকাল স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানে তারা নাচ পরিবেশন করবেন। তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে কেনাকাটায় মনোযোগ দিলাম। সময় বয়ে যাচ্ছে, হাসান ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে, তাড়াতাড়ি রুমে ফিরতে হবে। একটা বেডশিট, মেয়েদের একটা জামা আমি পছন্দ করলাম। ভাবলাম জুতো ছাড়া বাকি জিনিসগুলো খাগড়াছড়িতে তৈরি। প্যাকেট করার পর দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম এগুলো এখানেই তৈরি তো? দোকানি বলল এগুলো কুমিল্লা থেকে আনা খদ্দেরের তৈরি। মনে বড় দুঃখ পেলাম। কি আর করা প্যাকেটগুলো নিয়ে দ্রুত রুমে ফিরলাম। রুমে গিয়ে দেখি হাসান ভাই, ড. হারুন নেই। গাড়ি এসেছে, আমার জন্য ১০ মিনিট অপেক্ষা করে চলে গেছেন। আমি পোশাক বদলিয়ে রিক্সাযোগে সার্কিট হাউস যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়ে দেখি একজন ম্যাজিস্ট্র্রেট এসেছেন গাড়ি নিয়ে আমাদের খোঁজ নিতে। তাঁর সঙ্গে সার্কিট হাউসে গেলাম। অনিচ্ছাকৃত বিলম্বের জন্য হাসান ভাইকে স্যরি বললাম। হাসান ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে কনফারেন্স রুমে ডাক পড়ল। সেখানে উপস্থিত আছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও অন্যান্য উর্ধতন কর্মকর্তা, সঙ্গে সৈয়দ হাসান ইমাম, ড. হারুনুর রশিদ ও আমি। আলোচ্য বিষয় আগামীকাল অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, বর্ণনা করবেন সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী যাকের (ইংরেজীতে), শাহরিয়ার কবির, আবেদ খান ও ড. হারুন। মিটিং শেষে সার্কিট হাউসে ডিনার শেষ করে রাত ১১:৩০ মিনিটে রুমে গেলাম। আমাদের আধঘণ্টা আলোচনার পর হাসান ভাই ঘুমাতে গেলেন। ড. হারুন তাঁর বক্তব্য তৈরিতে ব্যস্ত। আমি ধারাবাহিকভাবে পুরো অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট তৈরি করি। উদ্দেশ্য আগামীকাল আমাদের অনুষ্ঠান ভাল করতে হবে। সারাদেশের মানুষের দৃষ্টি খাগড়াছড়িতে। সরাসরি সম্প্রচার হবে। এতটুকুু ভুল করা চলবে না। আমার স্ক্রিপ্ট হারুন স্যারকে শোনালাম। স্যারেরটা আমি শুনলাম। রাত প্রায় দেড়টার দিকে শুয়ে পড়লাম। মশক সঙ্গীত ও নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য বেশ কয়েকবার স্প্রে করা হলো। ওখানকার মশাগুলোর জীবনীশক্তি অনেক বেশি, হতে পারে পাহাড়ী ট্রেনিংপ্রাপ্ত। কারণ স্প্রে করার পর মশাগুলো সেন্সলেস হয়েছিল, ঘণ্টা দুয়েক পর আবার শুরু করে আক্রমণ। আবার স্প্রেতেও ভেজাল থাকতে পারে। কিন্তু ভেজাল নেই মশার কামড়ে। যাই হোক শান্তি চুক্তির বিষয় মশারা জানে না। কাজেই অশান্তি করার অধিকার তাদের আছে। সকাল ৭টায় ঘুম থেকে তিনজনই উঠে তৈরি হলাম। পাশের বাসার হেডমাস্টারের সেই মেয়েটি আবারও চা করল। আমার ব্যাগে বিস্কুট ছিল, সেটিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সার্কিট হাউসে গেলাম। সেখানে নাস্তার বিরাট আয়োজন। ড. হারুন বললেন, হাসান ভাই আর না খেলে চলবে। হাসান ভাই হাসতে হাসতে বললেন, ‘আরে ভাই খেয়ে নিন, সময়মত উটের মতো কাজে লাগাবে।’ আমি অবশ্য খাওয়ার পক্ষেই ছিলাম। নাস্তার টেবিলে বসলাম, পরটা, ডিম, ভাজি, পাউরুটি। তৈলযুক্ত পরটা না খেয়ে তিনজনই পাউরুটি, ভাজি, ডিম নিলাম। ড. হারুন ১টা ডিম, ভাজি, পাউরুটি নিলেন, হাসান ভাই আবার ডিমের কুসুম খান না। সাদা অংশ নিয়ে আমাকে দুটো ডিমের কুসুম দিলেন। নাস্তার পর রওয়ানা করলাম স্টেডিয়ামে। পথে পথে হাজার হাজার নারী-পুরুষের ভিড়ে, অতিকষ্টে ধীরে ধীরে আমাদের গাড়ি স্টেডিয়ামের গেটে পৌঁছাল। চারদিক থেকে মানুষ ছুটে আসছে জোয়ারের মতো। উৎসবমুখর পরিবেশ। (চলবে) লেখক : টেলিভিশন উপস্থাপক নির্মাতা ও নির্দেশক
×