ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী

আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ২৮ জানুয়ারি ২০২২

আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার

সামাজিক ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা সংরক্ষণের তাগিদে আমরা ন্যায়বিচার শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। পৃথিবীর আদিকাল থেকে এক সময় যা ন্যায়বিচার বলে বিবেচনা করা হয়, তা হয়তো অন্য সময়ে একইভাবে বিবেচনা নাও হতে পারে। সে কারণে ন্যায়বিচার শব্দের আপেক্ষিকতা স্থান, কাল ও সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। গ্রীক দার্শনিক এ্যারিস্টটলের মতে, ‘যে ব্যক্তি দেশের আইন লঙ্ঘন করে অথবা তার যা প্রাপ্য তার চেয়ে বেশি গ্রহণ করে, সে অন্যায়কারী অথবা ন্যায়বিচার বিরোধী।’ উল্লিখিত গুণাবলী নিয়ে কোন মানুষ ন্যায়বিচারের ধারণা করতে পারে না। অবিচার থেকে ন্যায়বিচারের প্রয়োজন সহজে অনুভব করা যায়। আইন পদ্ধতির মৌলিক বিধি উপেক্ষা করে কোন ব্যক্তিকে তার জানমাল ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যায় না। যে আইন পদ্ধতিতে ন্যায়পরতার ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বিধি অনুসরণের নিশ্চয়তা থাকে না, তা থেকে নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষিত হয় না। নির্বাহী কর্তৃপক্ষ ও আইন পরিষদের যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ প্রতিরোধকল্পে সংবিধানে ন্যায়বিচারের বিধান করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের জীবন ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্মের পর, ১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর আমাদের মহান জাতীয় সংসদে অনুমোদিত বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ Further pledging that it shall be a fundamental aim of the State to realise through the democratic process- a socialist society, free from exploitation a society in which the rule of law, fundamental human rights and freedom, equality and justice, political, economic and social, will be secured for all citizens, যা ঐ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের শাসনের মূল দর্শন হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে। ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। All citizens are equal before law and are entitled to equal protection of law. যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং বাংলাদেশের ন্যায় অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে আইনানুগ ন্যায়বিচার মূল দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ, আইন পরিষদ ও নিম্ন আদালতসমূহের যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ থেকে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মর্যাদা রক্ষার এটাই একমাত্র রক্ষাকবচ। মানুষের জন্যই সরকার, মানুষ সরকারের জন্য নয়, এই মতবাদ থেকে আইনানুগ ন্যায়বিচার নীতি জন্মলাভ করেছে। এই নীতি অনুসারে জনগণ নির্দিষ্ট আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আগেকার দিনে রাশিয়া, চীন ও স্পেনের ন্যায় একদলীয় শাসন পদ্ধতিতে আইনানুগ ন্যায়বিচার কল্পনা করা যেত না। সামরিক শাসনেও এরূপ অবস্থার অবতারণা হয়, যা সুশাসন ও ন্যায়বিচারের দর্শনে গ্রহণযোগ্য নয়। একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য- (১) আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া (Due process of Law, (২) আইনের শাসন (Rule of Law, (৩) আইনের বিধিবহির্ভূত কোন নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা Save in accordance with law) (৪) শুনানির সুযোগ দান ব্যতীত দণ্ড দান না করা (Audi Alteram Partem) (৫) কেউ নিজের বিচারক নিজে হতে পারে না (No person can be a judge of his own cause), (৬) সার্বভৌম কোন অন্যায় করতে পারে না (King Can do no wrong), (৭) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আদালতের সহজাত এখতিয়ার (Inherent Jurisdiction), (৮) ন্যায়পরতা ও বিচক্ষণতা (equity and expediency), (৯) পুনঃবিবেচনা (Review, (১০) দায় অব্যাহতি বিধি (Immunity) অনুসরণ করা হয়। লর্ড হলসবেরি নাগরিক স্বাধীনতার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, প্রকৃতপক্ষে নাগরিকদের তথাকথিত স্বাধীনতার দুটি মৌলনীতি গৃহীত হয়েছে; দেশের মূল আইন লঙ্ঘন না করা এবং অন্যের বৈধ অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা। একজন নাগরিক তার খুশিমতো যা ইচ্ছে করতে ও বলতে পারে, সেজন্য কোন সরকার আইনের স্বীকৃত বিধান অথবা সংবিধি ব্যতীত কিছুই করতে পারে না। যেহেতু সরকার কোন নাগরিকের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না, অতএব সে স্বাধীন। ব্রিটিশ আইন পদ্ধতি অনুসারে আইনের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় যাবতীয় বিধিনিষেধ আরোপ ও বলবৎ করা হয়। কার্যত এই প্রক্রিয়াটি লর্ড হিউয়ার্টের উক্তির মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। তার মতে ‘ন্যায়বিচার শুধু করলেই চলবে না, ন্যায়বিচার যে করা হয়েছে তা প্রতীয়মান হওয়া চাই।’ আইনানুগ ন্যায়বিচার একটি গণতান্ত্রিক চেতনা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পরম নির্দেশনা। এ প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত আইনবিদ উইলিয়ম পিট বলেছেন, ‘দীনতম ব্যক্তিও তার ভঙ্গুর কুটিরে রাজশক্তির প্রবেশ প্রকাশ্যভাবে অস্বীকার করতে পারে। তার কুটিরখানি হতে পারে জীর্ণশীর্ণ, হয়তো তার ছাউনি দোলায়মান, হু হু করে তার ভেতর বাতাস বইছে, এতে ঝড়-বৃষ্টিও প্রবেশ করতে পারে; কিন্তু ইংল্যান্ডের রাজা তাতে প্রবেশ করতে পারে না, রাজার ফৌজ সে ভগ্ন কুটিরের চৌকাঠ মাড়াতে সাহস করে না।’ রাষ্ট্র কর্তৃক আইনানুগ ন্যায়বিচারের এই বিশুদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি ব্যতিরেকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কি আদৌ সম্ভব? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বিশ্বের সেরা সংবিধান বাঙালী জাতিকে উপহার দিয়েছেন। উক্ত সংবিধানের ৩২নং অনুচ্ছেদে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার ওয়াদা করা হয়েছে। ‘আইন অনুযায়ী ব্যক্তির জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না।’ (No person shall be deprived of life or personal liberty save in accordance with law.) এখনও আমাদের সংবিধানে বলবৎ আছে। বিচারকের নিরপেক্ষ ভূমিকা যেমন ন্যায়বিচারের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় তেমনি বিচারকের রায় আইনসম্মত পদ্ধতিতে গৃহীত হয়েছে বলেও প্রমাণিত হওয়া আবশ্যক। প্রতিহিংসা কিংবা পক্ষপাতিত্ব যেন বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বিনষ্ট না করে। ‘দণ্ডের সঙ্গে দণ্ড দাতা কাঁদে সমান আঘাতে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।’ মানুষ যুক্তিনির্ভর সামাজিক জীব। সমাজের সহস্র বাঁধনের মাঝে সে মুক্তির স্বাদ লাভ করতে চায়। ভয়ভীতি থেকে আত্মরক্ষার জন্য, জানমালের নিরাপত্তার জন্য, জীবনে পূর্ণতা লাভের জন্য সমাজ গড়ে ওঠে। পারস্পরিক সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য মানুষের সামাজিক চেতনা ও দর্শন বিভিন্ন রূপে অভিব্যক্ত হয়। তবে সকল সমাজে একটি অভিন্ন দর্শন আছেÑ দুঃখ-দৈন্য পরিহার করে সুখ-শান্তি-সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি সাধনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা। এই ঈপ্সিত লক্ষ্যে উপনীত হতে প্রত্যেক ব্যক্তির আচরণ সমাজের কথিত মূলদর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই আচরণ নিয়ন্ত্রণের কৌশল অবলম্বন ব্যতীত একটি সুশৃঙ্খল জীবন ব্যবস্থা, সভ্যতার অস্তিত্ব সমাজে কল্পনা করা যায় না। সর্বকালের সকল সমাজে তাই একটি যুক্তিসঙ্গত আচরণবিধি উদ্ভাবন ও কার্যকর করার নিরলস প্রয়াস এখনও লক্ষ্য করা যায়। জনকল্যাণকামী সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা পরিকল্পনার জন্য ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যে মানুষের আচরণের জন্য একটি নির্দিষ্ট আদর্শে স্থানীয় বিধি থাকা বাঞ্ছনীয়। সমাজের সকলেই তা অনুসরণ করবে অথবা সামাজিক শক্তিবলে তা পালন করতে বাধ্য করা হবে। সীমা লঙ্ঘনকারীকে অবশ্যই দ- দেয়া হবে। দ-ের ভয়ে দুর্বৃত্ত ও দুষ্ট লোকেরা আইন ভঙ্গ করতে সাহসী হবে না। আইন ভঙ্গের জন্য স্বমহিমায় আইন উচ্চারিত হবে। আইন ভঙ্গের দায় নির্ধারণ ও দ-দানের জন্য সমাজ ব্যবস্থায় বিচার প্রশাসন পদ্ধতির উদ্ভাবন করা হয়। আদিকাল থেকে বিভিন্ন সমাজের দর্শনের আলোকে বিচার প্রশাসন পদ্ধতির প্রচলন চলমান আছে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব। লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার আপীল বিভাগের সরকারী কৌঁসুলি
×