ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সঙ্কট দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতা

প্রকাশিত: ২১:৩৭, ১১ জুন ২০২১

সঙ্কট দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতা

বৈশ্বয়িক করোনায় অতিমারী নতুন এক মানবিক বিশ্বব্যবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বদলে যাচ্ছে পুরাতন ধ্যানধারণা। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত পারমানবিক শক্তি অর্জনকারী দেশ এবং প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রের কোন নাগরিক এই অণুজীবের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। অতিউন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পন্ন রাষ্ট্র অণুজীবের আক্রমণে আত্মপক্ষ সমর্থন করে একটি জেনারেশনকে ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিটি প্রাণের গুরুত্বের চেয়ে বিশেষ শ্রেণীর প্রাণ গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হিসেবে সামনে আসে। এই ধারণা পুরাতন। রোমান শাসক সিসেঙ্কোর শাসনামলে অবসরপ্রাপ্তদের হাসপাতালে ভর্তি নেয়া হতো না। প্যারাগুয়ের আর্চে শিকারি আদিবাসী সমাজে বৃদ্ধ এবং অনাকাক্সিক্ষত শিশুদের হত্যা করা হতো। বৈশ্বয়িক অণুজীবের আক্রমণে ধনী, গরিব, অতিগরিব, পুরহিত, পাদ্রি, বানভট্ট, মহাত্মা মহামানব, রাস্তার ফকির থেকে শুরু করে সুপার স্টার কেউ রক্ষা পাচ্ছে না। জীবাণুর আক্রমণেই যে মানুষ আক্রন্ত হচ্ছে এটা আবিষ্কার করতে বহু সময় লেগেছে। ব্রিটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার (১৭৪৯-১৮২৩) গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোগ প্রতিরোধের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এরপর লুই পাস্তুর (১৮২২-১৮৯৫) রেবিস এবং এনথ্রাক্সের টিকা আবিষ্কার করেন। রোগের কারণ এবং প্রতিরোধ নিয়ে লুই পাস্তুরের গবেষণা মানুষের জীবন দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে মানুষ জীবাণুর আক্রমণে মহামারী নিয়ন্ত্রণ করেছে। করোনার সঙ্গে প্লেগে, গুটি বসন্ত, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারীর পার্থক্য রয়েছে। পূর্বেও মহামারী স্থানীয় পর্যায়ে জনমানব শূন্য করেছে। বিশ্বায়নের যুগে করোনাও বৈশ্বয়িক। পৃথিবীর কোন কিছুই বিশ্বায়নের যুগে সীমাবদ্ধ থাকে না। রাষ্ট্রের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বে শুধু করোনা ছড়ায় ন, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং স্বৈরতন্ত্রের বিকাশও হয় দ্রুত। মানুষের সৃষ্টি দুর্যোগ অথবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে সমাজ মানসে দ্বন্দ্ব সংঘাত ও সমন্বয়ের সৃষ্টি হয়। চিন্তার জগতে আসে পরিবর্তন। অস্থিরতা, আস্থাহীনতা এবং চিরায়ত বিশ্বাসের জায়গাগুলোতে সংশয় সন্দেহের মধ্যে দিয়ে নৈরাস্যবাদের জন্ম হতে সময় নেয় না। সবসময় যে নৈরাস্যবাদের সৃষ্টি হয় তা-ও নয়। মানবিক বিশ্বও সৃষ্টি হতে পারে। মহামারীর ফলে মানুষের যে জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয় তা-ই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষতির চেয়েও মানসিক ক্ষতি বেশি হয়। মানুষ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখার চেয়ে অবিশ্বাসের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ হায়িয়ে ফেলে। বৈশ্বয়িক করোনার মহামারী নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান ছাড়াও সমাজবিজ্ঞানী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, দার্শনিক সবাই মানব জীবনের মহাসঙ্কট থেকে সুন্দরভাবে উদ্ধারের চেষ্টা করছে। স্লাভোজ জিজেক করোনা বহুমাত্রিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া নিয়ে বই লেখেছেন। বইটি বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ব্রাম্বেলের করোনার নৈতিকতা নিয়ে একটি গ্রন্থ লিখেছেন। প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রতিনিয়ত ছাপা হচ্ছে। করোনার সঙ্কট দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রফেসর নূরুজ্জামান বাংলা ভাষায় সুন্দর একটি গ্রন্থ লিখেছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দর্শনের লেখক নূরুজ্জামানের করোনা নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চাকে সমৃদ্ধ করেছে। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির মূল্য ২৬০ টাকা। ড. মো. আনিসুজ্জামান
×