ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

করোনার মহাদুর্যোগে জনজীবন

প্রকাশিত: ২১:২৬, ১৬ জুন ২০২০

করোনার মহাদুর্যোগে জনজীবন

বিশ্বব্যাপী সংক্রমিত করোনাভাইরাস আজও তার চরম দুঃসময় পার করছে। কোভিড-১৯ নামে পরিচিত এই ভাইরাস শুরু হয় প্রথম চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই সর্বগ্রাসী ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চীন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে আক্রান্ত উহান শহরকে অবরুদ্ধতার কঠিন জালে আটকে দিলে এর বহুল সংক্রমণ চীনের অন্য কোথাও ছড়াতে পারেনি। আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ হাজার পার হওয়ার পর থেকে চীন এই ভাইরাসটিকে উহানেও আর সংক্রমিত হতে দেয়নি। বৃহত্তর এশিয়ার বৃহৎ রাষ্ট্র এবং জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটি তার সীমানায় এই মহামারীকে এক পর্যায়ে আটকে দিতে সক্ষম হয়। সারা বিশ্ব তখনও ভাবতে পারেনি এই সংক্রমণটি কি মাত্রায় পুরো দুনিয়ায় সাড়া জাগিয়ে দেবে। পরবর্তীতে এই করোনাভাইরাস এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়াকে অতিক্রম করে যোজন যোজন মাইল দূরের ইউরোপ-আমেরিকায় ঝড় তুলবে। বাস্তবে তেমন ঝাপটা পশ্চিমী দুনিয়াকে একেবারে নাজেহাল পর্যায়ে নিয়ে যায় যা এখন অবধি তার অবস্থানে থেকে দুর্বল হলেও একেবারে নির্মূল হতে পারেনি। এর পর থেকে শুরু হয় দুর্যোগ আর দুর্বিপাকে পড়া বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করা প্রবাসীরা। তেমন সঙ্কটে পড়া প্রবাসী বাঙালীরাও ভয়ে, আতঙ্কে আক্রান্ত দেশ থেকে মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে ব্যাকুল আর উৎকণ্ঠায় দিন কাটাতে থাকে। বহুল সংক্রমণ এই রোগটির আক্রান্ত দেশ থেকে ফিরে আনা সেও এক চরম স্বাস্থ্য আর প্রাণ ঝুঁকির ব্যাপার। প্রথম চীন থেকেই বাঙালীদের নিজ দেশে ফিরিয়ে এনে বিধি অনুযায়ী ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রেখে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সুনিশ্চিত হয়েই ছেড়ে দেয়া হয়। সে অবধি দেশে কোন বিপত্তি ঘটেনি। কিন্তু ইতালি থেকে যখন প্রবাসীরা ভয়ে, সংশয়ে দেশে আসা শুরু করে সংক্রমণের অশুভ থাবা তখন থেকেই। অভিযোগ ওই ইতালি থেকে ফিরে আসা বাঙালীরা সেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোয়ারেন্টাইনের নিয়মের ব্যত্যয়ই শুধু ঘটায়নি তার চেয়েও বেশি সংক্রমণের ঝুঁকিকে অনেকখানি বাড়িয়েও দেয়। সেই ফেব্রুয়ারির শেষের দিকের ঘটনা। এরপর ৮ মার্চ প্রথম বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্ত হলে প্রায় তিন মাস ধরে চলতে থাকে এর সর্বগ্রাসী সংক্রমণ। তেমন আশঙ্কা প্রথম থেকে করা হলেও সাবধানতা এবং যথেষ্ট নিয়ম বিধির ঘাটতিতে করোনা তার স্বভাব সুলভ বৈশিষ্ট্যে এগিয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশ প্রথম থেকে সংক্রমণের ঝুঁকিকে এড়াতে ১৭ মার্চ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। পর্যায়ক্রমে ২৬ মার্চ থেকে সরকারী-বেসরকারী সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম স্থগিত করে সাধারণ ছুটির নির্দেশনা আসে। ‘লকডাউন’ আর ‘সাধারণ ছুটি’ কোনভাবেই এক কিংবা সমার্থক নয়। ফলে ধরে নেয়া হয় ছুটি মানেই আনন্দযোগ, ঘুরে বেড়ানোর অপরিমেয় সুযোগ। যে সংক্রমণকে প্রতিরোধ করতে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হলো তারাই ছুটি উপভোগ করতে কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতে প্রমোদ বিহারে ছুটে যায়। অবরুদ্ধতার কঠিন বলয় আগে এ দেশ দেখেনি। আগের অভিজ্ঞতায় ছুটি উপভোগ করার আনন্দ আয়োজনই সবাইকে তাড়িত করে। সঙ্গত কারণে লকডাউন বুঝতেও এদেশের মানুষকে ভাবতে হয়েছে, সময় ক্ষেপণ করা ছাড়া উপায়ও ছিল না। লাগাতার ছুটি বাড়াতে শেষ অবধি ঈদের উৎসব পর্যন্ত তা গড়িয়ে যায় ৩০ মে। কিন্তু প্রথম থেকেই করোনাভাইরাসের বহুল সংক্রমণকে গণমানুষ তোয়াক্কাই করেনি। কিংবা গুরুত্ব বিবেচনায় আমলে নিতেও ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বিপত্তি ঘটেছে পদে পদে। বলা হচ্ছিল বার বার স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে সামাজিক দূরত্ব মানাই শুধু নয় ঘরের বাইরে যাওয়াও একেবারে নিষেধাজ্ঞার পর্যায়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে সামরিক বাহিনীর জোয়ান এবং র‌্যাব সদস্যদের আইনী কার্যবিধি তদারকি করার দায়িত্ব দেয়া হয়। দুঃখজনক হলেও দৃশ্যমান হয় সাধারণ মানুষ ভয়, আতঙ্ক কিংবা আইনী বিধান কোন কিছুকেই আমলে নিচ্ছে না। ফলে যা হবার প্রতিনিয়ত তাই ঘটে যাচ্ছে। বহুল সংক্রমণকে প্রতিরোধ করা এখন অত্যন্ত কঠিন এক ব্যাপার হয়ে যায়। সামাজিক বিধিকে লঙ্ঘন করে মানুষ শুধু যে রাস্তাঘাটে ভিড় জমায় তা কিন্তু নয়। দেশের বিভিন্ন জেলায় গ্রামের বাড়িতে চলে যেতেও দ্বিধা করেনি। ফলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাংলাদেশের কোন জেলা-উপজেলা, প্রত্যন্ত অঞ্চল রক্ষা পায়নি। শুধু মানুষের অবাধ যাতায়াতকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থতার কারণে। তার ওপর পোশাক শিল্প কারখানা খুলে দেয়ার মহড়ায় শ্রমিকদের আসা-যাওয়ার ভিড়ে সারা বাংলার সড়ক-মহাসড়ক, রেল, নৌপথের যে দৃশ্য দেখা যায় তাতে মনেই হয়নি দেশটি এক সংক্রমণ ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ে বিপর্যস্ত, নাজেহাল। রমজানের মাঝপথেই মসজিদের জামাতে নামাজ পড়ার অনুমোদন দেয়া হয় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যও সীমিত আকারে খুলে দিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের রুজি রোজগারকে গতিশীল করতে সরকারের পক্ষ থেকেই ঘোষণা আসে। এরপর থেকেই আরও ব্যাপকহারে গণসমাগম অবারিত হয়ে যায়। তবে বড় ও ব্র্যান্ডের ব্যবসায়ীরা তাদের শপিং মলগুলো না খোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। রোজার পর ঈদ উৎসবে আবারও ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় মানুষের যাতায়াত শুরু হয়ে যায়। এই সময় সরকার অনেকটা কঠোর অবস্থানে গেলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। সড়ক-মহাসড়ক, ফেরিঘাটে উপচেপড়া মানুষের ভিড়ে যাতায়াত ব্যবস্থায় শিথিলতা আনা হলে শেষ অবধি সারা বাংলাদেশে ঢাকা থেকে গণজোয়ারে গ্রামে, গঞ্জে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যেতে সক্ষম হয় জনসাধারণ। আর এদিকে প্রতিদিনই করোনা সংক্রমণের সংখ্যা বাড়াই শুধু নয় মৃত্যুও আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তেমন সম্প্রসারিত সংখ্যা এখন অবধি চলমান। সামনে আরও বড় বিপর্যয়ের আতঙ্ককে উড়িয়েও দেয়া যায় না। রুদ্ধতার আবরণে মানুষকে ঘরে আটকানো যায়নি এর পরে খুলে দেয়ার সুযোগ হাতে পেয়ে মানুষ আরও বেপরোয়া হয়ে যায়। সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধিকে অনুসরণ করা ছাড়াই মানুষের ঢল নামে রাস্তাঘাটে, বাজারে এবং অবাধ চলাফেরায় আর কোন নিয়ন্ত্রণের বালাই রইল না। করোনা সংক্রমণ এবং মৃত্যু সংখ্যা বাড়ার মধ্যেই স্বাস্থ্য খাতের যে চরম অব্যবস্থাপনা উন্মোচিত হলো তাও যেন এই দুর্যোগের ভয়ঙ্কর অশনিসঙ্কেত। চিকিৎসা সেবা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সামগ্রীর অপর্যাপ্ততায় এই খাতকে নিয়ে যায় মারাত্মক সঙ্কটের মধ্যে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যথেষ্ট অপ্রতুলতায় চিকিৎসক এবং সেবা কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টিও অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে সামনে চলে আসে। কয়েক করোনা আক্রান্ত চিকিৎসকের মৃত্যুও এ ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি হতে থাকে। সবচাইতে বড় সমস্যা যেখানে সুষ্ঠু এবং সফল সমন্বয় প্রয়োজন ছিল সেখানেই দেখা দেয় হরেক রকম বিপত্তি। ছড়িয়ে পড়া মহামারীর চরম দুঃসময়ে সংশ্লিষ্ট সরকারী-বেসরকারী ব্যবস্থাপনার যে অনৈক্য, মতদ্বৈততা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং শৃঙ্খলার দৃষ্টিকটু ঘাটতিতে মানুষ পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় যে অনিয়ম আর অনৈতিক কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করে তাও এই সেবা খাতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সময় লাগেনি। বেসরকারী হাসপাতালগুলো এখনও সেভাবে সক্রিয় পদক্ষেপে করোনা দুর্যোগে শামিল হয়নি। বিপরীতে সরকারী হাসপাতালগুলোতে যে কোন রোগে আক্রান্ত রোগীদের নাজেহাল করার চিত্রও দৃশ্যমান। আবার সঙ্কটজনক করোনা রোগীর জন্য যে আইসিইউ, ভ্যান্টিলেশন আর অক্সিজেন প্রয়োজন সেখানেও দেখা দেয় চরম বিপন্নতা। অক্সিজেন সিলিন্ডারের ঘাটতি তো আছেই তাছাড়া কেন্দ্রীয় অক্সিজেনও দৃশ্যমান না হওয়ায় পর্যাপ্ত সরবরাহ এবং রোগ নিয়ন্ত্রণেও যথেষ্ট বিপত্তি পরিলক্ষিত হয়। সামনে আরও দুর্যোগ মোকাবেলায় চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রগুলো সেভাবে প্রস্তুতও নয় এমন আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনা তার সর্বোব্যাপী সংক্রমণে উচ্চ, মধ্য এবং নিম্নবিত্তের ফারাক দেখছে না। যার মধ্যেই সুরক্ষার ঘাটতি তার ওপর চেপে বসতে দেরিও করছে না। ফলে আপামর মানুষের মধ্যে যে মাত্রায় সংক্রমিত হচ্ছে সেখানে সে সাম্যবাদী চেহারায় শ্রেণীহীনতার মোড়কে। সঙ্গত কারণে বিত্তবানদের চিকিৎসা সেবা থেকে অপেক্ষাকৃত আর্থিকভাবে দুর্বল রোগীদের স্বাস্থ্য সেবায় কিন্তু ফারাক থেকেই যাচ্ছে। তেমন চিত্রও সামনে এসে পড়ায় প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে মুমূর্ষু করোনা রোগীর ক্ষেত্রে যে ভেন্টিলেশন কিংবা অক্সিজেন অত্যাবশ্যক সেখানে আর্থিকভাবে সম্পন্ন মানুষের সেবাই ত্বরান্বিত হচ্ছে যদি সেবা নেয়ার সুযোগ থাকে। অন্যদের বেলায় অপর্যাপ্ততা কিংবা গাফিলতিও মানুষকে বিপন্নতার শিকার করছে। তার ওপর সঙ্কটাপন্ন করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেখানে সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি আর ঘাটতিও পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধিকে তোয়াক্কা না করার দাম দিতে হচ্ছে অনেক সাধারণ মানুষকে। স্বাস্থ্যবিধির আনুষঙ্গিক শর্ত প্রাথমিকভাবে অনেককেই আইসোলেশন কিংবা হোম কোয়ারেন্টাইনে যেতে হয়। আবাসিক বাসা বাড়িতে তেমন সুযোগ কয়জনের আছে তাও খতিয়ে দেখা জরুরী। প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন কিংবা কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সংক্রমণ এই রোগটি এসব ব্যবস্থাপনা ব্যতিরেকে অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়তেও সময় নিচ্ছে না। আর যেখানে প্রতিটি হাসপাতালে অন্য অনেক রোগীর ভিড়ে করোনা সঙ্কট সামলাতে হিমশিম খেতে হয় সেখানে আরও বাড়তি সুযোগ তৈরি হওয়াও এক সম্মুখসমর। ২০২০-২১ সালের অর্থবছরের বাজেট এসে গেছে। স্বাস্থ্য আর সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে অন্যবারের তুলনায় বেশি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময় সাহায্য সহযোগিতা দিতে তাদের তহবিলও ঘোষণা করেছে। এই সব অর্থ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে কতখানি সক্ষম হবে তাও বিবেচনায় আনতে হবে। প্রয়োজনীয় ও কঠোর নজরদারিতে প্রাপ্ত অর্থ যাতে সুষ্ঠু সমন্বয়, ব্যবহার এবং যথার্থ খাতে ব্যয় করা হয় সেটাও পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। লেখক : সাংবাদিক
×