ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৮ মে ২০২৪, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শিক্ষার্থী ঝরে পড়া কমবে

অবৈতনিক শিক্ষা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত করার উদ্যোগ

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ০০:১৬, ৭ মে ২০২৪

অবৈতনিক শিক্ষা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত করার উদ্যোগ

অবৈতনিক শিক্ষা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত করার উদ্যোগ

দেশে বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মৌলিক বা বাধ্যতামূলক শিক্ষা চালু রয়েছে। সরকারি পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিনামূল্যে পড়াশুনা করতে পারে খুদে শিক্ষার্থীরা। এবার অবৈতনিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কার্যকর করতে যাচ্ছে সরকার। ফলে অষ্টম শ্রেণি (নিম্ন মাধ্যমিক) পর্যন্ত পড়তে শিক্ষার্থীদের কোনো বেতন লাগবে না।

শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারের লক্ষ্য শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক করা। প্রথম পর্যায়ে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে অবৈতনিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা হবে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। 
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ বিষয়ে দুই মন্ত্রণালয় পৃথক দুটি কমিটি গঠন করবে। এরপর যাচাই-বাছাই ও উপযোগিতা শেষে প্রতিবেদন দাখিল করবে দুই কমিটি। সে অনুযায়ী এটি বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া হবে। 
জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, এটি খুবই জনগুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।

এ ছাড়াও এ সময় যে শিখন দক্ষতা অর্জন করার কথা, শিক্ষার্থীরা তার অর্ধেকও করতে পারছে না। মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিখন অভিযানে আমরা আরও ৩৫ ভাগ শিক্ষার্থীকে হারিয়ে ফেলি। সেক্ষেত্রে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হলে ঝরে পড়ার হার অবশ্যই কমবে। 
এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, আমরা যেহেতু উন্নয়নশীল দেশ, যে কারণে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের একটি চাপও আমাদের রয়েছে। সে অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অবৈতনিক করতে হবে। দুই মন্ত্রণালয় যে সভা করেছে সেটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের হিসাবে সারাদেশে ৬৯৬টি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম চলমান আছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যদি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করতে যায়, সেক্ষেত্রে অবকাঠামো খরচ ও সমন্বয়হীনতা ব্যাপক হারে বাড়বে। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেভাবে আছে তার ভিত্তিতেই চালু করা গেলে অবকাঠামো উন্নয়নে বাড়তি খরচ লাগবে না। আগামী দুই বছরের মধ্যে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা উচিত।
সূত্র বলছে, নি¤œ মাধ্যমিক স্তরে অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে রবিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন শিক্ষাবিদ, দুই মন্ত্রণালয়ের তিন সচিব, মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভা সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে, মৌলিক ন্যূনতম শিক্ষা অধিকারের ধাপ প্রাথমিক থেকে নি¤œ-মাধ্যমিক স্তরে উত্তরণের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা  মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করবে। বর্তমানে প্রাথমিক থেকে নি¤œ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি ও নানান আর্থসামাজিক কারণ ও প্রক্রিয়াগত কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার রোধ করতে নি¤œ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক বা নামমাত্র ব্যয়ে করার ব্যবস্থা করার বিষয়ে শিক্ষানীতি ২০১০ এ বর্ণিত অঙ্গীকার  বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে দুই মন্ত্রণালয়। 
এই লক্ষ্যে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের অবৈতনিক শিক্ষা তথা পাঠদান কার্যক্রম ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত করবে, এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় নি¤œ মাধ্যমিক পর্যায়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ব্যয় কমিয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে কাজ করবে। 
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সভাপতিত্বে সভায় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বেগম শামসুন নাহার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান  ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আবদুল হালিম এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অধিদপ্তরের মহাপরিচালকগণ উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বিনামূল্যে পাঠ্যবই ও উপবৃত্তি দিয়ে আসছে সরকার। এটি কিন্তু সারা বিশ্বের বিস্ময়! এর সুফল পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এখন সরকারের পরবর্তী লক্ষ্য বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা করানো। এজন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা চাই নি¤œ মাধ্যমিক অবৈতনিকের পাশাপাশি এ স্তরের শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষা দেওয়া। যাতে তারা দক্ষ হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে। 
শিক্ষা পরিসংখ্যান তথ্য অনুযায়ী প্রাথমিক সমাপনীতে পাস করা ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে এসএসসিতে অংশ নেয় ২১ বা ২২ লাখ। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে আট লাখের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে যায়। এ বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী অদক্ষ হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। যদিও ২০১৯ সালে প্রথম এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ওই সময় বলা হয়েছিল, ২০২৩ সালের মধ্যে নি¤œ মাধ্যমিক এবং ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক বা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হবে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, লেখাপড়ার পেছনে শিক্ষার্থীদের বড় দুই দাগে ব্যয় হয়। একটি প্রাতিষ্ঠানিক, অন্যটি পারিবারিক। পারিবারিক ব্যয়ের মধ্যে আছে খাতা, কলম, জামা-কাপড় ইত্যাদি। অবৈতনিক হলে প্রাতিষ্ঠানিক খরচ সরকার বহন করবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক জরিপে বলা হয়েছে, বর্তমানে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে ৪৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী।

বাকি ৫৩ দশমিক ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তবে, সম্প্রতি ইউনেস্কোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্টের প্রতিবেদন বলছে, দেশের ৫৫ শতাংশ শিশু প্রাক-প্রাথমিক স্তরে বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে এই হার ৯৪ শতাংশ, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
যেভাবে সংস্থান হবে টিউশন ফি’র ॥ এ সংক্রান্ত কৌশলপত্র তৈরির সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, অবৈতনিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা হলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো টিউশন বা অন্যান্য ফি আদায় করা হবে না। এর পরিবর্তে সরকার দুভাবে টিউশন ফি’র সংস্থান করবে। একটি হচ্ছে, প্রত্যেক স্কুল-মাদ্রাসা একই হারে টিউশন ফি নেবে। সেই ফির অর্থ সরকার শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠাবে। শিক্ষার্থীরা তা স্কুলে জমা দেবে।

অথবা, ধার্য টিউশন ফি সরকার সরাসরি প্রতিষ্ঠানে পাঠাবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পেছনে সরকার কত টাকা ব্যয় করবে, তা আলাদাভাবে নির্ধারণ করা হবে। এরপর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণিভিত্তিক মোট কত টাকা সরকার ব্যয় করবে, তা বের করা হবে। এক্ষেত্রে স্কুলের টিউশন ফি ও অন্যান্য ব্যয় হিসাবে আনা হবে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী জানান, বর্তমানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১০০, সপ্তম শ্রেণিতে ১৫০ এবং অষ্টম শ্রেণিতে প্রস্তাবিত টিউশন ফি ২০০ টাকা নির্ধারণ করা আছে। নবম ও দশম শ্রেণিতে যথাক্রমে ৩০০ ও ৫০০ টাকা এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা আছে। এটা আরও এক দশক আগে হওয়ার কথা ছিল। নানা নীতির কারণে হয়নি। সরকার আবারও শুরু করতে যাচ্ছে। এটাকে স্বাগত জানাই।

×