ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাস ও শেখ হাসিনার শত্রু-মিত্র

প্রকাশিত: ০৮:৩৬, ২১ এপ্রিল ২০২০

করোনাভাইরাস ও শেখ হাসিনার শত্রু-মিত্র

নোভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণে সারা পৃথিবীর মানুষ আজ দুর্বিষহ মানবিক সঙ্কটে নিপতিত। বিশে^র সকল রাষ্ট্রনায়ক পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করে চলেছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জ্ঞানী-গুণী-বিজ্ঞানীরা এই ভয়াবহ সঙ্কট উত্তরণের লক্ষ্যে এক বৈশি^ক সংযোগ অবলম্বন করে সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশে^র ধনী রাষ্ট্রসমূহ, জাতিসংঘ, বিভিন্ন আঞ্চলিক জোট, বিত্তবান ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে খ্যাতিমান অভিনেতা-খেলোয়াড়সহ সকলে মিলে নোভেল করোনার চিকিৎসা, ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন ও ওষুধ তৈরির জন্য বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন। অসহায় মানুষ দুই হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে সঙ্কট থেকে মুক্তির জন্য অশ্রুসজল প্রার্থনা জানিয়ে চলেছেন। ব্রিটেনের বর্ষীয়ান রানী এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন- ‘...এবার আমরা সবার চেষ্টায় বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে এক হয়েছি। আমরা সবাই মিলে সফল হব। এই সফলতার দাবিদার হবেন সবাই।’ এই ঐকমত্য ও উদ্যোগ আমাদের জীবনে এক অনন্য সৌভাগ্য। সকল দেশের মানুষের হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আমরাও কোয়ারেন্টাইন বা ঘরবন্দী জীবনযাপন করছি। পৃথিবীব্যাপী করোনার আতঙ্ক, সংক্রমণ ও মৃত্যুর খবরে অসহায় বোধ করছি। আবার ভ্যাক্সিন-ওষুধ আবিষ্কারের অগ্রগতিতে আশান্বিত হচ্ছি। প্রতিদিনই বন্ধু-স্বজনদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি। এসবের বাইরে অনলাইনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু ফুটেজ, ডকুমেন্টারি ও দলিলপত্র দেখেছি। আবুল ফজল আল্লামির আইন-ই-আকবরী পড়ে শেষ করেছি। বলা বাহুল্য, সম্রাট আকবরের বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য শাসনে জ্ঞানী-গুণী-কবি-দার্শনিকদের পরামর্শের কদর ও আল্লামির বিশ্লেষণ আজও যে কত প্রাসঙ্গিক তা কল্পনা করা যায় না। অতঃপর, মানবজাতির ধারাবাহিক ইতিহাস নিয়ে সম্প্রতি রচিত জুভেল হারারির বিখ্যাত বই সেপিয়েন্স পড়া শুরু করেছি। এসবের মধ্যেই কেউ কেউ আবার করোনা নিয়ে কবিতা লিখছি কিনা জানতে চেয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে বুকের ভেতর প্রবল বেদনা অনুভব করলেও করোনা নিয়ে কিছু লিখব তা ভাবিনি। তবু পত্রপত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সঠিক পরিস্থিতি তুলে ধরার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-আমলাবর্গ এবং চিকিৎসক সমাজের মধ্যে আন্তঃকলহ; সরকারী ও বিরোধীদলীয় কিছু রাজনৈতিক নেতার অনাকাক্সিক্ষত মন্তব্য; করোনা নিয়ে বিশিষ্ট নাগরিকদের একটি বিবৃতি; পত্রিকার কিছু কলাম; খাদ্য সহায়তার চাল-আটা-তেল বিতরণে অনিয়ম; এক দরিদ্র শিশুকন্যা ধর্ষণ; এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আত্মস্বীকৃত খুনি বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের আকস্মিকভাবে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া ও ঢাকায় রহস্যজনক অবস্থানের পর গ্রেফতার হওয়া ও ফাঁসি ইত্যাদি দেখে-শুনে এই লেখাটি না লিখে পারলাম না। করোনাভাইরাসকে উপলক্ষ করে সরকার প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীকে ছয় মাসের জামিনে মুক্তি দিয়েছে। এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের মুক্তি দাবি করছে। তাদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ আইইডিসিআরের করোনায় আক্রান্ত মানুষ ও মৃতের হিসাবের মধ্যে গরমিলের কথা উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ করোনা সঙ্কটকালে সরকারের কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতার কথা বলছেন। এঁরা নিশ্চয়ই বিপর্যস্ত মানবসমাজ ও দেশের বিপন্ন-অসহায়দের হিতাকাক্সক্ষী। অধিকাংশের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু কে যে কার শত্রু আর কার মিত্র তা বোঝা খুবই দুষ্কর। তবু এসব ঘটনা দেখে এবং কারও- কারোর বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে- করোনাভাইরাস উপলক্ষ হলেও তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ও চিকিৎসায় সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে চলেছেন। গত ৮ মার্চ ২০২০ তারিখে বাংলাদেশে যখন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়, সেদিনই তাৎক্ষণিকভাবে গণভবনে সভা ডেকে মুজিববর্ষের সব অনুষ্ঠান স্থগিত করেন। সেই সভায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা বলেছিলেন- আমার বাবার রাজনীতি ছিল গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য। ছয় মাসের জন্য বিদেশে গিয়ে বাবা-মা-ভাই-বোন-স্বজনদের হারিয়ে আমরা দুই বোন ছয় বছর পর দেশে ফিরেছি। কাজেই মানুষের জীবনকে দুর্দশার মধ্যে ফেলে কোন অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব আমরা দুই বোন নেব না। অতঃপর ২৫ ও ৩১ মার্চ যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে এরং বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, পুলিশ-সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য সেবা সংস্থার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সরকারের গৃহীত কার্যক্রম এবং সকলের করণীয় পর্যালোচনা করেন। এতে মানুষের মধ্যে দেশে করোনার সংক্রমণ এবং সরকারের গৃহীত কার্যক্রমের একটি পরিষ্কার চিত্র উঠে আসে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত কোনো তথ্য গোপন না করার জন্য জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। প্রতিদিনই তিনি সারাদেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্দীপিত করে চলেছেন। করোনা যুদ্ধের সম্মুখ সারিতে দাঁড়িয়ে সেবাদানকারী নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বীরত্বসূচক পুরস্কার ও প্রণোদনা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। দেশের সাংবাদিক, সংবাদকর্মী ও সংবাদ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সঠিক তথ্য পরিবেশনের অনুরোধ জানিয়ে আসছেন। ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। যেখানে সৌদি আরব ও ইংল্যান্ডের মতো ধনী দেশের সরকারগুলো বেসরকারী খাতের কর্মীদের বেতনের যথাক্রমে ৬০% এবং ৮০% দেবে আর বাকিটা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা কোম্পানিকে, সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য আপৎকালীন শতভাগ বেতনের জন্য সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। সব মিলিয়ে করোনাকালে দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। গ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল গঠন করেছেন। ভর্তুকি বাবদ আগামী বাজেটে নয় শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এভাবে কৃষিতে অর্থের যোগান বাড়িয়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকদের কাছে বীজ-সার-কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করার যাবতীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলার লক্ষ্যে তিন বছরের পরিকল্পনা তৈরি করছেন। এমনকি এই ঘোরতর দুর্দিনে বিভিন্ন ধনী দেশ ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তা লাভে কূটনৈতিক তৎপরতাও অব্যাহত রেখেছেন। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে, স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক মিলিয়ে দিনে ২২২৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়। করোনার মৃত্যুহার সারা পৃথিবীতে কম হলেও এর সংক্রমণ মানব জীবনের সবক্ষেত্রেই খুবই বিপজ্জনক। তাই করোনাভাইরাসের আক্রমণে কোয়ারেন্টাইনের শুরুতে এবং লকডাউনের সময় প্রধান উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা ছিল গরিব-অসহায় মানুষের ক্ষুধা বা খাদ্যের কষ্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক আহ্বানে সকল স্তরের প্রশাসনযন্ত্র, সেবা সংস্থাসমূহ, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিবর্গ গরিব-অসহায় মানুষের জন্য বাড়ি-ঘরে, মসজিদে-উপাসনালয়ে, হাটে-বাজারে ও পথে-ঘাটে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে চলেছেন। এতে অনেকের মতো আমিও এক ধরনের স্বস্তির মধ্যে রয়েছি। কারণ, কোয়ারেন্টাইন ও লকডাউনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় ১৯৭৪ সালের কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কটের কষ্টকর অভিজ্ঞতা আমাকেও আতঙ্কিত করে ফেলেছিল। আতঙ্কিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, অনাহারে মানুষের মৃত্যু হলে সেটা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর শত্রুরা আবারও হৈচৈ বাঁধিয়ে ঘোলাজলে মাছ শিকারে লিপ্ত হতে পারে। ১৯৪৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর শত্রুরা নানা নামে, নানা মোড়কে, নানা পোশাকে, দেশে-বিদেশে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সব সময় তৎপর রয়েছে। তাঁরাই শেখ হাসিনার সদা-সক্রিয় শত্রু। উল্লেখ্য, এ কথা আমি শেখ রেহানা সম্পাদিত নবপর্যায়ে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিত্রা-র প্রথম সংখ্যায় লিখেছিলাম। এখনও বলি, শেখ হাসিনার নেতৃরূপ আজ কোমলে-কঠোরে উদ্ভাসিত। তিনি ডান হাতে পূর্ণ করেন জনতার ভালবাসার পাত্র আর বাঁ হাতে চূর্ণ করেন শত্রুর মারণাস্ত্র। তাই তো এই করোনা সঙ্কটকালেও বঙ্গবন্ধুর খুনীর ফাঁসির রায় তাঁকে কার্যকর করতে হয়। আমার দৃঢ় বিশ^াস, শেখ হাসিনার জীবনের ওপর চরম হুমকি না থাকলে তিনি সারাদেশের করোনা উপদ্রুত এলাকায় ঘুরে ঘুরে মায়ের মমতা নিয়ে বিপন্ন মানুষের পাশের দাঁড়াতেন। অতএব, করোনাভাইরাসকে উপলক্ষ করে ছদ্মবেশী ও মুখচেনা শত্রুদের অপতৎপরতা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি ও শেখ হাসিনার মিত্রদের গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। মোকাবেলার জন্য সদা-সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। নিজেদের দোষারোপের সময় এটা নয়। অন্যদিকে, আমরা যাতে অতিসংবেদনশীল হয়ে শেখ হাসিনার শত্রুদের হাতে অস্ত্র তুলে না দিই- সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। সারা পৃথিবীর সকলের সঙ্গে মিলেমিশে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের প্রধান কর্তব্য। আমাদের মনে রাখতে হবে- বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি শেখ হাসিনা। দেশের কল্যাণে তাঁর নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রনায়কত্ব পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনার মহাসঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারলে নিশ্চয়ই অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান আমরা সহজে করতে সক্ষম হব। লেখক : ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর
×