ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

এক বছর তিন মাসে অগ্রগতি মাত্র ১৫ শতাংশ

পান্থকুঞ্জ আধুনিকায়নের উদ্যোগ আটকে আছে মেট্রোরেলে

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 পান্থকুঞ্জ আধুনিকায়নের উদ্যোগ আটকে আছে মেট্রোরেলে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর পান্থকুঞ্জ পার্ক। ২০১৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর এ পার্কের আধুনিকায়ন শুরু করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। এরপর দীর্ঘ এক বছর তিন মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত পার্ক আধুনিকায়নের অগ্রগতি মাত্র ১৫ শতাংশ। কাজ শুরুর পর থেকেই পার্কটি বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে সিটি কর্পোরেশনের দাবি, মেট্রোরেলের উন্নয়ন কাজের জন্য পার্কের নকশায় পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। সে কারণে এর নির্মাণ কাজ বন্ধ। একই অবস্থা শহীদনগর মিনি স্টেডিয়ামের। ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট শুরু হওয়া পার্কটির কাজ গত আড়াই বছরে মাত্র ৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। শুধু এ দুটি পার্ক নয়, এমন বেশ কয়েকটি পার্কের অবস্থা এমন। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। উন্নয়নের জন্য উদ্যোগ নেয়া ৩০টি পার্ক ও মাঠের মধ্যে ১০টির কাজ শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ১০টির কাজ এখনও ৫০ শতাংশের কম। বাকি ১০টির কাজ অর্ধেকের বেশি শেষ হয়েছে। জানা গেছে, ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন নির্বাচিত হওয়ার পর সংস্থাটির ১৯টি পার্ক আর ১২টি খেলার মাঠ আধুনিকায়নের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালের জুনে। কিন্তু নির্ধারিত প্রকল্পের নক্সা পরিবর্তন, ব্যয় বৃদ্ধি ও নানা জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে সব পার্কের কাজ শেষ করতে পারেনি ডিএসসিসি। এজন্য এরই মধ্যে দুই ধাপে সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ধরা হলেও পরবর্তীতে তার নক্সা পরিবর্তন ঘটিয়ে ১ হাজার ৭০০ কোটি ১৯ লাখ টাকায় ঠেকেছে। এই বরাদ্দের ৭০ শতাংশ দেবে সরকার, বাকি ৩০ শতাংশ বহন করবে ডিএসসিসি। ডিএসসিসির এসব মাঠ ও পার্কের উন্নয়নে নেওয়া ‘জল-সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের ৩১টি মাঠ ও পার্কের নক্সা প্রণয়ন করেছেন স্থপতি রফিক আযমের নেতৃত্বে সংস্থাটির ৭০ জন স্থপতি। তাদের নির্দেশনায় মাঠগুলো আধুনিকায়নের কাজ চলছে। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৬২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তবে সিটি কর্পোরেশন বলছে- প্রকল্পে নতুন করে দুটি পার্ক যুক্ত করায় শতকরা হার কমেছে। আরও একটি পার্ক যুক্ত করা হবে। মেয়র সাঈদ খোকনের মেয়াদকালে ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি। প্রকল্পের আওতায় পার্কগুলোতে জাদুঘর, পাঠাগার, ব্যায়ামাগার, গ্রিন জোন, পাবলিক প্লাজা, লেডিস কর্নার, ফুটবল খেলার ব্যবস্থা, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, বসার বেঞ্চ, প্রজাপতি আকর্ষণ করে এমন ফুলবাগান, পানির ফোয়ারা, ওয়াটার বডি, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের ভাস্কর্য, পাবলিক টয়লেট, ছাদে বাগান করার মডেল, এলইডি লাইটিং সিস্টেম, পানি নিষ্কাশনের বিশেষ ব্যবস্থা, কপি হাউস, ফুড কোর্ট, কার পার্কিং, ক্রিকেট নেট প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা ইত্যাদি সুবিধা রাখা হয়েছে। পার্কগুলোতে হাতিরঝিলের মতো জলাধারের পাশাপাশি তৈরি করা হবে সবুজ বাগান ও বেষ্টনী। থাকবে ছোট ও বড়দের পৃথক খেলার মাঠ। পরিবার নিয়ে বেড়ানোর জন্য মনোরম স্থান। এসবের সমন্বয়ে এক সময়ের পরিত্যক্ত ও বেদখলে থাকা পার্কগুলো জল-সবুজে ঢেকে অপরূপ করে সাজবে। প্রকল্পভুক্ত পার্ক ও মাঠগুলোর মধ্যে সিক্কাটুলী পার্ক, মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন পার্ক, আউটফল স্টাফ কোয়ার্টার শিশুপার্ক, জোড়পুকুর পার্ক, বাসাবো মাঠ, শহীদ আব্দুল আলীম খেলার মাঠ ও রসুলবাগ শিশুপার্কের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে নবাবগঞ্জ পার্কের কাজ ৯৫ ভাগ, গুলিস্তান পার্কের (শহীদ মতিউর) কাজ ৮৫ ভাগ, বাহাদুরশাহ পার্কের কাজ ৮৫ ভাগ, গজমহল পার্কের কাজ ৮০ ভাগ, দেলোয়ার হোসেন খেলার মাঠের কাজ ৭৫ ভাগ, বালুরঘাট খেলার মাঠের কাজ ৭০ ভাগ, মতিঝিল পার্কের কাজ ৭০ ভাগ, সিরাজ উদ্দৌলা পার্ক ও বংশাল ত্রিকোণাকার পার্কের কাজ ৬৫ ভাগ শেষ হয়েছে। এছাড়াও ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কাজ হয়েছে এমন পার্ক বা খেলার মাঠগুলো হচ্ছে কলাবাগান খেলার মাঠ (৬০ ভাগ), গোলাপবাগ খেলার মাঠ (৫৪ ভাগ), যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা পার্ক (৫০ ভাগ), মালিটোলা পার্ক (৫০ ভাগ)। আর ৫০ ভাগের নিচে উন্নয়ন হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ওসমানী উদ্যান বা গোসস্যা নিবারণী পার্ক (৪৫ ভাগ), বকশীবাজার পার্ক (৪৫ ভাগ), বশির উদ্দিন পার্ক (৪০ ভাগ), হাজারীবাগ পার্ক (৪০ ভাগ), বাংলাদেশ মাঠ (৩০ ভাগ), সাদেক হোসেন খোকা খেলার মাঠ (২৫ ভাগ), পান্থকুঞ্জ পার্ক (১৫ ভাগ), আজিমপুর শিশুপার্ক (১০ ভাগ), শহীদনগর মিনি স্টেডিয়াম (৫ ভাগ) ও সামসাবাদ খেলার মাঠ (মাত্র ২ ভাগ)। সব মিলিয়ে ৩০টি পার্ক ও খেলার মাঠের কাজ ৬২ শতাংশ শেষ হয়েছে। আগামী ৬ মাসের মধ্যে বাকি কাজ শেষ করতে হবে সিটি কর্পোরেশনকে। ডিএসসিসির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দাবি, প্রকল্পটির মাঠ ও পার্ক অংশের কাজ গড়ে ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি যা আছে সেগুলো হচ্ছে মাঠের বাইরে অন্য স্থাপনা নির্মাণ, সৌন্দর্য বর্ধন ও উন্নয়নের কাজ। চালু হওয়া পার্ক ও খেলার মাঠগুলোর বিষয়ে সন্তুষ্ট স্থানীয় বাসিন্দারা। বাসাবোর বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আলাউদ্দিন পার্কের পাশের বাসিন্দা আরজুমান আরা বেগম বলেন, বাচ্চাদের খেলার জন্য কখনও জায়গা পাইনি। এখন সকাল বিকাল মাঠে গিয়ে তারা খেলতে পারে। অনেক সুন্দর মাঠ। এখন ব্যবস্থাপনাও যদি ভালো হয় তাহলে মাঠগুলো দীর্ঘদিন টিকে থাকবে। তবে কয়েকটি মাঠ ও পার্কের কাজ এখনও শেষ না হওয়ায় ক্ষোভও রয়েছে অনেকের। ওসমানী উদ্যানে স্থাপিত গোসস্যা নিবারণী পার্কের কাজ এখনও শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোড়ের বাসিন্দা সামছুর রহমান বলেন, পার্কগুলো অনেকদিন ধরে কাজ চলছে। বিশেষ করে ওসমানী উদ্যানের কাজ এখনও শেষ হয়নি। তিন বছর ধরে পার্কটির কাজ অর্ধেকও শেষ হয়নি। কাজের গতি আরও বাড়ানো উচিত। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক ও ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বলেন, পার্কগুলোকে বিশ্বমানের আদলে তৈরি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকটি পার্ক উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। আমরা নির্ধারিত সময়েই প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারতাম। কিন্তু মেট্রোরেলসহ বেশ কিছু কারণে কয়েকটি পার্ক ও মাঠের নক্সায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে। আবার নতুন করে কয়েকটি মাঠ ও পার্ককে প্রকল্পে যুক্ত করা হয়। এ কারণেই প্রকল্পের মেয়াদও বাড়াতে হয়েছে। এজন্য গড় মূল্যায়নে প্রকল্পের অগ্রগতি কম দেখা গেলেও এরই মধ্যে ১০টির কাজ শেষ হয়েছে। কয়েকটি শেষের পথে রয়েছে। বাকিগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারব বলে আমরা আশা করছি। জানতে চাইলে ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, আমরা নাগরিকদের জন্য একটি বাসযোগ্য ঢাকা গড়তে এই প্রকল্প গ্রহণ করেছিলাম। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৩১টি মাঠ ও পার্ককে বিশ্বমানের হিসেবে গড়ে তোলার কাজ চলছে। এরই মধ্যে ১০টি মাঠের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। ৫টি মাঠ নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। নাগরিকরা এই মাঠ ও পার্কগুলোতে চলাচলের জন্য সব সুযোগ সুবিধা পাবেন। তিনি বলেন, আগামী ১৭ মে পর্যন্ত মেয়র হিসেবে আমার মেয়াদ আছে। এই সময়ের মধ্যে বাকিগুলোর কাজ চালিয়ে যাবো। তবে কিছু প্রকল্প আছে, সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আশা করছি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত মেয়র যিনি আসবেন, তিনি বাকি কাজ সমাপ্ত করবেন। একজনের পক্ষে তো সব কিছু করা সম্ভব নয়। আমি শুরু করে দিয়ে গেলাম, বাকি কাজ যিনি আসবেন তিনি করবেন। এরই মধ্যে প্রকল্পের কাজ ৮৫-৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। কাজের গতি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে পার্কগুলোর নকশা প্রণয়নকারী দলের প্রধান স্থপতি রফিক আজমেরও। তিনি বলেন, অনেক যুদ্ধ করে পার্কগুলোর রূপ পরিবর্তনের কাজ করেছি। সিটি কর্পোরেশন তো এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তাদের রক্ষণাবেক্ষণের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ঠিকাদাররাও এমন ধরনের কাজ কখনও দেখেনি। তাদেরকে শিখতে হচ্ছে, আরও শিখতে হবে। কাজের ধীরগতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ধীরগতিতে কাজ করা তো আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এটা আমাদের বহু বছরের কালচার। তাদের অভ্যাসই হচ্ছে কাজ না করে বিল তুলে নিয়ে যাওয়া। তবে এখন আর সেই সুযোগ নেই। এই ধারাটা অব্যাহত থাকলে এই শহর পরিবর্তন হবে বলে মনে করেন তিনি।
×