ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

পবিত্র গুহার দেশে গেমসের নানা অভিজ্ঞতা

প্রকাশিত: ১১:৫০, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯

পবিত্র গুহার দেশে গেমসের নানা অভিজ্ঞতা

২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল সাউথ এশিয়ান গেমস (এসএ গেমস)। তখন প্রথমবারের মতো এই গেমসটি কভার করা সৌভাগ্য হয়েছিল। সেবার একাদশতম সেই আসরে ছিল ২৩টি খেলা। তবে আমিসহ একাধিক সহকর্মী গেমসটি কভার করায় আমাকে শূটিং, সাঁতার, ফুটবল, সাইক্লিং ও কারাতে ... এই পাঁচটি খেলা নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল। ২০১৬ আসর অনুষ্ঠিত হয় ভারতের শিলং ও গুয়াহাটিতে। সেখানে যাওয়ারও সব ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু মায়ের প্রচ- অসুস্থতার কারণে শেষ মুহূর্তে যাওয়া বাতিল করতে হয়। ২০১৯ আসরটি যেন মিস না হয়, সেজন্য আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। পৃষ্ঠপোষকও জোগাড় করা হয়েছিল। কিন্তু যাওয়ার কয়েকদিন আগে অন্য একটি ঘটনায় ‘সারপ্রাইজড’ হলাম। বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি আমাকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নেপালে অনুষ্ঠিতব্য গেমসটিতে পাঠানোর জন্য মনোনীত করে (লটারির মাধ্যমে)। এক্ষেত্রে আমাকে সবরকম সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেয় বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশন (বিওএ)। হিমালয়ের দেশ নেপাল। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ১০টি পর্বতমালার ৮টিই এই দেশে অবস্থিত। ইন্টারনেট ঘেঁটে জানা গেল নেপাল নামের অর্থ। নেপালী ভাষায় ‘নে’ অর্থ পবিত্র আর ‘পাল’ অর্থ গুহা। তার মানে নেপাল অর্থ পবিত্র গুহা! এই পবিত্র গুহার দেশে ছিলাম মোট দুই সপ্তাহ। রওনা হই ২৯ নবেম্বর। ফিরি ১২ ডিসেম্বর। প্রতিবারই উড়ালপঙ্খীর নাম ছিল ‘বিমান বাংলাদেশ।’ ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু যেতে সময় লাগে সোয়া এক ঘণ্টা। কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টে অবতরণ করতে গিয়ে বছর খানেক আগে বাংলাদেশের একটি বেসরকারী সংস্থার বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে প্রচুর যাত্রী মারা গিয়েছিল। তখন থেকেই জানি বিশ্বের সবচেয়ে বিপদসংকুল বিমানবন্দরের মধ্যে কাঠমান্ডু একটি। ফলে প্লেন ল্যান্ডিং করার সময় ভয় পাইনি, এটা বললে মিথ্যে বলা হবে। তবে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এ রকম কিছু ঘটেনি। যাওয়া-আসার সময় প্রতিবারই ফ্লাইট ডিলে হয়েছিল। যাওয়া সময় আধঘণ্টা। আসার সময় আড়াই ঘণ্টা। বিমানে সব যাত্রীদের দুপুরের লাঞ্চ হিসেবে যে খাবার দেয়া হয়েছিল, সেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। আমার তো পেটে গ্যাসই হয়ে যায়। যন্ত্রণা উপশমের জন্য বিমানবালার কাছে ট্যাবলেট চাইলে তিনি শোনালেন আজব কথা, ‘যাত্রীদের এন্টাসিড দিতে আমাদের মানা আছে। তবে কারও অবস্থা সিরিয়াস হলে দেয়া যেতে পারে। যদি পাই, তাহলে আপনাকে দেব।’ কিন্তু ট্যাবলেট খুঁজে আমাকে দেয়ার আর সময় তিনি পেলেন না। কারণ ততক্ষণে বিমানের চাকা কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টের রানওয়ে স্পর্শ করেছে! আগেই জানতাম, নেপালে এখন প্রচ- শীত (দিনে ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস, রাতে এর অর্ধেক!)। সেজন্য যথেষ্ট গরম জামাকাপড় নিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। প্রচ- ঠা-ায় মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি ‘হাড় কাঁপানো শীত’ কাকে বলে। কাঠমান্ডুর সুন্দরা নামের স্থানে গিয়ে একটি হোটেলে উঠলাম আমরা চার বাংলাদেশী (সমকালের রিপোর্টার সাখাওয়াত হোসেন জয়, ফটোগ্রাফার মাহবুব হোসেন নবীন ও রাইজিং বিডির রিপোর্টার আমিনুল ইসলাম)। হোটেলের সার্ভিস প্রথমদিকে ভাল থাকলেও শেষদিনে খুবই বাজে ছিল। কল দিয়ে গরম জল না আসা, বিদ্যুত চলে যাওয়া, ইন্টারনেটের ধীর গতিসহ নানা সমস্যায় অতিষ্ঠ হয়ে ঢাকা ফেরার চার দিন আগে পাশেই আরেকটি হোটেলে গিয়ে উঠতে বাধ্য হলাম। সেখানে আর কোন যন্ত্রণা পোহাতে হয়নি। ১৪ দিন নেপালে থাকাকালে এসএ গেমস নিয়ে এতটাই ব্যস্ততায় ছিলাম একটা দিন কোথাও ঘুরে বেড়ানোরও ফুরসত পাওয়া যায়নি। সকাল ৮টা থেকেই শুরু হতো আমাদের কর্মযজ্ঞ। প্রতিদিন ৫-৬টা ভিন্ন ভিন্ন ভেন্যুতে দৌড়াদৌড়ি, নিউজ ও ছবি সংগ্রহ। তারপর মিডিয়া সেন্টারে এসে লিখে তা ই-মেইল করে যথাসময়ে অফিসে পাঠানো। মোট কথা, কাজের চাপে দম ফেলার যেন অবকাশ ছিল না। তবে সবমিলিয়ে নেপাল ট্যুর বেশ উপভোগই করেছি। কভার করেছি বাংলাদেশের অংশ নেয়া ২৫ খেলাই। নেপালে সবকিছুরই অস্বাভাবিক দাম। ট্যাক্সি ভাড়াও। আমরা নেপালি নই বা বাংলাদেশী ... এটা বুঝতে পারলে ট্যাক্সি চালকরা দ্বিগুণ ভাড়া চাইত। প্রথমদিকে এটা বুঝতে না পারায় বার দুয়েক আমাদের ঠকতেও হয়েছে। পরে নেপালি সাংবাদিক-বন্ধু দীপেশের কাছ থেকে বুদ্ধি পেয়ে তা কাজে লাগালাম। ভাড়া ঠিক করার সময় সঠিক ভাড়া বলতাম। তাতে চালক রাজি না হলে নেপালী পুলিশ ডাকার ভয় দেখাতাম। কাছাকাছি পুলিশ না থাকলে ১০৩ নম্বরে ডায়াল করলেই ঘটনাস্থলে পুলিশ চোখের পলকে চলে আসবে ... এই ভয়ও দেখাতাম। এই হুমকিতে যে বেশ ভালই কাজ হয়েছে, সেটা তো বুঝতেই পারছেন! একদিন আমরা গেলাম নতুন ভেন্যু হালচকের আমর্ড পুলিশ ট্রেনিং গ্রাউন্ডে (সেখানে বাংলাদেশ ফুটবল দলের অনুশীলন)। জায়গাটা চিনি না। ফলে পুলিশের সাহায্য নিলাম। তারা বেশ আন্তরিক। এক পুলিশ সার্জেন্ট আমাদের সঠিক ভাড়ায় ট্যাক্সি ঠিক করে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, আমাদের রীতিমতো ‘এসকর্ট’ করে, সাইরেন বাজিয়ে ২০ কিমি. দূর পর্যন্ত সেই ভেন্যুতে নিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে। রাস্তার পথচারীরা বেশ অবাক হয়েই আমাদের তখন দেখছিল। তখন আমাদের যেমন লজ্জা লাগছিল, তেমনি নিজেদের ভিআইপি ভেবে গর্বও হচ্ছিল! ২০১৮ সালের মার্চে এই ক্রীড়া মহাযজ্ঞ নেপালের মাঠে গড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্পে নেপালে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় গেমসের মূল ভেন্যু দশরথ স্টেডিয়াম। তার পাশাপাশি ভারতের অনাগ্রহের কারণে কয়েক দফা পিছিয়ে যায় এই গেমস। শেষ পর্যন্ত সকল অপেক্ষা আর শঙ্কার অবসান ঘটিয়ে গত ১ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১৩তম এসএ গেমস। এবারের গেমসে ৭ দেশ ২৭ ডিসিপ্লিনে অংশ নেয়। ২৭১৫ এ্যাথলেট ১১১৫টি পদকের জন্য লড়েন। তার মধ্যে স্বর্ণ ৩১৭, রৌপ্য ৩১৭ ও তা¤্রপদক ৪৮১। আয়োজক দেশের সুযোগ থাকে নতুন কিছু ডিসিপ্লিন যুক্ত করার। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নেপাল যুক্ত করে ক্রিকেট ও প্যারাগ্লাইডিং। পরবর্তীতে প্যারাগ্লাইডিং বাদ দেয়া হয়। মাত্র চার মাস মাসের প্রস্তুতি নিয়েও বাংলাদেশ এবার বিদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত আসর থেকে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ জেতার পাশাপাশি নিজেদের ইতিহাসেই সবচেয়ে বেশি স্বর্ণজয় করে করে। এবার ৬ খেলা থেকে বাংলাদেশের এসেছে রেকর্ড ১৯ স্বর্ণ। রৌপ্য জিতেছে ৩৩। আর তা¤্রপদক ৯০। সবমিলিয়ে ১৪২ পদক। রৌপ্য, তা¤্র ও মোট পদকপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও নিজেদের অতীতের সর্বোচ্চ অর্জনকে এবার ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। যেসব খেলা থেকে বাংলাদেশ এবার স্বর্ণ জিতেছে, তা হলো ১০টি আরচরি থেকে, ৩টি কারাতে, ২টি ক্রিকেট (পুরুষ ও নারী), ২টি ভারোত্তোলন, ১টি করে ফেন্সিং এবং তায়কোয়ানন্দো থেকে। তবে এতকিছু অর্জনের পরও কিছু হতাশাও আছে। এবারের আসরে বাংলাদেশের ২৫ ফেডারেশন অংশ নিলেও তার মধ্যে পাঁচ ফেডারেশন কোন পদকই জিততে পারেনি! এগুলো হচ্ছেÑ ভলিবল, বাস্কেটবল, সাইক্লিং, টেনিস এবং স্কোয়াশ ফেডারেশন। ২০১৬ আসর পর্যন্ত বাংলাদেশ যত স্বর্ণ জিতেছে (৬৭), তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২২ স্বর্ণপদকই এসেছিল শূটিং থেকে। ২০০৬ আসরের পর এই প্রথম এবারের আসরে কোন স্বর্ণ জেতেননি বাংলাদেশী শূটাররা। সাঁতারেও ২০১০ সালের পর এবার কোন স্বর্ণ আসেনি বাংলাদেশের। ফুটবলে এবার ভারত না থাকায় বাংলাদেশের পদক জয়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তারা এবার বিস্ময়করভাবে জেতে তা¤্রপদক, যা ছিল বিস্ময়কর। ৪ ম্যাচে ৩৬০ মিনিট খেলে বাংলাদেশ মাত্র একটি ‘জেনুইন’ গোল করে। ফুটবলারদের খেলা দেখে মনে হয়েছে তারা যেন শরীর বাঁচিয়ে খেলছেন। এছাড়া ফুটবলারদের জঘন্য খেলা দেখে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন তাদের দেশপ্রেম নিয়ে। এ নিয়ে টানা দুটি এসএ গেমসে স্বর্ণের লড়াই থেকে ছিটকে পড়ে জেমি ডের দল। এবারের গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পতাকা বহন করতে পারেননি সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলা। বড় আক্ষেপ ছিল তার। কিন্তু সমাপনী অনুষ্ঠানে আর সেই আক্ষেপ থাকেনি। কারণ লাল সবুজের ঝা-া ছিল তার হাতেই। শিলার কথায়, ‘উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে একটি বিশেষ প্রদর্শনীর জন্য আমাদের ছয় দেশের আনা পতাকা তারা নিয়ে গিয়েছিল। যার কারণে ওইদিন আমি পতাকা বহন করতে পারিনি। তবে আমার সেই আক্ষেপ দূর হয়ে গেল।’ ২০১৬ আসরে দুটি স্বর্ণপদক জিতলেও এবারের আসরে ব্যক্তিগত কারণে দলে ছিলেন না সাঁতারু শিলা। তবে দলে না থাকলেও বিশেষ সম্মান জানাতে পতাকা বহন করার জন্য কাঠমান্ডুতে নিয়ে আসা হয় তাকে। এবারের আসরে বাংলাদেশকে স্বর্ণ সাফল্যে যারা ভাসিয়েছেন তারা হলেনÑ দীপু চাকমা (তায়কোয়ান্দোতে পুরুষদের একক পুমসা উর্ধ-২৯ শ্রেণীতে), আল-আমিন (কারাতেতে কুমি ইভেন্টে মাইনাস ৬০ কেজি ওজন শ্রেণীতে), হুমায়রা আক্তার অন্তরা (কারাতেতে কুমিতে অনুর্ধ-৬১ কেজি ওজন শ্রেণীতে), মারজান আক্তার প্রিয়া (কারাতেতে ব্যক্তিগত কুমিতে মাইনাস ৫৫ কেজি ওজন শ্রেণীতে), মাবিয়া আক্তার সীমান্ত (ভারোত্তলনে ৭৬ কেজি ওজন শ্রেণীতে), জিয়ারুল ইসলাম (ভারোত্তোলনে ৯৬ কেজি ওজন শ্রেণীতে), ফাতেমা মুজিব (ফেন্সিংয়ে সাবের এককে), ইতি খাতুন, মেহনাজ আক্তার মুনিরা ও বিউটি রায় (আরচারির রিকার্ভ নারী দলগত ইভেন্টে), ইতি খাতুন ও রোমান সানা (আরচারির রিকার্ভ মিশ্র দলগত ইভেন্টে), সোহেল রানা, অসীম কুমার দাস ও আশিকুজ্জামান (আরচারির কম্পাউন্ড পুরুষ দলগত ইভেন্টে), সুস্মিতা বণিক, সুমা বিশ্বাস ও শ্যামলী রায় (আরচারির কম্পাউন্ড মহিলা দলগত ইভেন্টে), সোহেল রানা ও সুস্মিতা বণিক (আরচারির কম্পাউন্ড মিশ্র দলগত ইভেন্টে), সোমা বিশ্বাস (আরচারির কম্পাউন্ড নারী ব্যক্তিগত ইভেন্টে), সোহেল রানা (আরচারির কম্পাউন্ড পুরুষ ব্যক্তিগত ইভেন্টে), রোমান সানা (আরচারির রিকার্ভ পুরুষ একক ইভেন্টে), ইতি খাতুন (আরচারির রিকার্ভ মহিলা একক ইভেন্টে), রোমান সানা, তামিমুল ইসলাম এবং হাকিম আহমেদ রুবেল (আরচারিতে পুরুষদের দলগত রিকার্ভ ইভেন্টে) এবং পুরুষ ও নারী ক্রিকেটে স্বর্ণ বাংলাদেশ অ-২৩ জাতীয় ক্রিকেট দল। (বাকি অংশ পরবর্তী সংখ্যা)
×