ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

শিল্পের রঙে রাঙিয়ে দেয়ার প্রয়াস ‘কালারস’

প্রকাশিত: ১২:৩৯, ৩০ আগস্ট ২০১৯

শিল্পের রঙে রাঙিয়ে দেয়ার প্রয়াস ‘কালারস’

একই আঙিনায় পড়াশোনা শিল্পকলার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। আর সেই আঙিনাটি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বিভিন্ন বিভাগ। প্রত্যেকেই একে অপরের সহপাঠী। একই বছর শিক্ষা সমাপন করার ফলে প্রত্যেকে আবার একে অপরের বন্ধুও বটে। পারস্পরিক শৈল্পিক প্রকাশভঙ্গির সঙ্গেও তারা পরিচিত এবং একে অপরের বোঝাপড়াও চমৎকার। তারপর এক সময় শিল্পের সঙ্গে বিচ্ছেদ; খানিকটা বন্ধত্বেরও। তাদের ভাষায় বলতে হয় ‘জীবন যখন পুরোপুরি গ্রাস করে নিয়েছিল।’ জীবন বাস্তবতার নানা অলিতে গলিতে ঘুরছিল এক একটি শিল্পী জীবন। দুই একজন শিল্প চর্চা চালিয়ে গেলেও বলতে গেলে বেশিরভাগই আর চর্চার মধ্যে ছিলেন না। ধীরে ধীরে এক একজনের শিল্প জীবন সাধারণ জীবনে পরিণত হচ্ছিল। একেএকে শিল্পের মধ্যে থাকতে না পারার হতাশা গ্রাস করছিল প্রত্যেককে। বৈষয়িক জীবনের বাস্তবতা, পারিবারিক, সামাজিক বাধা কিংবা অনেকটা আলস্যের কারণে এক প্রকার দূরে সরে যাওয়া হয়েছিল শিল্প ভুবন থেকে। ঠিক এমন একটি সময়েই তারা তাদের অমিত সম্ভাবনার কথা ভাবতে থাকেন। যা ভাবা তাই কাজ। তারা ক’জন নারী মিলে গঠন করেন যৌথ শিল্পযাত্রার গ্রুপ ‘কালারস’। এর মাধ্যমেই প্রায় দীর্ঘ একযুগের বেশি সময় পর যেন তাদের আপন ঘরে ফেরা। এখন তাদের এই যৌথযাত্রা চার বছর পার করছে। বর্তমান সময়ে যেখানে যৌথ বিষয়টি প্রতিনিয়ত বাধাপ্রাপ্ত হয়ে চলেছে সেখানে তাদের যৌথযাত্রা বলতেই হবে অনেকটাই মসৃণ গতিতেই চলছে। তাদের এই যৌথযাত্রার বন্ধন যে অত্যন্ত দৃঢ় সেটি তারা মনে হয় ইতোমধ্যে প্রমাণও করতে পেরেছেন। এই চার বছরে তারা এতটাই কজে ফিরেছেন যে ইতোমধ্যে চারটি শিল্পকর্ম প্রদর্শনী করে ফেলেছেন। আর গত ২৩ আগস্ট, শুক্রবার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার লা গ্যালারিতে শুরু হয়েছে এই গ্রুপের পঞ্চম শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। এটি চলবে আগামী ৩১ আগস্ট,শনিবার পর্যন্ত। চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য ও টেরাকোটা সব মিলিয়ে মোট ৪৫টি শিল্পকর্ম এখানে স্থান পেয়েছে। এবারের প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী ৯জন শিল্পী হলেন শায়লা আখতার, রিফাত জাহান, রেহেনা ইয়াসমিন, রেবেকা সুলতানা, মনিরা সুলতানা, মুক্তি ভৌমিক, মণিদীপা দাশগুপ্ত, ফারজানা ইসলাম ও ফারহানা আফরোজ। এই গ্রুপের আগের প্রদর্শনীগুলো আমার দেখার সুযোগ হয়নি। তবে এবারের প্রদর্শনীতে যা দেখলাম তাতে প্রথমতঃ আমি গ্রুপটির নামকরণ ‘কালারস’-এর স্বার্থকতা খুঁজে পাই। প্রতিটি শিল্পকর্মে আমাদের জীবনকে নানা বর্ণে বর্ণিলরূপে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্যেকের কাজ যথেষ্ট বৈচিত্রপূর্ণ। মাঝখানে যে অনেকের দীর্ঘ বিরতি ছিল সেটি নিশ্চয়ই গত চার বছরে ঝালিয়ে নিয়েছেন তাদের কাজ দেখে সেটিই মনে হয়েছে। শিল্পের জন্য বিষয়বস্তু নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কারণ এক একজন শিল্পদর্শক বলি বা শিল্পরসিক বলি আমরা সেই বিষয়টিই দেখতে চাইব যেটি আমাদের মনকে ভাল লাগায় ভরিয়ে দেয়; মনের খোরাক জোগায়। সেদিক থেকে এবারের প্রদর্শনীতে প্রত্যেক শিল্পীর বিষয় নির্বাচনটি মুগ্ধ করেছে, মন ভরিয়ে দিয়েছে এবং সর্বোপরি মনের খোরাক যোগাতে সক্ষম হয়েছে। শায়লা আখতারের মিশ্র মাধ্যমের চিত্রকর্ম সিরিজ ‘সুপারমুন’। আমরা জানি যে সুপারমুন চাঁদের এমন একটি অবস্থা যখন চাঁদকে বিশালাকার দেখা যায়। চাঁদের আলোয় পৃথিবী ঝকঝক করে। এমন আলোয় যে কারো মন ভালো হয়ে যায়। তার এ চিত্রকর্মগুলোতে জীবনকে আলোয় ভরা দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। তার আবার অন্ধকার কিসের? তিনি কী তাই বোঝাতে চেয়েছেন? হয়তোবা তাই হবে। আমরা দর্শক হিসেবে তার এই সিরিজে আলোকিত জীবনকে দেখতে পাই। রিফাত জাহান মিশ্র মাধ্যমের ‘ইনকোয়েস্ট অব লিবার্টি’ চিত্রকর্মে নারীর অগ্রগতি, মুক্তি, স্বাধীনতার কথা বলতে চেয়েছেন। তার চিত্রকর্মে নারী অবয়ব দেখা যায়; পাখি দেখা যায়। পাখি স্বাধীন। যখন খুশি চাইলেই উড়াল দিতে পারে। তিনি কী তবে তার বিষয়বস্তুতে নারীকে পাখির মতো স্বাধীন দেখতে চেয়েছেন? যদি তাই হয় তাহলে অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। পুরুষশাসিত সমাজ আমরা বলে থাকি। সেই তথাকথিত পুরুষশাসিত সমাজে নারী কেনইবা আবদ্ধ থাকবে? পুরুষের যেমন স্বাধীনতা আছে তেমনি নারীরও স্বধীনতা থাকতে হবে। তার চিত্রকর্ম আমাদের নারীর স্বাধীন সত্তা জানান দেয়। রেহেনা ইয়াসমিন ভাস্কর্যে টেরাকোটার মাধ্যমে ‘পরিত্যক্ত’ শিরোনামে বাড়ি-ঘর, দেয়াল, দেয়ালে গাছের শিকড় বাকড়সহ এক সুন্দর নান্দনিকতায় উপস্থাপন করেছেন। যেন মুহূর্তেই আমরা চলে গিয়েছি পুরোনো; পরিত্যক্ত কোন স্থাপনায়। আবার একটি শিল্পকর্মে ‘ফ্যামিলি’ শিরোনামে পেঁচা পরিবারকে উপস্থাপন করে আমাদের পারিবারিক বন্ধনকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তার শিল্প কর্মগুলো মন ভালো করে দেয়। রেবেকা সুলতানা এ্যাক্রেলিক অন ক্যানভাসে এঁকেছেন ‘আননোন লাভ’ ও ‘ফেস’ শিরোনামে একগুচ্ছ চিত্রকর্ম। প্রতিটি চিত্রকর্মে সুন্দর নারী মুখাবয়ব ফুটিয়ে তুলেছেন। খোঁপায় ফুলসহ প্রতিটি মুখচ্ছবি সাজগোজে পরিপূর্ণ। তার চিত্রকর্মে নারীর সৌন্দর্য ও ভালোবাসার রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। পৃথিবীটা ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে উঠুক আমরা তার চিত্রকর্ম থেকে এই বার্তা পাই। মনিরা সুলতানা টেরাকোটা মাধ্যমে ‘অন্তর’ শিরোনামে আমাদের হৃদয়কে উপস্থাপন করেছেন। হৃদয় আমাদের একটিই। আর সেই একটি হৃদয়েই দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আনন্দ, ভালোবাসা সবকিছুকেই ধারণ করতে হয়ে। হৃদয়ের এই নানান রূপ তিনি নানা রঙে ও বর্ণে এক নান্দনিক উপস্থাপনা করেছেন। আমরা তার এই শিল্পকর্ম দেখে অনুধাবন করতে পারি যে এক হৃদয়ে ভালো, মন্দ সব কিছুই সইবার ক্ষমতা আমাদের থাকতে হবে। মুক্তি ভৌমিকের বেড়ে ওঠা চায়ের রাজ্য শ্রীমঙ্গলে। চা বাগান, পাহাড় এবং পরবর্তীতে সমতল সবমিলিয়ে এক বৈচিত্র্যপূর্র্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠবার কারণেই হয়তবা তার কাজেও বিচিত্র বিষয় খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি বেশিরভাগই তার শৈশবে দেখা বিভিন্ন বিষয়কে তার ভাস্কর্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। ‘চাইল্ডহুড’ শিরোনামের শিল্পকর্মগুলো তাই জানান দেয়। আবার ‘কিংফিশার’, ‘ক্রো’, ‘ব্রোকেন ব্রীজ’, ‘শেফারড’ শিরোনামের শিল্পকর্মগুলো আমাদের সকলের ফেলে আসা শৈশবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আবার শিল্পের মাধ্যম হিসেবেও তিনি এক জায়গায় স্থির থাকেননি। টেরাকোটা, মেটাল, এলুমিনিয়াম, ব্রোঞ্জের মতো বৈচিত্রপূর্ণ উপকরণকে তার শিল্পের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তার এই বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয় আমাদের একঘেয়েমিতা দূর করতে সাহায্য করে। মণিদীপা দাশগুপ্ত ‘ড্রিমস্কেপ’ শিরোনামের চিত্রকর্মে শহুরে জীবনের অভিজ্ঞতাকে এক স্বপ্নভূমিতে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। পাহাড়, শহর, নিসর্গের এক অপূর্ব মেলবন্ধন রচনা করেছেন তিনি। নিসর্গ ভালবাসেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর সেই নিসর্গের বুকে যদি এক টুকরো শহর থাকে তাহলে তো কথাই নেই। মন ভালো হয়ে যায়। তার চিত্রকর্মে লাল, হলুদ, নীল এরকম নানা বর্ণিল রঙের ব্যবহার জীবনকে মলিন বা সাদাকালো নয় বরং রঙিন ভাবতে সহায়তা করে। এ্যাক্রেলিক এ্যান্ড পেন অন পেপারে করা কাজগুলো মন ভালো করে দেয়। ফারজানা ইসলাম তার ভাস্কর্যে মানুষের নিগূঢ় অনুভূতিকে স্পর্শ করার প্রয়াস পেয়েছেন। ‘ফ্যামিলি’ শিরোনামের ভাস্কর্যে তিনি পারিবারিক বন্ধন, ভালোবাসা, আবেগ ও অনুভূতিকে প্রকাশ করেছেন। এখনকার ঠুনকো পারিবারিক বন্ধনকে অনেক বেশি দৃঢ় করবার প্রেরণা পাওয়া যায় তার এই শিল্পকর্ম থেকে। এছাড়া তার ‘ওয়েটিং’, ‘বেলকোনি’ ভাস্কর্যগুলোতে চারপাশের মানুষের জীবন, পুরনো স্থাপনা এবং প্রকৃতিকে আমাদের নজরে আনতে সহায়তা করে। ফারজানা ইসলাম তার ভাস্কর্যের মাধ্যম হিসেবে সচরাচর ব্রোঞ্জ, এলুমিনিয়াম ও আইরনের ব্যবহার করলেও এবারই প্রথম তিনি টেরাকোটা মাধ্যম দ্বারা শিল্প সৃষ্টির নিরীক্ষা চালিয়েছেন। আমরা বলতে পারি এই মাধ্যমেও তিনি স্বার্থক। ফারহানা আফরোজের চিত্রকর্মের ভাষা দৈনন্দিন জীবনের পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। যা তার চেতনার গভীরে চিরস্থায়ী দাগ রেখে গেছে। আমাদের জীবনে অনেক কিছুই প্রত্যাশা করি না কিন্তু ঘটে যায়;আর এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাগুলো আমাদের গ্রাস করে। এ্যাক্রেলিক অন ক্যানভাসে করা ‘আনএক্সপেক্টেড’ শিরোনামের কাজে এমন অভিব্যক্তিরই প্রকাশ দেখতে পাই আমরা। চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, টেরাকোটা প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত শিল্পকর্মগুলোতে রংধনুর সাত রং প্রকাশ পেয়েছে একথা বলতেই পারি। আর এখানেই ‘কালারস’-এর স্বার্থকতা। তারা আমাদের শিল্প ভুবন এভাবেই প্রতিনিয়ত রাঙিয়ে দিয়ে যাবেন সেটিই প্রত্যাশা। আজ থেকে চার বছর আগে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল সেটি দীর্ঘ হোক। ‘কালারস’-এর সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক শিল্পীর জন্য আমাদের শুভ কামনা।
×