ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আতাতুর্ক কামাল পাশা

সেরা দশ গল্প

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ৩০ আগস্ট ২০১৯

সেরা দশ গল্প

নুুরুল করিম নাসিম গত শতকের সত্তর দশকের শুরু থেকে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিশুতোষ, অনুবাদ সাহিত্যের কাজ করছেন। এসব নিয়ে ডজনেরও বেশি বই রয়েছে। এবারের বইমেলায় তাঁর সেরা দশ গল্প এসেছে। গল্পগুলো হচ্ছে, যে যার ভূমিকায়, তখন হঠাৎ যদি, গভীর গভীরতর অসুখ, বইয়ের ঘর, সেদিন আকাশে পূর্ণিমা ছিল না, মোহন রাতে মরা চাঁদ, কয়েকটি যন্ত্রণা, কবিতার জন্য, এবং আমি, ম্লান বিকেলের মরা রোদ, বাবার কালো ট্রাংক। গল্পগুলো সবই সময়ের, যুগের ও সমাজের প্রেক্ষাপট গ্রাহ্য করেছে। যে যার ভূমিকায় গল্পে তিনি একস্থানে লিখেছেন, ‘সাবসিডিয়ারী পরীক্ষার সময়ে রেজার সাথে দেখা হয়, কথা হয় এবং এইভাবে পরিপূর্ণ পরিচয়।’ এটি একটি সময়ে কথাও বটে, আজকের দিনে সম্মান শ্রেনীতে সাবসিডিয়ারী পরীক্ষা উঠে গেছে। তখন হঠাৎ যদি গল্পে তিনি কলকাতার কলেজস্ট্রীটের এক ঘরে বসে মধ্যবিত্ত জীবনের চিত্র এঁকেছেন। গভীর গভীরতর অসুখ গল্পে তিনি নাইমা নামের এক মধ্যবিত্ত ঘরের বিয়ে-বিচ্ছেদ মেয়ের জীবন সংগ্রাম তুলে ধরেছেন যিনি দূর গাঁওয়ের এক এনজিও-কর্মী। নুরুল করিম নাসিম দীর্ঘদিন থেকে লিখছেন, শুরুতে এ কথা বলা হয়েছিল। তার দৃঢ়তম প্রমাণ মেলে তাঁর লেখায়, তাঁর বাক্যগঠনে। সমগ্র বইতে এ দক্ষতা। যেমন, ‘লঞ্চের যে জায়গাটায় যাত্রীরা বসে, সেখানে একজন যুবক অনেকটা জায়গা জুড়ে কুকুরকু-লী হয়ে শুয়ে আছে।’ (পৃ-২০)। ‘অনেকে টাকা দিচ্ছে, কেউ কেউ দিচ্ছে না।’ (পৃ-২২)। ‘মেয়েটির চোখ অসম্ভব মায়াময়। টানাটানা, যেন অনেক কথা দুচোখের (দু’চোখের?) ভেতর গুমড়ে গুমড়ে মরছে। অথবা এরকম কিছু না-ও হতে পারে। আবার হতেও পারে।’ (পৃ-৬০)। অত্যন্ত স্বল্পবাকে তিনি একটি ঘটনা তুলে ধরার দক্ষতা দেখাতে পারেন, যেমন ‘সে একটি শান্তিময় সংসার চেয়েছিল। পায়নি। শুনেছি, তার স্বামী মধ্যরাতে বাড়ি ফিরে তার গায়ে হাত তুলতো। বেদম মারধর করতো। একদিন, দুদিন, তিনদিন। তারপর একদিন রাইমা ঘুরে দাঁড়ালো। শিক্ষিত মেয়ে, হৈচৈ না করে, নীরবে তাকে ত্যাগ করে চলে গেল।’ (পৃ-২৪)। ‘নির্জন রাজপথ নীরবতা নিয়ে শুয়ে থাকে’। (পৃ-৪৩)। এখানে এসব প্রসঙ্গ আনার কারণ হচ্ছে, আজকের দিনে যেসব গদ্য লেখা হচ্ছে, তাতে ভাষার ওপর বিশ^াস না রেখে, নিজের মেধাকে ব্যবহার না করে, ভাষায় কথার তীব্রতা দিয়ে, দীর্ঘ বর্ণনার ঘনঘটা ঘটিয়ে যা লেখা হচ্ছে তাতে পাঠকের বেশ ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। এখানে অনেক গদ্যকারের মধ্যে নুরুল করিম নাসিমকে অনন্য বলা যায়। সেদিন আকাশে পূর্ণিমা ছিল না গল্পটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চাঁদের অন্য অন্ধকার পিঠের ছবি তুলে ধরেছে। বিষয়টি আমরা অনেকে জানি, কিন্তু অনেক বছর হয়ে গেল, কেউ লিখিনি বা লিখছি না। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল কাজ করেছে। বাম ও বামঘেঁষা দলগুলো অন্যভাবে মুক্তিযুদ্ধ করতে চেয়েছিল, সে ইতিহাসের ছিটেফোঁটা কথা কখনো কখনো কোনো বুদ্ধিজীবী বলেছেন কিন্তু তাঁর পূর্ণাঙ্গ চিত্র এখনো আসেনি। এ গল্পে সে বিষয়টি আমাদের নাড়া দেয়। ‘আমরা বললাম, আমরা মুক্তিযোদ্ধা, আমরা দেশকে স্বাধীন করার জন্য সীমান্তে এসেছি। বুটে খুব জোরে একটি শব্দ করে একজন দীর্ঘকায় সৈনিক ভিনদেশি ভাষায় বলল, তুমলোগ মুক্তি নেহি। তুমলোগ কমিউনিস্ট হায়। ইধারসে নিকাল যাও।’ (পৃ-৩৩)। মোহন রাতে মরা চাঁদ, কয়েকটি যন্ত্রণা, কবিতার জন্য, এবং আমি গল্পগুচ্ছে গল্পকার কিছু অসাধারণ চিত্রপট এঁকেছেন। হুমায়ুন কবির ভীষণ সুন্দর কবিতা লিখতেন যিনি মাত্র বেলী ফুলের মালা বিনিময় করে বিয়ে করেছিলেন। এ অপূর্ব যৌতুকহীন বিয়ের প্রভাব ১৯৭৪ সালের দিকে সে সময়ের যুব সমাজে অপূর্ব প্রভাব ফেলে। এক ধরণের অ্যাবসার্ড আঙ্গিকে লেখা প্রথম দু’টি গল্প ও পরের দু’টি গল্প কাব্যনাট্যের আঙ্গিকে লেখা। নির্দোষ এ কবিকে গুলি করে হত্যা করা হয় যার জন্য গল্পকারের কাছে মানুষের মাথার খুলিকে বিভৎস সাদা চাঁদ মনে হয়েছে। ম্লান বিকেলের মরা রোদ গল্পে অখন্ড বাংলার একটি আবেগবিধুর চিত্র ফুটে উঠেছে যেখানে ধর্ম-বিত্তের চেয়ে মানবতা ও জন্মভূমি বড়ো হয়ে দেখা দেয়। বাবার কালো ট্রাংক একটি অপূর্ব সৃষ্টি যেখানে কয়েক প্রজন্মের আবেগ, আর্থিক অবস্থা, পরিবেশ, মানসিকতা নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দেখা যায়। সময়, পরিবেশ, সমাজ এবং এগুলো ঘিরে আবর্তিত মানুষ লেখক, কবি, চিত্রকর, গায়কের কাছে স্বভাবতঃ যে দাবী করতে পারেন তা নুরুল করিম নাসিম মেটাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
×