ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন গান্ধীজি আশ্রমের ঝর্ণাধারা চৌধুরী

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ৫ জুলাই ২০১৯

চলে গেলেন গান্ধীজি আশ্রমের ঝর্ণাধারা চৌধুরী

শুধুমাত্র মানবসেবার জন্যই গৃহত্যাগী হয়েছিলেন ঝর্ণাধারা চৌধুরী। কেবল গৃহত্যাগই নয়, বিয়ে সংসার সবই বিসর্জন দিয়েছেন। আশপাশের অসহায় মানুষগুলোর মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন আপনজনের ছায়া। সমাজসেবা ও মানবকল্যাণে আত্মনিবেদিতা চিরকুমারী এই মহীয়সী নারী গান্ধীবাদী চেতনা ধারণ করে সমাজসেবায় পুরো জীবন পার করে চিরবিদায় নিলেন। ২৭ জুন বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টি বোর্ডের সচিব ঝর্ণাধারা রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। সমাজসেবার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাওয়া ঝর্ণাধারা চৌধুরীর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। গত ১ জুন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে পরদিন তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বুধবার হাসপাতালেই তার মস্তিষ্কে দ্বিতীয়বারের মতো রক্তক্ষরণ হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে আর জীবনে ফেরাতে পারেননি। সংসার ত্যাগী, ব্রহ্মচারিণী শ্রীযুক্তা ঝর্ণাধারা চৌধুরী নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের সচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সমাজসেবা ও জনকল্যাণে আত্মনিবেদিতা চিরকুমারী পরম শ্রদ্ধেয়া এই মহীয়সী নারী মানবসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ১৯৩৮ সালের ১৫ অক্টোবর লক্ষ্মীপুর জেলায় ঝর্ণাধারা চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। লক্ষ্মীপুরে রামগঞ্জ উপজেলার নিজ জন্মভিটা কালুপুর গ্রামে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন তিনি। তার যখন নয় বছর তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যায়। নিজের চোখে দেখেছেন অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞের বীভৎস ঘটনা। ২৬ জন নিরীহ মানুষকে আগুনে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারার দৃশ্য নিজের চোখে অবলোকন করেছনে। সে সময় মানুষের দুর্দশা দেখেছেন। মানুষের অসহায়ত্ব তাকে দারুণভাবে মর্মাহত করে। মানুষের এই অসহায়ত্ব আর দুর্দশাই মূলত মানবসেবার প্রতি তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তার পিতা প্রমথ চৌধুরী এবং মাতা আশালতা চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ঝর্ণাধারা চৌধুরী ১৯৫৪ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী থানার জয়াগে প্রতিষ্ঠিত গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত হন। এই ট্রাস্ট নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও কুমিল্লা জেলার প্রায় বারো লাখ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রচেষ্টার পাশাপাশি শান্তি, সম্প্রীতি ও অহিংসা প্রসারের লক্ষ্যে কাজ করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে ঝর্ণাধারা চৌধুরীর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের মাধ্যমে দরিদ্র জনগণ শিক্ষার আলো লাভ করেছে। তা ছাড়া কৃষি, মৎস্য চাষ, কুটিরশিল্প প্রভৃতির মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ স্বাবলম্বী হয়েছে। ঝর্ণাধারা চৌধুরী মাত্র ১৭ বছর বয়স থেকেই মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তখন নিজ গ্রামেই দুস্থ শিশুদের জন্য স্কুল চালু করেছিলেন। কিন্তু অর্থাভাবে সেটি আর বেশিদূর এগোয়নি। এতে তিনি ভীষণ কষ্ট পেলেও দমে যাননি। বিভিন্ন সামাজিক কাজের সঙ্গে নিজেকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ফেলেন। চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘের শিক্ষিকা এবং অনাথালয়ের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তার মানবসেবা আরম্ভ হয়। তিনি টানা ২০ বছর সেই সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেন। অনাথ শিশুদের জীবন গঠনে তিনি মূল্যবান ভূমিকা পালন করেছেন। অনাথ শিশুদের সেবা দিয়ে তিনি তাদের আত্মপ্রত্যয়ী ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন। তিনি তাদের শিখিয়েছেন জীবনে পরাজিত হতে নেই- জয় পতাকা হাতে অগ্রসর হয়ে জীবনকে সার্থক করে তুলতে হবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবর্তক সংঘের প্রায় ৫০০ শিশু ও কিশোরীকে পাকহানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচিয়ে তিনি আগরতলা নিয়ে যান। সেখানে ত্রাণ কাজে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত প্রবর্তক সংঘের কর্তাব্যক্তিদের মরদেহ সৎকার এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বিধ্বস্ত প্রবর্তক সংঘ পুনর্গঠনে তিনি নিরলস কাজ করেছেন। ১৯৭৯ সালে পুনরায় গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টে ফিরে আসেন। ১৯৯০ সালের ১৩ জুন তিনি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের সচিবের দায়িত্ব পান। ঝর্ণাধারা চৌধুরী আজীবন হতদরিদ্র, অসহায়, নির্যাতিত, বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন। তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ আলোর পথ যেমন খুঁজে পেয়েছে, তেমনি বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পেয়েছে সমানতালে। গ্রামীণ জনগণ দারিদ্র্যতা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাবার আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হয়েছে। মানবপ্রেম আর মানবসেবায় ডুবে থেকেই জীবনের ৭৪টি বছর পার করে দিয়েছেন তিনি। সংসারের মায়ায় নিজেকে জড়ালেন না। থেকে গেলেন চিরকুমারী। মহাত্মা গান্ধীকে নিজের চোখে না দেখলেও তার আদর্শকে মনের মধ্যে সব সময় লালন করেছেন তিনি। মানবপ্রেমে ডুবে থাকার অনুপ্রেরণা তার অবচেতন মনে সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা তার আদর্শকে লালনের কারণেই। তিনি মনে করতেন নিজেকে সংসারের মায়ায় জড়িয়ে, সমস্ত লোভ-লালসা বিসর্জন না দিতে পারলে পরিপূর্ণরূপে মানবসেবায় ডুবে থাকা যায় না। সে জন্যই তার আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। সংসার করা হয়নি। তিনি অনাথ, দরিদ্র আর হতভাগ্য শিশুগুলোকেই নিজের সন্তান মনে করতেন। আশপাশের অসহায়গুলোর মধ্যেই তিনি সুখ খুঁজে পেয়েছেন। তিনি মনে করতেন তারাই তার আপনজন। জীবদ্দশায় বিভিন্ন সময়ে ঝর্ণাধারা চৌধুরী নিজেই এসব কথা বলে গেছেন পত্রপত্রিকার সাক্ষাতকারে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ঝর্ণাধারা চৌধুরী ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক ‘বাজাজ পুরস্কার’ লাভ করেন। ২০০২ সালে নারী উদ্যোক্তার স্বীকৃতি হিসেবে ‘অনন্যা’ পুরস্কার, ২০০৩ সালে নারী পক্ষ দুর্বার নেটওয়ার্ক, নিউইয়র্কের ওল্ড ওয়েস্টবেরি ইউনিভার্সিটির শান্তি পুরস্কার, শান্তি, সম্প্রীতি ও অহিংসা প্রসারে ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শান্তি পুরস্কার’ লাভ করেন তিনি। এ ছাড়া ২০০৮ সালে নোয়াখালী জেলা প্রশাসন থেকে ‘সাদা মনের মানুষ’ হিসেবে তিনি সম্মাননা লাভ করেন। ২০১৩ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী ও ২০১৫ সালে সমাজসেবায় একুশে পদক লাভ করেন তিনি।
×