ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীরা শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেই! ॥ ১ মে, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ১ মে ২০১৯

বাঙালীরা শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেই! ॥ ১ মে, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১ মে দিনটি ছিল শনিবার। বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া সরকার ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র জনতার ওপর যে নৃশংস আক্রমণ চালিয়েছে, ইতিহাসে তার তুলনা নেই। সে রাতের পর থেকেই শুরু হয়েছে বিংশ শতাব্দীর ইয়াজিদ ইয়াহিয়ার ঘাতক বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ওপর উপনিবেশিক শোষণ অব্যাহত রাখার যে চক্রান্ত পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে শুরু হয়েছিল, একাত্তরের মার্চ মাসে ঘটল তারই নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা তাই আর কোনকিছু রাখঢাক না করেই কামান-বন্দুক-মেশিনগান-বোমারু বিমান, যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বাঙালীদের সামনে একটিই মাত্র পথ, স্বাধীনতা রক্ষার সশস্ত্র লড়াই। বাংলার বীর জনতা সে দায়িত্ব পালন করেছে। আজ তাই স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্য। এ সত্য বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনতার প্রাণের মন্ত্র- বাংলাদেশের বাঁচার শপথ। এই দিন মেজর শফিউল্লাহর নির্দেশে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট গোলাম হেলাল মোরশেদ খান এক প্লাটুন যোদ্ধা নিয়ে তেলিয়াপাড়া থেকে মাধবপুর হয়ে শাহবাজপুরে পাকিস্তানী সৈন্যদের রেইড করার জন্য রওনা হন। পাকহানাদার বাহিনী চট্টগ্রামের রামগড়ের আশপাশের এলাকার ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। পাকবাহিনীর একটি দল মূল সড়ক ধরে ও অন্য একটি দল রামগড়ের পূর্ব-দক্ষিণে পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হয়। কুমিল্লার বগাদিয়া সেতুর কাছে নায়েক সিরাজ এক প্লাটুন যোদ্ধা নিয়ে হানাদার বাহিনীকে এ্যামবুশ করে। একটি জীপসহ তিনটি ট্রাক কাছাকাছি এলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচ- আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে ১৫-২০জন পাকসেনা নিহত ও তাদের একটি লরি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। নায়েক সিরাজ অসীম সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে এ যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই যুদ্ধ ‘বগাদিয়ার যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। ৩০ এপ্রিলের পরাজয়ের ঝাল মেটাতে পাকহানাদার বাহিনী পুনরায় কুমিল্লার বড়কামতা আক্রমণ করে। পাকসেনারা গ্রামে ঢুকে বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। সকাল ১১টা, প্রতিদিনের মতো নিত্যকর্মে ব্যস্ত নাটোরের ধলা গ্রামবাসী। আকস্মিকভাবে শুরু হলো এক বিভীষিকাময় এবং শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। কতিপয় পাক দোসরদের উস্কানিতে কিছু দুষ্কৃতকারী ধলাবাসীদের উৎখাতের উদ্দেশ্যে প্রথমেই রজনীকান্তের বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে। দিনটি মেঘাচ্ছন্ন, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি থাকায় আগুন ছড়াতে পারেনি। পোড়ার হাত থেকে গ্রামটি রক্ষা পেলেও হামলাকারীদের হাতে নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশুরা নিষ্ঠুর নির্যাতন, লুটতরাজ ও অত্যাচারের শিকার হয়। এসব থেকে বাদ পড়েনি গোয়ালে বাঁধা গরু-মহিষগুলোও। ঐ সময় প্রাণে বাঁচার জন্য গ্রামের কিছু যুবক আশে-পাশে ঝোপ-ঝাড়ে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করে। সেদিনের এ তান্ডব চলে বেলা ২ টা পর্যন্ত। সহায় সম্বলহীন হয়ে তারা শুধু এক কাপড়ে জীবন রক্ষার্থে একত্রিত হতে থাকে। নিরাপদ আশ্রয় প্রাপ্তির প্রত্যাশায় বনপাড়া মিশনে ফাদার পিনোসের শরণাপন্ন হয়। ফাদার দায়িত্ব নিয়ে তাদেরকে মিশন ক্যাম্পাসে কনভেন্টে রাখার ব্যবস্থা করেন। মিশন সংলগ্ন এলাকার সেকচিলান, কদিমচিলান, ওয়ালিয়া, চ-ীপুর, দিয়ারপাড়া এমন কি নাটোর শহরের কতিপয় মানুষও প্রাণ ভয়ে আশ্রয় নিয়েছিল বনপাড়া মিশনে। ইতোমধ্যে ধলা গ্রামের কয়েকটি পরিবার মিশনে না গিয়ে আত্মরক্ষার জন্য হারোয়া গ্রামের মহর মোল্লাসহ কয়েকজনের সহায়তায় ভারত অভিমুখে রওনা হয়ে যায়। ভারতের শিল্পমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী আগরতলার শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকালে বলেন, বাংলাদেশ একটি বাস্তব ঘটনা। এর ভবিষ্যত সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। বাঙালীরা শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেনই। বিশ্ববাসীর উচিত একে স্বীকার করে নেয়া। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ নগরীর রেল লাইন ও সড়কের উভয় পাশের অননুমোদিত বাড়িঘর ও বস্তি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। ময়মনসিংহ থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক সদস্য এসবি জামান আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ করেন। তিনি পাকিস্তানের অখ-তা বজায় রাখার লক্ষ্যে সশস্ত্র বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য ময়মনসিংহবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। পাকিস্তানী বাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্যে লাখ লাখ বাঙালী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে পাকিস্তান সরকার জানায়, ‘কিছু সংখ্যক লোক সমাজ-বিরোধীদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে সীমান্তের ওপারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে ভারত উদ্বাস্তুর ধুঁয়া তুলে ব্যবসা করছে। ’মুসলিম লীগ (কাইয়ূম) প্রধান খান আবদুল কাইয়ূম খান শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি তুলে জানান, পূর্ব পাকিস্তানের দুঃখজনক পরিস্থিতির উদাহরণ সামনে রেখে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করলে এ ধরনের অবস্থা আর সৃষ্টি হবে না। এটাই হচ্ছে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের উপযুক্ত সময়। এই দিন ‘দৈনিক যুগান্তর’ ইউএনআই এর বরাতে গোয়ালন্দে অন্যূন একশ’ পাকসৈন্য নিহত শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গতকাল বুধবার ফরিদপুরের নিকট গোয়ালন্দে একটি যুদ্ধে অন্তত ১শ’ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই একটি স্টিমার নিমজ্জিত হয়েছে বলে সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। এই যুদ্ধ প্রায় ৯ ঘণ্টাকাল স্থায়ী হয় এবং মুক্তিসেনারা অবশেষে পিছুহটে আসে। মুক্তিসেনারা পাকসেনাদের একটি ছাউনিতে আচমকা আক্রমণ করলে এই যুদ্ধ শুরু হয়। সংবাদে জানা যায়, শেখ মুজিবুরের জন্মস্থানকে ধূলিসাত করা হয়েছে- শুধু কুকুর ও সৈন্যরা সেখানে অবস্থান করছে। শহরে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর ভূমিসাৎ করা হয়েছে এবং পাইকারি বাজারটি লুণ্ঠিত ও বিধ্বস্ত হয়েছে। ঐ দিনই ফরিদপুরের প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে গুরুত্বপূর্ণ পাট ব্যবসায় কেন্দ্র ভাঙ্গাতেও যুদ্ধ হয়। প্রায় ২৫ লাখ টাকা মূল্যের পাট বিনষ্ট করা হয়েছে। চট্টগ্রাম রণাঙ্গনের কোন এক স্থান থেকে মুক্তিফৌজের কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান জানিয়েছেন যে, গত মঙ্গলবার নোয়াখালী জেলার ফেনী শহরের শুভপুর সেতুর জন্য সংগ্রামে প্রায় একশ’ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। তিনি সফররত জনৈক ইউএনআইর প্রতিনিধিকে লিখিতভাবে জানান যে, ২৭ এপ্রিল এক ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানী সৈন্য শুভপুর সেতু আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করে। শত্রুসৈন্যরা ট্যাংক এনে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গোলাগুলি চালায়। শুভপুর সেতুর নিকট পাকিস্তানীরা ফেনী নদী অতিক্রমের চেষ্টা করলে মুক্তিফৌজের আব্দুল আজিজ নামে জনৈক সিপাই এক প্লাটুন পাকসৈন্যকে হত্যা করেন। এই দিন আনন্দবাজার পত্রিকায়, ‘মুক্তিফৌজের পাল্টা আক্রমণে ছদ্মবেশী পাক-হানাদাররা পর্যুদস্ত’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, আজ বিকালে বেনাপোলের সাদিপুরে একদল পাকিস্তানী হানাদার মুক্তিফৌজের ছদ্মবেশে হাত উঁচু করে এগিয়ে এসে মুক্তিফৌজের উপরই ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দেয়। অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে পাল্টা আক্রমণে বাংলা বাহিনী পাঁচজন হানাদারকে খতম ও কয়েকজনকে জখম করেন। অন্যদিকে, মহেশপুরেও মুক্তিবাহিনী ঝটিকা আক্রমণে দখলদারদের কাছ থেকে একটি ছোট ঘাঁটি ছিনিয়ে নেন। দ্য ফ্রন্টিয়ার ‘সীমান্তের ওপারের জনগণ সক্রিয়’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে প্রতিরোধ বাহিনী নেই। লাঠি, তীরের মতো হাতিয়ার নিয়ে তারা সঙ্কল্প এবং আশার একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি, আবেগে ভরপুর, তারা পারবে! ইতিমধ্যেই তারা শত্রুদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ সম্পর্কে সতর্ক এবং গেরিলা যুদ্ধের দিকে ঝুঁকছে। পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগ পর্যন্ত কোন বড় শক্তিও আর বাংলাদেশের জনগণকে আলোচনায় বসাতে পারবে না। বিদেশী হস্তক্ষেপের কি মূল্য দিতে হবে সে ব্যাপারে মুক্তিবাহিনী ভালভাবেই অবগত। তারা চায় না ভারত বা অন্য কোন জাতি এই দ্বন্দ্বে সরাসরি জড়িত হোক। নেতা, সাধারণ মানুষ সবাই অস্ত্র, বোমা এই ধরনের জিনিস ছাড়া কোন বিদেশী ক্ষমতা বা সহযোগিতা চায় না। যুদ্ধের লক্ষ্য যোদ্ধাদের দ্বারাই সহজে নিষ্পন্ন হবে তারা এমন ধারণায় আচ্ছন্ন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×