ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ৫ এপ্রিল ২০১৯

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

পর্ব-২৯ আজ জীবনের এই পর্বে এসে যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন কত কথাই তো মনে আসে। মূলত আমাকে মানুষ চেনে নাটকের লোক হিসেবে। কিন্তু নাটকের বাইরেও যে একটা জীবন আছে যে জীবনে মানুষের মানবিক বোধগুলো সম্পৃক্ত থাকে, মন্দ-ভালর বিচারে না গিয়েই, সেগুলো সম্বন্ধেও কত কথা বলার থাকে সবার। কিন্তু আমরা কেউই নানাবিধ কারণে নিজেদের উন্মুক্ত করতে চাই না। এই যে মানুষের নিজেকে লুকিয়ে রাখা কিংবা নিজেকে আংশিক প্রদর্শন এটা বোধহয় আমাদের জন্য সহজাত। ঠিক যেমন আমরা কেউই প্রদর্শন করতে চাই না লোকচক্ষুর অন্তরালে পোশাক-পরিচ্ছদের আবরণের ভেতরে আমাদের যে শরীরের বাস সেইটি জনসমক্ষে প্রদর্শিত হোক। আমাদের সকলেরই মনের ভেতর একটি শঙ্কা বাস করে আর সেটি হলো নিরাভরণ আমাদের দেখলে আমাদের কদর্যতা প্রকাশ পেয়ে যাবে এবং সেটি সুগৃহীত হবে না। আমরা যারা কিঞ্চিৎ লেখাপড়া করেছি তারা জানি যে মানুষ, আত্মজীবনী লেখার সময় অতিযতœ নিয়ে অনেক কিছুই গোপন করে যায়। এতে করে আমরা একটি মানুষের জীবনের কেবল কিয়দাংশ দেখতে পাই মাত্র। নিজের আত্মজীবনী লিখে বিখ্যাত হয়েছেন যারা, তাঁরা কিন্তু অবলীলায় জীবন সম্বন্ধে সবকিছু নির্দ্বিধায় বলে গেছেন। আমরা যখন থেকে ধারণা বহির্ভূত অথচ মেধা সম্পৃক্ত জ্ঞানার্জন শুরু করলাম তখন থেকেই নিজেদের সম্বন্ধে কথা বলায় বেশকিছু বিধি-নিষেধ প্রযোগ করতে শুরু করলাম। উদাহরণ স্বরূপ বলা হয়ে থাকে, ‘সদা সত্য কথা কহিবে, কিন্তু সত্য কথা কটু হইলে তাহা পরিহার করিবার চেষ্টা করিবে।’ এই ধরনের আপ্ত বাক্যের মধ্যে এক ধরনের স্ববিরোধিতা বিদ্যমান। এর পেছনে কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ যে নেই তা নয়। আমরা সবাই নিরানন্দতাকে এড়িয়ে চলতে চাই। আমাদের শান্তি বিঘিœত না হোক, সেই চেষ্টায় সজাগ থাকি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়টিকে অসততা হিসেবেই জেনে এসেছি। কিন্তু এই অসততার পেছনেও যে যুক্তিগ্রাহ্য, শান্তির প্রয়োজনলব্ধ কারণ রয়েছে সেটা তো অনস্বীকার্য? অর্থাৎ মেধাসম্পন্ন মানুষের উচিত অনেক ভেবে-চিন্তে, অশান্তি পরিহার করে কথা বলা কিংবা নিজেদের আচরণকে সংযত রাখা। এক সময় যারা একেবারেই নিখাদ সত্যকে জীবনের অবলম্বন মনে করতেন তারা বাহ্যিক অশান্তি সম্বন্ধে একেবারেই ভাবতেন না। অর্থাৎ, যাহা সত্য তাহাই বলিব, যাহাই ঘটুক না কেন। সমাজ বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে পরবর্তী জীবনে যখন নৃতত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম, তখন একটি বিষয় আমাদের পড়ানো হয়েছিল। নৃ-বিজ্ঞানী ডারউইনের একটি মতবাদ আছে, যাকে ইংরেজীতে ঝঁৎারাধষ ড়ভ ঃযব ভরঃঃবংঃ বলা হয়ে থাকে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে যে শক্তিমত্তায় বড় হলে কিংবা সাহসী হলে বুঝি ঋরঃ হওয়া যায়। কিন্তু ডারউইনের মতে এই ঋরঃঃবংঃ শব্দটির অভিধা অনেক গভীর এবং সর্বব্যাপী। আসলে ‘ঋরঃ’ কারা? ডারউইন বলেছেন তারাই ঋরঃ যারা বাঁচার উপায়টি সম্বন্ধে জানেন এবং সেই পথ অবলম্বন করেন। তাঁর ’ঘধঃঁৎধষ ঝবষবপঃরড়হ’ এর মতে সরাসরি দ্বন্দ্বে না গিয়ে বুঝে-শুনে আপস করলে দীর্ঘদিন শান্তি বজায় রেখে বেঁচে থাকা যায়। অনেকেরই মনে হয় যে এই মতবাদ একটি সুবিধাবাদী আচরণ কেবল। কিন্তু এই আচরণ সম্বন্ধে বিতরাগ হয়ে আমরা যদি সংঘর্ষে লিপ্ত হই তাহলে জগত-সংসার আর সামনের দিকে এগোবে না। নৃবিদ্যা আমাদের শিখিয়েছে যে পৌরাণিক যুগ থেকে প্রচ- শক্তির অধিকারী পশুরা নিজেদের মধ্যে কোন আপোস না করে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো। যে কারণে সেসব পশুদের একটিও আজ বেঁচে নেই। অথচ পরবর্তীতে বোধবুদ্ধিসম্পন্ন হোমস্যাপিন্স’রা বুদ্ধি প্রয়োগ করে বুঝল যে দ্বন্দ্বকে এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। এই কথাগুলো আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার আগে ঠিক কখনও ভেবে দেখিনি এবং আমি নিশ্চিত যে কেউ ভেবে দেখে না। এই শিক্ষাগুলো মানুষ জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে গ্রহণ করে। এতে করে জীবনের চলার পথ মসৃণ হয় এবং জীবনটা সহজ হয়ে উঠে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যদি আমরা এই ধরনের দ্বন্দ্বকে এড়িয়ে চলতে পারি তাহলে হয়ত বেশ লম্বা সময় ধরে নির্বিবাদে বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু সব সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তখন দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং আমরা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, ক্ষতিগ্রস্ত হই। আজকের প্রতিপাদ্যে বা বিষয়বস্তুতে যে কথাগুলো এ পর্যন্ত বললাম সেগুলো যদিও দর্শন কপচানোর মতো শোনাবে তবুও আমার মনে হয় এই বিষয়গুলো সম্বন্ধে ভাবা উচিত এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা উচিত। তাতে বোধহয় অনেক অশান্তি দূর করা যায় এবং জীবন সম্বন্ধে অনেক ‘ধোঁয়াশা’ ঘুঁচে যায়। ঔপনিবেশিক পাকিস্তানের অধিবাসী হিসেবে জীবন এক রকম ছিল আর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে জীবনটা ভিন্নভাবে শুরু হলো। এ বিষয়টি উল্লেখ না করলেই নয় যে, এই রাজনৈতিক বিবর্তনে জীবনের গতি, প্রকৃতি সম্পূর্ণ বদলে গেল। আমি নিশ্চিত যে এই অভিজ্ঞতাটি আমার একার নয়, আমাদের সহযাত্রী সকলেরই যারা জীবন সম্বন্ধে ভাবতেন। এই পরিবর্তনের ফলে নতুন কিছু উপলব্ধি তাদেরও হয়েছিল, যা তাদের ধাক্কা দিয়েছিল। পাকিস্তানী আমলে যে কোন অব্যবস্থার জন্য কিংবা খামতির জন্য আমরা উপনিবেশবাদী পাকিস্তানীদের দায়ী করেছি, স্লোগান দিয়েছি কিংবা লেখালেখি করেছি। মনে পুঞ্জীভূত অশন্তোষের যথাযথ অভিব্যক্তি পেতে কোন অসুবিধা হয়নি। আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল পরিচিত। তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক চেহারা ছিল আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভাবতাম, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিকভাবেই ভাবতাম যে উপনিবেশবাদীদের বিতাড়িত করতে পারলে সবদিক থেকে জীবনটা অনেক বেশি সহজ হয়ে আসবে। একটি কথা এখানে বলে রাখা ভাল যে আমরা যখন পাকিস্তানী জীবন আর বাংলাদেশী জীবনের মধ্যে একটি তুলনামূলক বিচারে ব্রতী হই তখন কেবলি ভাবাবেগ উদ্ভূত দর্শন দ্বারা বিষয়টিকে দেখবার চেষ্টা করি। এর বাইরে জীবনের যে অন্যসব আনুষঙ্গিক অরোমান্টিক দিকগুলো আছে সেইগুলো সম্বন্ধে ভেবে দেখি না। অথবা দেখলেও ভাবি যে সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার ভাবালুতাশ্রয়িতাকে, এক প্রচ- ধাক্কা মারল জীবন ধারণের জন্য অপেক্ষাকৃত প্রয়োজনীয় দিকগুলো। আগে যা ভেবেছিলাম সময়ে ঠিক হয়ে যাবে, তা সময়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। অতএব, জীবন ধারণের জন্য যেসব পাথেয় কাজগুলো আমাদের সবার করতে হয়, তাই নিয়ে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলো। আমাদের জীবনের ট্র্যাজিডি বোধহয় এইখানেই যে, যা করতে চাই, সবসময়ই তা কদাচিত করা হয়ে ওঠে। আমার মনে হয় এটাই সর্বৈব সত্যি। এই পৃথিবীতে কতিপয় মানুষ আছেন যারা একেবারে নিজের প্রাণের তাগিদে আজীবন কাজ করে যেতে পেরেছেন, কখনও কাউকে কৈফিয়ত না দিয়ে। আজ এই বয়সে এসে আমি যেখানে দাঁড়িয়েছি সেটা কেবলই আমার ইচ্ছায় হয়নি। যদি তাই হতো তাহলে হয়ত এমন ব্যবসা সফল হতাম না যা নিয়ে লোকে বলাবলি করে। হয়ত অনেক অভাবের সংসার হতো। টেনে আনতে ছিঁড়ে যেত কিন্তু নিজেকে অনেক পরিপূর্ণ মনে হতো। সেটা হয়নি। অবশ্য এ নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই। কেননা আমার এই আপাত জাগতিক সাফল্য আমাকে অনেকদূর যেতে সাহায্য করেছে। আমি এমন কিছু কাজ করতে পারি, যাতে করে নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ ছাপিয়ে গিয়েও সামাজিকভাবে-সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য কিছু করা হয়ে যায়। আজ এই টুকুই। চলবে...
×