ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুপদী রিপন

মজিদ মিয়া এবং তার চায়ের দোকান

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ৪ জানুয়ারি ২০১৯

 মজিদ মিয়া এবং তার চায়ের দোকান

স্বশিক্ষিত মজিদ মিয়া আগে কাঁচামালের ব্যবসা করত। সে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলার পর সামান্য পুঁজি নিয়ে চা দোকান দিয়ে বসে বাজারে। চায়ের ব্যবসাতেও তেমন সুবিধা করতে পারে না মজিদ মিয়া। তবে এ ব্যবসায় তার সুবিধা না করার পেছনে ক্রেতাদের কাছে আছে জোরালো যুক্তি-অভিযোগ। ক্রেতাদের ভাষ্যমতে, কালিহাটি বাজারে সবচেয়ে বিশ্রি চা একমাত্র মজিদ মিয়ার দোকানেই পাওয়া যায়। মজিদ মিয়া নিজেও জানে সে কথা। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। সে জানে যে চা বানানো একটি কাজ; এক দুই দিনের ব্যবধানে কোন কাজে তো আর মাস্টার হওয়া সম্ভব নয়! দিন অতিবাহিত হতে থাকলে মজিদ মিয়ার চায়ের হাতও পোক্ত হতে থাকে। ক্রমাগত পোক্ত হতে থাকা হাত একদিন সত্যি সত্যি পোক্ত হয়ে যায়। পোক্ত হাতের চা পান করতে ক্রেতারাও ভিড় জমাতে থাকে মজিদ মিয়ার দোকানে। ক্রেতার সমাগম হলেও ক্রেতার উপস্থিতির সঙ্গে ব্যবসায়িক আয়ের একরকম অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করে মজিদ মিয়া। কিন্তু সে অসামঞ্জস্য মজিদ মিয়া গায়ে মাখে না। ক্রেতার ভিড় থেকে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা অর্জন করে মজিদ মিয়া আয়ের অসামঞ্জস্যকে ঢেকে রাখে প্রতিদিন। এভাবেই চলতে থাকে মজিদ মিয়ার জীবন। মজিদ মিয়া অসন্তুষ্ট নয়; প্রতিদিন চায়ের দোকানের বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে জীবনের নতুন আবেদন খুঁজে নেয়। এরই মাঝে সে একদিন আবিষ্কার করে- পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়াদি আলোচনার কেন্দ্রীয় স্থান হলো চায়ের দোকান। আলোচনার সেই কেন্দ্রীয় স্থানে, গত কয়েক দিন থেকে একজন অপরিচিত লোকের নিয়মিত আগমনও লক্ষ্য করে মজিদ মিয়া। লোকটি অপরিচিত হলেও তার চেহারায় কেমন যেন পরিচিত পরিচিত ভাব লক্ষণীয়। লোকটির মাথায় উস্ক-খুস্ক চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িও আছে। তবে বাকি সব বিষয়াদি একেবারেই পরিপাটি। অপরিচিত লোকটি প্রতিদিন নিয়ম করে দোকানে আসে, মজিদ মিয়াকে চা দেয়ার কথা বলেই উপস্থিত ক্রেতাদের উদ্দেশ্য করে কথা বলা শুরু করে; পরিচিত হওয়া বা শুভেচ্ছা বিনিময়ের কোন নাম গন্ধ নেই। লোকটি কথা বলতেই থাকে, আর উপস্থিত বাকিরা মনোযোগ দিয়ে শোনে। প্রথমে হয় তো দু-একজন তার কথা না শুনে নিজেদের মধ্যেই মনোযোগ বজায় রাখে। কিন্তু সে মনোযোগ বেশি সময় স্থায়ী হয় নাÑ নিজের দিক পরিবর্তন করে নেয়। ক্রেতাদের মতো মজিদ মিয়াও মুগ্ধ হয়ে অপরিচিত লোকটির কথা শোনে। লোকটি যখন কথা বলা শুরু করে তখন অলিখিত নিয়মে দোকানের বাকি সব কিছুতেই নীরবতা শুরু হয়ে যায়। সেই শুরু হয়ে যাওয়া নীরবতা পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে অহেতুক অপেক্ষা করতে হয় না। লোকটি কথা বলে আর বাকিরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে। লোকটি কথা বলতে বলতে এক সময় নিজেই চা পানের বিরতি দিয়ে দেয়, এভাবে চলতে থাকলে মজিদ মিয়ার ব্যবসায় তো লালবাতি জ্বলবে- সেটা করা তো ঠিক হবে না! একথা বলেই লোকটি মুচকি হাসে। এরপর শ্রোতাদের হো হো হাসির শব্দে মজিদ মিয়ার চায়ের দোকান যেন মুহূর্তের ব্যবধানে মুখরিত হয়ে ওঠে। হাসি থামলে মজিদ মিয়া চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। বিরতি পেয়ে শ্রোতাদের অনুভূতিও ভিন্নতা খুঁজে পায়; এতক্ষণ তারা যেন ছিল ভিন্ন জগতে। চা পানের বিরতির পর লোকটি কথা বলা শুরু করে; চারপাশে নীরবতা শুরু হয়ে ক্রমাগত নীরব হয়ে যায়, যেন পিন পতন নীরবতা। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে। লোকটি মনের মাধুরী মিশিয়ে বলে চলে আসমান-জমিন, সৃষ্টি-স্রষ্টা, আরও কত কী! লোকটির কথার মধু যেন ভ্রমর হয়ে শ্রোতারা আহরণ করে চলে মুহূর্তে মুহূর্তে। এভাবেই চলতে থাকে দিনের পর দিন। [২] হঠাৎ একদিন লোকটির অনুপস্থিতি মজিদ মিয়াকে বিচলিত করে তোলে। লোকটির প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা উপলব্ধি করে মজিদ মিয়া এর ওর কাছে খোঁজও নেয়। কিন্তু কোন লাভ হয় না; বাকিরাও মজিদ মিয়ার মতোই বিচলিত বোধ করতে থাকে। উপায় না পেয়ে মজিদ মিয়াও অসুস্থতার কথা ভেবে পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করে। পরের দিনও মজিদ মিয়ার অপেক্ষা বিফলে যায়। শুধু মজিদ মিয়া নয়, তার দোকানের ক্রেতারাও ক্রমাগত বিচলিত হয়ে ওঠে কিন্তু লোকটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না; সবাই অপেক্ষা করতে থাকে। এভাবে প্রায় সপ্তাহ দুই অতিবাহিত হয়ে যায়; লোকটিকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। আপেক্ষার পালা ক্রমাগত ভারি হলে, মজিদ মিয়া এবং তার দোকানের ক্রেতারা লোকটির আগমনের আশা ছেড়ে দিয়ে নিজেদের কাজে মনোযোগী হয়ে ওঠে। আরও সপ্তাহ খানেক পর, মজিদ মিয়া উপলব্ধি করে তার দোকানে কিছু নিয়মিত ক্রেতার অনুপস্থিতি। মজিদ মিয়া বিচলিত হয় না। অপরিচিত লোকটি আর আসে না বলেই হয় তো কিছু ক্রেতা তার দোকানে আসার আগ্রহ হারিয়েছে- ভেবে নেয় মজিদ মিয়ার চিন্তাশীল মস্তিষ্ক। কষ্ট পায় মজিদ মিয়া। তবে তার সে কষ্ট নিয়মিত কয়েকজন ক্রেতা কমে যাওয়ার কারণে নয়। মনের গহীনে চাপা সে কষ্ট হু হু করে যেন বলে ওঠে, সে আমার আপনজন।। [৩] দিন মাস এমন কি বছরও কেটে যায়। মজিদ মিয়ার চায়ের দোকানে ক্রেতার ভিড় পূর্বাপেক্ষা বেশি হতে থাকে। তবে ক্রেতা বেশি হলেও পূর্বের মতো আয়ের অসামঞ্জস্য আর চোখে পড়ে না। মজিদ মিয়ার আয়-রোজগার বাড়তে থাকে। সংসারের উন্নতিও হতে থাকে দ্বিগুণ গতিতে। মজিদ মিয়া অটোরিক্সা কেনে, ভাড়া দেয়। তার চকচকে লাল-সবুজ অটোরিক্সা, পিছনে লেখা লাব্বাইক পরিবহন। সংসারের উন্নতিতে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মজিদ মিয়া। মজিদ মিয়ার উন্নতি দেখে প্রতিবেশীরা রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে ক্রমাগত ফুঁসতে থাকে, পরস্পরের মধ্যে কানা-ঘুষা চলে, পানি ব্যাচা ট্যাকা তো....। প্রতিবেশীদের কানা-ঘুষা এ-কান ও-কান ঘুরে মজিদ মিয়ার কানেও আসে, তবে সে কানা-ঘুষায় মজিদ মিয়া গা ভাসায় না; নিজের কাজে মনোযোগী হয়। সারা দিন চা বিক্রি করে রাতে বাড়ি এসে অটোরিক্সার ভাড়া তোলে মজিদ মিয়া। ভাড়া তোলার পর ঘরে এসে আপনজনের খোঁজ-খবর নেয়। এরপর খাওয়া শেষ করেই চলে যায় বিছানায়; প্রজন্মের প্রত্যাশায় কাটে তার মধুর সময়। মজিদ মিয়া ঘুমিয়ে পড়ে। মজিদ মিয়া ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয় তো ঘুমিয়ে পড়ে তার পুরো সংসার। বৃদ্ধ মা এবং স্ত্রী ছাড়া এই সংসারে তার তো আর আপন কেউ নেই। [৪] এরপর একদিন কালিহাটি বাজারে শোরগোল পড়ে যায়। সবার চোখে-মুখে ভয়-আতঙ্ক দানা বাঁধে। দু-একজন পত্রিকা হাতে নিয়েও ব্যস্ততা দেখায়। দোকানে দোকানে লোকেরা জটলা পাকিয়ে আলোচনা করে। জটলায় অনেকে আতঙ্ক লুকিয়ে সাবলীল হতে চায়। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে ভয় ও আতঙ্ক উঁকি দিয়ে যায় তাদের চোখে মুখে। মজিদ মিয়া আজ দোকান খোলেনি। নিজের অটোরিক্সা ধোয়ার কাজে অর্ধেক বেলা কাটিয়ে দিয়ে বাকি সময়টুকু বাড়ির কাজেই ব্যস্ত থেকেছে। [৫] ঠিক মাগরিবের পর দোকান খোলে মজিদ মিয়া। এর ওর কাছে ঘটনা শুনে পত্রিকা দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পাশের দোকানে গিয়ে পত্রিকা হাতে নিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকে পত্রিকার পাতায়। পত্রিকার প্রথম পাতায় ছোটো ছোটো ফ্রেমে যে চার জন মানুষের ছবি ছাপা হয়েছে তারা সবাই পাশের গ্রামের বাসিন্দা। মজিদ মিয়াও তাদের চেনে-জানে। ঢোক গেলে মজিদ মিয়া, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঠোঁট কামড়ায়। অপ্রত্যাশিতভাবে কালো অন্ধকার যেন ঢেকে দিয়ে যায় মজিদ মিয়ার মুখমন্ডল। ততক্ষণে আলোচিত বিষয়টি আবারও গতি ফিরে পায়। দোকানের সামনে ছোটখাটো একটি জটলার সৃষ্টি হয়। জটলায় ভাব গাম্ভীর্যে অনেকেই নিজেদের মতামত প্রকাশে ব্যস্ততা দেখায়। মজিদ মিয়া মাথা তুলে জটলার দিকে তাকায়। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় মজিদ মিয়া। তৎক্ষণাৎ সে আবিষ্কার করে- জটলায় উপস্থিত একাধিক ময়মুরুব্বির ভিড়ে সে একজন নগণ্য চা দোকানি। নিরুপায় হয়ে সে মুরুব্বিদের কথা শোনে। পত্রিকায় ছবি আসা চার জনকে উদ্দেশ্য করে দু-একজন মুরুব্বি ছি ছি রব তোলে। তাদের থামিয়ে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আর একজন মুরুব্বি পান চাবাতে চাবাতে বাঁকা সুরে বলে ওঠে, আজারি চোদা কতা কন না তো... ধর্মের জন্যেই তো গেএচে....নিজেরা তো এট্যাও জানেন নাÑ পচ্চিম কোন্ দিকি! মুরুব্বির কথা শেষ হলে জটলার পরিবেশ কেমন যেন থমথমে হয়ে যায়। অনেকেই এর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে যে যার মতো নীরবে পা বাড়ায় গন্তব্যে। মজিদ মিয়াও নীরবে নিজের দোকানে এসে বসে। বাকিরা কে কি করে, কে কি ভাবে সে বিষয়ে মজিদ মিয়া কোন খেয়াল করে না। শুধু নিজের মনের গহীনে উঁকি দেয়া ভাবনাটুকুই ভেবে চলে মজিদ মিয়া। তার মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দিনের স্মৃতি। সেই স্মৃতিতে ছবির চার জনকে বিভিন্ন ঘটনায় বারংবার দেখে নেয় মজিদ মিয়া। এই চারজন একসময় ছিল তারা নিয়মিত ক্রেতা, যারা কয়েক দিনের ব্যবধানে কোন বলা-কওয়া ছাড়াই দোকানে আসা বন্ধ করে দেয়। মজিদ মিয়া ভাবে; ভাবশীল মাথায় ক্রমাগত বোনে একাধিক চিন্তার বীজ।। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তার বোনা সে বীজ বৃক্ষ হয়ে শাখা প্রশাখা ছড়ায়।
×