ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষুদে মাহফুজার কৃতীত্ব

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ৪ জানুয়ারি ২০১৯

ক্ষুদে মাহফুজার কৃতীত্ব

লিঙ্গ সমতায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একেবারে শীর্ষে। বৃহত্তর ভারতও অনেকখানি পিছিয়ে। শুধু তাই নয় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্থান সারাবিশ্বে একেবারে প্রথম। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে। দেশের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর এমন জরিপের সরাসরি প্রভাব পড়েছে এবারের প্রাথমিক ও জুনিয়র সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশে। সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ যেভাবে জোর কদমে সামনের দিকে প্রবহমান সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক শিক্ষা কার্যক্রম ও সময়, পরিবর্তন ও বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাফল্যের ধারাবাহিকভাবে নিরবচ্ছিন্ন করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল সে সম্ভাবনারই দিকনির্দেশক। আর মেয়েরা সমতাভিত্তিক অংশগ্রহণে কৃতিত্বের ভাগিদারও হয়েছে অভাবনীয়। মেধা ও মনন বিকাশে আমাদের ছোট্ট সোনা মণিরাও কোনভাবেই পিছিয়ে নেই। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ছেলেমেয়েদের পাসের হার সমান হলেও মেধা ও মননে ছাত্রীরা প্রায়ই দ্বিগুণ। অর্থাৎ জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্ররা ১ লাখ ৬৮ হাজার সেখানে ছাত্রীরা সংখ্যায় ২ লাখ ৪৮ হাজার। এমন এক কৃতী ছাত্রী মাহফুজা আক্তারের সঙ্গে কথা বলেছেন নাজনীন বেগম। মাহফুজ আক্তার এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পেলেও ৪.৮৩ পেয়ে সাফল্যেল স্বাক্ষর রেখেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যেমন বাংলা, ইংরেজী, অংক এবং সাধারণ বিজ্ঞানে ৮০% এর ওপর নম্বর পায়। ধর্মে একেবারে ১০০তে ১০০। কিন্তু খুব সাধারণ বিষয় সামাজিক বিজ্ঞানে সে পিছিয়ে যায়। ৭১ নম্বর পেয়ে পুরো ফলাফলে তার প্রাপ্ত গ্রেড কিছু কমে গেলেও চূড়ান্ত অর্থে তাকে কৃতী ছাত্রীর কাতারে ভাবাই যায়। মাহফুজা আক্তারের বাবা মোহাম্মদ মিরাজ আলী। মা মোছাম্মদ রাবেয়া খাতুন। এই দম্পতির ৩ সন্তানের মধ্যে মাহফুজা কনিষ্ঠতম। বাবা-মার আদুরে সন্তান মাহফুজা অতি বাল্যকাল থেকে বাংলাদেশের অন্য সাধারণ মেয়ের মতো তার সুন্দর শৈশব কাটালেও এক সময় সেখানে ঝড় উঠতেও দেরি হয়নি। সে পরিস্থিতি আরও দুর্বিষহ এবং বিপন্ন। পিতা মিরাজ আলী প্রাইভেট গাড়ির একজন সুদক্ষ চালক। মা রাবেয়া স্নেহময়ী জননী এবং সফল গৃহিণীও। অর্থবিত্তের তেমন সচ্ছল্য না থাকলেও অভাব-অনটনও সেভাবে ছিল না। বাবা তাকে উত্তরার একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। মালয়েশিয়ান স্কুল এ্যান্ড কলেজে। বাবার ক্ষমতানুযায়ী একটু ব্যয়বহুল। মিরাজ আলী সে বাধাকে অতিক্রম করে মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে যান। আর স্নেহময়ী মা তাকে সমস্ত মায়া মমতায় সর্বক্ষণিক সান্নিধ্য দিয়ে যায়। বড় মেয়ের বিয়ে হয় ছোট বয়সেই। আর ছেলের লেখাপড়ার দিকে তেমন কোন নজর না থাকায় বাবা-মা মোটামুটি হাল ছেড়ে দেয়। তাদের এখন একমাত্র লক্ষ্য ছোট মেয়েকে স্বাবলম্বী করে নিজের পায়ে দাঁড় করানো। মেয়ে বাবা-মার ইচ্ছা এবং আগ্রহকে মূল্য দিয়ে লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী হয়। শুধু তাই নয়, শিক্ষা কার্যক্রমে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্থানে নিজের সাফল্যকে ধরে রাখে। এভাবে সুখে-দুঃখে-আনন্দে সংসারের চাকা চলছিল। কিন্তু এক সময় সেখানে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো দুর্যোগের ঘনঘটা এসে হাজির। ২০১৮ সালে মমতাময়ী মা রাবেয়া হঠাৎ স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং আজ অবধি শয্যাশায়ী থাকা ক্ষুদে মাহফুজার জীবনের এক করুণতম অধ্যায়। এমন দুঃসময়ে স্কুলে যাওয়াও অনিয়মিত হয়ে যায়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর বছর। যে সময়টা সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হওয়ার কথা ছিল সেখানে আসে এক অবর্ণনীয় মনোবেদনা। ১০ বছরের শিশুটি তখন মাকে সেবা করা, সাংসারিক কাজকর্মে নজর দেয়া এমনকি লেখাপড়ার ব্যাপারেও হাল ছাড়েনি। মা এখন কিছুটা সুস্থ হলেও আগের মতো কর্মক্ষম হয়ে উঠতে পারেনি। সুতরাং এখনও মাকে দেখাশোনা করা থেকে শুরু করে পারিবারিক দায়-দায়িত্বও পালন করে যেতে হয়। তবে অদম্য মাহফুজার বয়স যতই অল্প হোক না কেন এক অনমনীয় দৃঢ়চেতা মনোবৃত্তি তাকে ভেতর থেকে চালিত করে। যে ঋদ্ধ চেতনায় সে এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যতেও এর কোন ব্যত্যয় হবে না বলে এই ক্ষুদে প্রত্যয়ী শিক্ষার্থী জানায়। সচেতন, স্বাধীনচেতা মাহফুজা মনে করে মেয়েদের জীবন গড়ার ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে অপরাধই শুধু নয় অভিশাপও বটে। ছোট ছোট মেয়েকে পাচার করে দেয়া কিংবা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মী কাজে নিযুক্ত করাকে মাহফুজা মানতে পারে না। দীপ্ত কণ্ঠে বলে এসব থেকে মেয়েদের বের হয়ে আসতে হবে। এমসিকিউ পদ্ধতি বাতিল হওয়া তাদের জন্য মঙ্গল বলে মাহফুজার অভিমত। এর কারণে পুরো বই ভাল করে পড়তে হয়েছে। সে কারণে ফলাফলেরও উন্নতি হয়েছে। মাহফুজাকে অভিনন্দন এবং সুন্দর ও সফল ভবিষ্যত কামনা।
×