ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

শুরু হতে যাচ্ছে নতুন এক বছর। সৌর জাগতিক নিয়মের গতিধারায় পৃথিবী আবারও, তার পরিক্রমার ৩৬৫ দিন পূর্ণ করতে চলেছে। দিনপঞ্জিকা নতুন সাজে ২০১৯-এর প্রতিটি দিনকে বরণের জন্য তৈরি। কিন্তু নারী সমাজের জন্য কেমন ছিল ২০১৮ সাল? নারীদের প্রাপ্তি অথবা অপ্রাপ্তি ছিল কতটা?

ফিরে দেখা ২০১৮

প্রকাশিত: ০৮:০০, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

ফিরে দেখা ২০১৮

২০১৮ সাল নারীদের জন্য ছিল প্রাপ্তির। নারীর ক্ষমতায়নে আবারও দৃষ্টান্ত স্থাপন বাংলাদেশের। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে নারী-পুরুষ সমতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের উপর স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। ৪টি ক্ষেত্রে এ অবস্থান বিশ্বের সব দেশের উপরে। তা হলো ছেলে ও মেয়ে শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি, মাধ্যমিকে ছেলেমেয়েদের সমতা, সরকারপ্রধান হিসেবে কত সময় ধরে একজন নারী ক্ষমতায় রয়েছেন অন্য ক্ষেত্রটি হলো জন্মের সময় ছেলে ও মেয়ে শিশুর সংখ্যাগত সমতা। এই র‌্যাঙ্কিংয়ে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৮তম। আর এক প্রাপ্তি, বিশ্বে যে সব দেশে নারী রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সবচেয়ে বেশি হয়েছে সে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৫ম। ২০১৮ সালে দেশীয় পরিম-ল ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব নিয়ে ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। নেতৃত্বের বিচারে আন্তর্জাতিক ফোরামে তিনি পরিণত হয়েছেন তৃতীয় বিশ্বের কণ্ঠস্বরে। এ বছর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বসের মতে বিশ্বের ক্ষমতাধর ১০০ নারীর তালিকায় ২৬তম অবস্থানে উঠে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছর তার অবস্থান ছিল ৩০তম। এ তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর এ্যাঙ্গেলা মার্কেল। আট বছর ধরে তিনি শীর্ষ ক্ষমতাধর নারীর অবস্থানটি ধরে রেখেছেন। তালিকায় থাকা ১০০ ক্ষমতাধর নারীর মধ্যে ২০ জন রাজনীতিক। তাঁদের মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা সম্পর্কে সাময়িকীটি লিখেছে, ২০১৭ সালে তিনি মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় এবং তাদের জন্য ২ হাজার একর জমি বরাদ্দ দেন। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে কাজ করছেন। তালিকায় থাকা প্রথম ৫ জনের মধ্যে মার্কেলের পরেই রয়েছেন যথাক্রমে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিন লেগার্ড, যুক্তরাষ্ট্রের মোটরযান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটরসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যারি বারা, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফিডেল্টি ইনভেস্টমেন্টের প্রধান নির্বাহী এ্যাবিগেইল জনসন, বিল এ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের কো-চেয়ার ও মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস। এ বছরই টাইম ম্যাগাজিনের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায়ও নাম এসেছে- শেখ হাসিনার। তিনি লিডার্স ক্যাটাগরিতে ২৭ জন ব্যক্তির মধ্যে হয়েছেন- ২১তম। আবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল সামিট অব উইমেন শেখ হাসিনাকে নারী নেতৃত্বের সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ এ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কার প্রদান করে। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১৮ এর প্রতিপাদ্য ছিল- ‘সময় এখন নারীর উন্নয়নে তারা বদলে যাচ্ছে গ্রাম-শহরে কর্ম জীবন ধারা’। এ বছর, স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৮, পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ( সাহিত্যে)। নৃত্যকলা ও অভিনয় শিল্পের জন্য একুশে পদক ২০১৮ পেয়েছেন মিনু হক ও গবেষণায় অধ্যাপক জুলেখা হক (মরণোত্তর)। আর বেগম রোকেয়া পুরস্কার ২০১৮ পেয়েছেন সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জিন্নাতুননেসা তালুকদার, প্রফেসর জোগরা আনিস, শীলা রায়, রমা চৌধুরী (মরণোত্তর) ও রোকেয়া বেগম। নেটজ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে তথ্য উঠে আসে যে চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে ৬৬২ জন নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৫৭ জনকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে। আর ৫ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। যেখানে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের ইতোমধ্যে নারীর সমঅধিকার, নারীর প্রতি ন্যায়বিচার, নারীর জন্য নিরাপদ আবাসস্থল, কর্মস্থল, নিরাপদে পথচলা নিশ্চিত করার কথা সেখানে কিছু ঘটনা পথচলাটাকে থমকে দেয়। বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাকের সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণপরিবহনে যাতায়াতকারী ৯৪ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার এবং এ হেনস্তাকারীদের ৬৬ শতাংশ পুরুষের বয়স ৪১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে এবং ৩৫ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তারা ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। প্রায় চার দশকের পথ চলায় একটু একটু করে এগিয়ে চলা বাংলার পোশাক শিল্পে শুরু থেকেই বাড়তে থাকে নারীর অংশগ্রহণ। নারীর শ্রমে ঘামে আর নিষ্ঠায় গড়ে ওঠা শিল্প যে কত বড় হতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলার পোশাক শিল্প। প্রতিদিন এ কর্মক্ষেত্রে যোগদেন প্রায় ৪৪ লাখ শ্রমিক। তবে সম্প্রতি বিআইডিএস-সহ বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে পোশাক খাতে কমছে নারীর অংশগ্রহণ। তথ্য মতে কয়েক বছর আগেও পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের ৮০ শতাংশ ছিল নারী, বর্তমানে যা ৬৫ শতাংশের বেশি নয়। কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন পোশাক শিল্পে এসে স্বাবলম্বী নারীরা ছুটছেন নিজস্ব উদ্যোগে আয়ের উৎসের সন্ধানে। আবার কেউ কেউ বলছেন প্রযুক্তিগত জ্ঞানের প্রভাব এবং অভাব- এর জন্য দায়ী। তবে অর্থনীতি বিশ্লেষকদের পরামর্শ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাদের আয়ের পথ তৈরি হচ্ছে কিনা সেই দিকে নজর দেয়ার। এ বছরেই পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করে গেজেট জারি করেছে সরকার। বেসরকারী এক জরিপে উঠে এসেছে পোশাক কারখানায় ৮৩% নারী শ্রমিক যৌন হয়রানির শিকার হয়। ২২% শতাংশ নারী কারখানার ভেতরে অথবা বাইরে শারীরিক মানসিক ও যৌন হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে। ৬৬% শতাংশ মনে করেন তারা কোন বিচার পাবে না বিধায় কোন প্রতিকার চায় না। ৬৮ শতাংশ জানায় তাদের কারখানায় সত্যিকারের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কোন কমিটি নেই। কৃষিখাতের অভাবনীয় অগ্রগতিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল আলোচনায়। প্রবাসে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে কাজের সন্ধানে যাওয়া বাংলাদেশী নারী শ্রমিকদের নির্যাতনের ঘটনাগুলো বছরজুড়েই ছিল আলোচনায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৭৮৯ জন বাংলাদেশী শ্রম অভিবাসীর মধ্যে ৭ লাখ ২৭৮ জন নারী রয়েছেন। এরমধ্যে ২ লাখ ৪ হাজার ৭২৯ জন নারী রয়েছেন সৌদি আরবে। বিদেশে অবস্থানরত এই নারী শ্রমিকদের অধিকাংশই যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এ বছর স্রোতের মতো দেশে ফিরতে শুরু করেছেন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশী নারী শ্রমিকরা। প্রতি মাসে দেশে ফিরেছেন গড়ে ২শ’ নির্যাতিত নারী শ্রমিক। এসব ঘটনার খুব সামান্যই গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। ১৯ মে ফেরত আসা মল্লিকা জানান, সৌদি আরবে প্রতিনিয়ত তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তাকে আটকে রেখে ইলেকট্রিক শক দেয়ার পাশাপাশি রড গরম করে ছেঁকা পর্যন্ত দেয়া হতো। দিনাজপুরের মনজুরা বেগম বলেন, ‘আমার পাসপোর্টসহ ইজ্জত-সম্মান সব দিয়ে (ধর্ষিতা হয়ে) এসেছি। মালিকের নির্যাতন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের দূতাবাসে যাই। দূতাবাস থেকে ট্রাভেল পাস নিয়ে দেশে আসি।’ যৌন হেনস্তার ভয়াবহ অবস্থা তুলে ধরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডলইস্ট আই। গত ৩১ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদনে পত্রিকাটি জানিয়েছে, নিয়োগকারীদের দ্বারা যৌন ও শারীরিকভাবে নিপীড়নের শিকার হয়ে শত শত নারী কাজ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। আর চলতি বছরে নারী শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার হার প্রথম দু’মাসে পূর্বের ন্যায় থাকলেও বর্তমানে একেবারেই কমে গেছে। ২০০৬ সালে একজন মার্কিন এ্যাক্টিভিস্ট প্রথম # মি টু ধারণাটি ব্যবহার করলেও এটি গত বছর বেশি প্রচার পায় হলিউডে। বেশ বড় সংখ্যায় অভিনেত্রী সেখানকার শীর্ষ একজন প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগকে কেন্দ্র করে তাদের নীরবতা ভাঙার পর। বিচারের মুখোমুখি রয়েছেন হার্ভি ওয়াইনস্টিন। হ্যাশ ট্যাগ মি টু প্রথমে শুরু করেছিলেন সমাজকর্মী তারানা বুর্ক এবং পরে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় অভিনেত্রী আলিসা মিলানো প্রযোজক হার্ভি ওয়েনস্টেইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রকাশের পর। বিশ্বজুড়ে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারীদের অনেকেই এ প্রচারণায় এগিয়ে আসেন এবং অনেকেই নিজের ঘটে যাওয়া এসব হয়রানির ঘটনা প্রকাশ করেন। যৌন হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বেশ বড় সড় মিছিল হয়েছে হলিউডে। তারানা বুর্ক নিজেই হলিউডের এ মিছিলের নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশে এ ধরনের অভিযোগ প্রথম নিয়ে আসেন মাকসুদা আখতার প্রিয়তি নামে একজন প্রবাসী বাংলাদেশী মডেল। ২৯ অক্টোবর একটি ফেসবুক পোস্ট সরাসরি একজন ব্যবসায়ীর নাম করে তিনি লেখেন, ২০১৫ সালে ওই ব্যবসায়ী তার শরীরে হাত দিয়েছিলেন, ধর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন। এতে যোগদেন আরও কিছু বাংলাদেশী নারী। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে নারী সমাজের প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে এ বছরও # মি টু ছিল আলোচনায়। আগামী দিনেও সমাজ বদলে এ ধারা অব্যাহত থাকবে এটা আশা করাই যায়। এ বছর শান্তিতে নোবেল পেলেন কুর্দি মানবাধিকার কর্মী নাদিয়া মুরাদ। যুদ্ধকালীন ও সশস্ত্র সংগ্রামের সময় যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে অবদান রাখার জন্য তাদের এই পুরস্কার দেয়া হয় বলে জানিয়েছে নোবেল কমিটি। আইএস কর্তৃক অপহৃত ও নির্যাতিত হয়েও জীবনের আশা ছাড়েননি এই তরুণী। বার বার চেষ্টার পর এক সময় পালাতে সক্ষম হন নাদিয়া। ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সামনে যুদ্ধাক্রান্ত অঞ্চলে মানব পাচারের মানবিক সংকটের দিকটি বর্ণনা করেন। এ ভাবেই তিনি পরিণত হন নির্যাতিতদের মুখপাত্রে। নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য কাজ করেছেন। ক্রমেই হয়ে উঠেছেন মানবতাবিরোধী সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক অকুতোভয় যোদ্ধা। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ যে বিশ্বাসী তা আবারও প্রমাণিত হলো। এবার এ ক্ষমতায়নের আর এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ প্রথম নারী মেজর জেনারেল সুসানে গীতি। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোন নারী মেজর জেনারেল পদে পেলেন পদোন্নতি। এছাড়াও তিনি প্রথম নারী যিনি ১৯৯৬ সালে হেমাটোলজিতে এফসিপিএস ডিগ্রী অর্জন করেন। নিজের যোগ্যতা নিয়ে দেশ ও বিশ্ব শান্তির জন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপ-উপাচার্য হিসেবে তিনি ৭ মার্চ ২০১৮ যোগদান করেন ডা. সাহানা আখতার রহমান। চিকিৎসা পেশায় দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসা ডাঃ সাহানার এই নিয়োগও নারী ক্ষমতায়নের অন্যতম দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম নারী রেজিস্ট্রার নিয়োগ পান রহিমা কানিজ। ২৯ জুন তারিখে রেজিস্ট্রার হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। নারীরা যে সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে তার মেধা, যোগ্যতা আর মনোবল দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তারই অন্যতম উদাহরণ তিনি। জ্ঞান, পরিশ্রম, বুদ্ধি, মেধা আর মননশীলতার জোরে বাঙালী নারী পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই হয়ে উঠতে পারেন বাংলার অহঙ্কার। সেটি এবার প্রমাণ করলেন কানাডায় বাঙালী বংশোদ্ভূত ডলি বেগম। সেখানকার অন্টারিও প্রদেশে প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনিই প্রথমবারের মতো নির্বাচিত বাংলাদেশী প্রাদেশিক এমপি। তারই হাত ধরে দীর্ঘ ১৫ বছর পর দেশটির অন্টারিও প্রদেশের স্কোরবোরো সাউথ ওয়েস্টে জয় পেয়েছে নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। পৃথিবীজুড়ে সমাজ পরিবর্তনে অবদান রাখা তরুণদের সম্মান জানাতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার গ্রহণ করেছে ইমার্জিং ইয়াং লিডারস প্রোগ্রাম। এ বছর সেরা দশে ঠাঁই করে নিয়েছেন বাংলাদেশের তরুণী তানজিল ফেরদৌস। তিনি ২০১৫তে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ’। বাংলাদেশে তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের বৃহত্তম প্ল্যাটফর্ম। কাজ করছেন সামাজিক উন্নয়ন ও নারী অধিকারের মতো বিষয় নিয়ে। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ করে চলেছেন নিরলস। জাগো ফাউন্ডেশনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন অন্তত ৫০০ রোহিঙ্গা শিশুর। সামারা মোহম্মাদ বাদাবি, সৌদি আরবের মানবাধিকার কর্মী। এ বছর সৌদি আরব-কানাডার সম্পর্কের অবনতির অন্যতম কারণ তিনি। তাকে কেন্দ্র করে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক টুইট বার্তাকে ভালভাবে নেয়নি সৌদি সরকার। সৌদি আরবের মতো রক্ষণশীল দেশে নারী অধিকারের পক্ষে সোচ্চার সামারা বাদাবি সারা বিশ্বে আলোচিত অনেক দিন। নিজের পরিবারে পিতা কর্তৃক শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৫ বছর ধরে। সৌদি আরবে পুরুষতান্ত্রিক অভিভাবকত্বের যে প্রথা তা নিয়ে তার পিতার বিরুদ্ধে মামলা করে সামারা আলোচনায় আসেন। সামারা যে কেবল নিজের পক্ষেই কথা বলেছেন তা নয়, কথা বলেছেন সব সৌদি নারীর হয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভাষ্যমতে সামারাই প্রথম নারী যিনি সৌদি আরবে নারী ভোটাধিকারের পক্ষে আইনী যুদ্ধ শুরু করেন। ২০১১-১২ তে নারীদের গাড়ি চালনার অধিকারের দাবিতে সৌদি আরবজুড়ে যে ক্যাম্পেইন শুরু হয় সামারা ছিলেন সেটিরও প্রথম সারির কর্মী। সুদানে অধিকাংশ নারীই মেয়েদের খৎনা বা এফজিএমের শিকার হয়। আফ্রিকার অন্য কিছু দেশেও অস্তিত্ব আছে এ প্রথার। এ কারণে পুরো মহাদেশের জন্যই ব্রিটিশ সরকার এ বছর পাঁচ কোটি পাউন্ডের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সারা জাগানো খবর হলো সুদানে অন্তত একটি গ্রাম পাওয়া গেছে যেখানে বাসিন্দারা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে ইতোমধ্যেই এ প্রথা সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করেছেন। যা শুধু সুদান নয় সারা বিশ্বের নারীর মুক্তির গৌরব গাথা। তবে সুদানে এখনও ৮৭ শতাংশ মেয়ে খৎনার শিকার। সুদানের সরকার আশা করছে, আন্তর্জাতিক সাহায্য নিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে এই প্রাচীন প্রথা সম্পূর্ণ তুলে দেয়া সম্ভব হবে। নেপালকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের মেয়েরা। টুর্নামেন্ট জুড়ে আলো ছড়িয়ে সাফ অনুর্ধ-১৮ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম আসরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। মেয়েদের এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টিতে ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। দ্বিপক্ষীয় সিরিজের বাইরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশকে প্রথম কোন টুর্নামেন্টের শিরোপা উপহার দিয়ে ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশের মেয়েরা। বাল্যবিবাহকে ইতি জানিয়ে, সমাজ, পরিবার, স্কুলের সঙ্গে যুদ্ধ করে ইতি হয়েছেন আর্চার। প্রথমবার জাতীয় আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে নজর কেড়েছেন। সংগ্রামী এই তরুণী আলোচনায় ছিলেন এ বছর। ২০১৮-এর মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় এবারের মিস ওয়ার্ল্ড হয়েছেন মেক্সিকান তরুণী ভেনেসা পনসে দে লিওন। এবারেই প্রথম বাংলাদেশের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী সেরা ত্রিশ নির্বাচিত হয়ে ফাইনালের মঞ্চে উঠেছিলেন। আর ২০১৮ সালের মিস ইউনিভার্সের মুকুট উঠল ফিলিপিন্সের প্রতিযোগী ক্যাটরিওনা এলিসা গে এর মাথায়। ‘ঢাকা লিট ফেস্টে’ এবার নারীর অধিকার ও বাকস্বাধীনতা বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। বলিউডের দুই অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা ও নন্দিতা দাস কথা বলেছেন চলচ্চিত্র ও সমাজের নারীর অবস্থান নিয়ে। মনীষা কৈরালা বলেন, পরিচালক হিসেবে এখনও মানুষ একজন নারীকে কল্পনা করতে পারে না। আর এটা শুধু চলচ্চিত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই হয়ে আসছে। সব ক্ষেত্রে নারীর অধিকার অর্জনের জন্য আত্মবিশ্বাসী হয়ে নারীদেরই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। নন্দিতা দাসের আলোচনায় উঠে আসে নারীর প্রতি বর্ণবাদ প্রসঙ্গটি। তিনি বলেন, গায়ের রং কালো হওয়া কোন দিনই কোন মেয়ের জন্য আশীর্বাদ ছিল না। এই একবিংশ শতাব্দীতেও সেই অবস্থা একই রয়েছে। ভাল-মন্দ প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি নিয়েই বিদায় নিচ্ছে ২০১৮। বছরের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমাদের অবশ্যই কৃতজ্ঞচিত্তে সম্মান জানাতে হবে তৃণমূলের সেই সব সংগ্রামী নারীদের, নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে যারা রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নারী জাগরণ, উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে ২০১৯ হয়ে উঠুক সফলতার আর এক নতুন বছর।
×