ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মইনুল ইসলাম

১৪ দলীয় জোট সরকার আরেকবার দরকার

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৬ নভেম্বর ২০১৮

১৪ দলীয় জোট সরকার আরেকবার দরকার

নির্বাচন আসন্ন। দেশজুড়ে এর ডামাডোল বাজছে। একটি আনন্দ-উল্লাসের ভাব দেশে বিরাজ করছে। তার সঙ্গে জনমনে কিছু শঙ্কা আছে- পাছে না কোন অঘটন ঘটে। তবে সাধারণ মানুষ চায় একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। গণতন্ত্রের জন্য একটি অপরিহার্য কাজ নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হোক। রাষ্ট্র এবং সমাজে স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করুক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকে। তারা নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ শাসনের জন্য জনগণের রায় বা সম্মতি চায়। যে দল বা জোট নির্বাচনে সর্বাধিক ভোট পায় অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রায় পায় তারাই সরকার গঠন করে এবং দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন কি শুধু কিছু সংখ্যক বিজয়ী রাজনীতিকের রাষ্ট্রীয় মসনদে আসীন হওয়ার সিংহ দরজা খুলে দেয়ার চাবিকাঠি? নাকি বিজয়ী দল ও তাদের নেতা-নেত্রীকে দেশবাসীর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতি সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রদান করে? নির্বাচনের সময় প্রতিযোগী দলগুলো নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো বা ইশতেহার প্রকাশ করে। তাতে ক্ষমতায় গেলে তারা জনগণের মঙ্গল ও উন্নয়নের জন্য বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। এটাকে জনগণের সঙ্গে তাদের একটি সামাজিক চুক্তি বা Social contract ও বলা যায়। আমাদের মতো স্বল্পোন্নত এবং স্বল্পশিক্ষিত মানুষের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক উন্নয়ন তথা গণতন্ত্রের বিকাশই জনগণের মঙ্গল এবং উন্নয়ন পরিমাপ করার মাপকাঠি। ’৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই আমাদের দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বলা যায়, দেশে গণতন্ত্র চর্চা চলছে এবং নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করছে। প্রথম কথা আমাদের মতো দেশে যত সুষ্ঠু বা ভাল নির্বাচনই হোক তাতেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না, তার জন্য আরও প্রধান দুটো প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে আইনের শাসন ও সুশাসন এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। কিছুটা পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও বলতে হয়, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সরকারের দুটি প্রধান কাজের একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্যবিমোচন এবং জীবনমানের উন্নয়ন সাধন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে দেশবাসীর মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো নিশ্চিতকরণ ও রাষ্ট্রে জনগণের ক্ষমতায়ন বা Empowerment of People. দেশে এখন দুটি বড় দল আছে। একটি হলো আওয়ামী লীগ এবং অন্যটি হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। বিএনপির কথায় আসা যাক। দলটি মূলত দুই মেয়াদে ১০ বছর দেশ শাসন করেছে। তাদের দীর্ঘ সেই শাসনকালের সব কর্মকান্ডের কথা এই সীমিত পরিসরে বলা যাবে না এবং বৃহৎ ও মহৎ কোন ঘটনা উল্লেখ করার মতো কিছু নেই। তবে সম্প্রতি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়ে দলটির শীর্ষ নেত্রী এবং আরেকজন শীর্ষ নেতার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য এবং আদর্শ-উদ্দেশ্য বেশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দুটির রায়ে এটা পরিষ্কার যে, বিএনপির শীর্ষ নেত্রী বড় মাপের দুর্নীতিবাজ। তার পুত্রধন এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। তাছাড়া অরেকটি বড় গুণ হলো পৈশাচিক হত্যাকান্ড ঘটানোর ব্যাপারে তার পারঙ্গমতা, যা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় প্রমাণ হয়েছে। ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার সভায় গ্রেনেড হামলার মামলাটি হওয়ার পরই সচেতন মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয়নি এটা কাদের কাজ। আদালতের রায় তাই নিশ্চিত করল মাত্র। এ কারণেই কি তা হলে কানাডীয় আদালত বিএনপির এক সাফল্যের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার রায়ে দলটিকে সন্ত্রাসী দল বলে আখ্যায়িত করেছিল? যা হোক, উন্নয়নের মাত্র একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করলেই এ ব্যাপারে তাদের রেকর্ড বোঝা যাবে। এটা সবাই জানে বিএনপির দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০১-২০০৫) বিদ্যুত উৎপাদনে ধস নেমেছিল। কল-কারখানা এবং অফিস-আদালত প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আওয়ামী সরকারের শেষ দিকে (২০০০ সালে) বিদ্যুতের সরবরাহ ছিল ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াট আর বিএনপি শাসনের শেষ দিকে (২০০৫ সালে) তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২১০০ মেগাওয়াটে, অর্থাৎ অর্ধেকে। তখন ঘনঘন লোডশেডিংয়ের দুঃসহ স্মৃতি এখনও আমাদের তাড়া করে ফেরে। তখন বিদ্যুতের বদলে শুধু খুঁটি বা খাম্বা উৎপাদন হতো। কারণ, এ ব্যবসাটির বড় মালিক ছিল তারেকের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুন। তবে উন্নয়ন হয়েছিল দুর্নীতির। তখন বাংলাদেশ পরপর ৪ বার বিশ্বের সেরা দুর্নীতিবাজ দেশ বলে পরিচিতি পায়। তাদের দুঃশাসন, দুর্নীতি এবং হাওয়া ভবনের কীর্তি কাহিনীর বিরাট ফিরিস্তির কথা বলে শেষ করা যাবে না। এবার আওয়ামী লীগের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট ক্ষমতায় আছে আজ প্রায় ১০ বছর। এই দশ বছরে দেশে প্রশংসনীয় উন্নয়ন হয়েছে। এ প্রশংসা শুধু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নয়। জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (UNDP), বিশ্বব্যাংক (World Bank) এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (ADB) মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোরও একই মত। গত ১০ বছর যাবত আমাদের জিডিপি শতকরা ৭ দশমিকের চেয়ে বেশি বেড়েছে, যা একটি স্বল্পোন্নত দেশের জন্য প্রশংসনীয় সাফল্য ও উন্নয়নের পরিচায়ক। বিশ্বব্যাংকের মতো উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কাছ থেকে আমরা এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছি। তবে জীবনমানের সূচকে এখনও আমরা স্বল্পোন্নত গরিব দেশ। তবে আমাদের দারিদ্র্য কমছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে। আর অগ্রগতির সঙ্গে যে আশার আলো জাতীয় জীবনে সঞ্চারিত হয়েছে তা গত ১০ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দলীয় সরকারের প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে। দেশে দারিদ্র্যের হার কমছে। গেল বছর (২০১৭) এ হার দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৩ শতাংশে, যা ২০১৬ সালে ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে। ২০১৮ সালে বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন সূচকে (Human Development Index) বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়েছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকেও আমরা এগিয়েছি। ক্ষুধা দূরীকরণে আমরা ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছি। সামাজিক অবকাঠামো তথা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আমাদের প্রশংসনীয় অগ্রগতি হয়েছে। তেমনি হয়েছে ভৌতিক অবকাঠামোর ক্ষেত্রেও। রাস্তাঘাট, সড়ক, সেতু, রেলওয়ে, বন্দর, বিদ্যুত, জ্বালানিসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক ‘উন্নয়ন’ সাধিত হয়েছে। দুটি মেগা বা বৃহৎ প্রকল্প যথা পদ্মা সেতু এবং ঢাকা মেট্রো রেল প্রকল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। এ দুটিসহ চলমান সব প্রকল্পের সফল সমাপ্তির জন্য ১৪ দলীয় সরকারের বিকল্প নেই বলে, আমাদের বিশ্বাস। তবে এসব চমৎকার সাফল্যের সঙ্গে কিছু অসাফল্যও আছে। দেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য যথেষ্ট বেড়েছে। সুশাসনের অভাব এবং দুর্নীতির অভিশাপ এখনও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে ইদানীং বেশ সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। মোট কথা দেশে সুশাসন ও আইনের শাসনের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। তবে সার্বিক বিবেচনায় ১৪ দলীয় জোটের আমলে দেশের প্রশংসনীয় উন্নয়ন ঘটেছে। এখন আমরা আর সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের Bottonless basket বা তলাবিহীন ঝুড়ি নই। বরং বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল বা অনুকরণীয় আদর্শ। এ সম্মান শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারই আমাদের জন্য এনে দিয়েছে। এটাও বলা দরকার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করি। তাই তারা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে তা খুবই স্বাভাবিক। ’৭১-এ পাক হানাদার বাহিনীর দোসর এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি বর্তমান সরকার ছাড়া আর কেউ করত বলে আমাদের বিশ্বাস হয় না। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পাকিস্তানপন্থী জামায়াত-শিবিরের সহযোগী এবং বন্ধু যে বিএনপি তা দেশবাসীর অজানা নয়। তাই মুক্তিযুদ্ধের ঘোরতরবিরোধী শক্তির বন্ধু বাংলাদেশের আদর্শ এবং উদ্দেশ্যের ধারক ও বাহক হতে পারে না। তাছাড়া বিএনপি ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে যে অগ্নিসন্ত্রাস চালায় তা কি করে ভুলে যাই! ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে হরতাল-অবরোধ ডেকে ৯৩ দিন দেশজুড়ে বিএনপি যে প্রলয়কান্ড ঘটায় তা স্মরণ করলে আজও গা শিউরে ওঠে। পেট্রোলবোমার আগুনে ৪ হাজার নিরাপরাধ মানুষ দগ্ধ হয়, যার মধ্যে ৫০০ জন মারা যায়। এটাই কি বিএনপির গণতন্ত্রপ্রীতি? এটাই কি তাদের দেশপ্রেম এবং দেশবাসীর প্রতি ভালবাসা? নির্বাচনকে সামনে রেখে মানুষের বড় ভয় উপরোক্ত অশুভ শক্তি ক্ষমতায় ফিরে এলে প্রতিশোধ এবং প্রতিহিংসার রাজত্ব কায়েম হতে পারে। নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে হাওয়া ভবন। স্থগিত বা স্থবির হয়ে পড়তে পারে সব প্রকার উন্নয়ন। উন্নয়নে যে গতি সৃষ্টি হয়েছে তাকে অধিকতর গতিশীল করতে এবং স্থাপিত ভিত্তিকে আরও মজবুত করতে শেখ হাসিনা ও ১৪ দলীয় জোটের আপাতত কোন বিকল্প নেই। দেশ আজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে মার্কিন অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম রস্টোর ঔধশব ড়ভভ ংঃধমব বা উড়াল দেয়ার পর্যায়ে এগিয়ে চলেছে। তাই বর্তমান সরকার অন্তত আরেকবার দরকার। তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে আশা করব তাদের সরকার সুশাসন, বৈষম্য নিরসন এবং মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে অধিকতর মনোযোগী হবে। আসন্ন নির্বাচন প্রসঙ্গে এ ধরনের কিছু প্রয়োজনীয় কথা না বলে পারা যায় না। লেখক : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×