ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ভাল থাকুন কবি

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

ভাল থাকুন কবি

কবি মাসুদ মুস্তাফিজের সঙ্গে আমার আলাপ কোন এক বইমেলায়। শুভ্রকেশ এই মানুষটি বয়েসে আমার অনুজ। বেশ মনে আছে যে আমি প্রথম আলাপে বলেছিলাম আমি কিন্তু আপনার কবিতা পড়ি, বেশ ভাল লাগে। সামান্য ভ্রু কুঁচকে বলেছিলেন কোন কবিতাটা বেশ ভাল লেগেছে? কবিদের প্রশংসা করলে সাধারণত তারা ধন্য হন। বিরাট বিরাট ধন্যবাদ দেন। উল্টো প্রশ্ন খুব কম মানুষই করেন। বললাম -‘মানুষ তো আসলে ঘরে আসে না-/কিংবা যায়ও না শুধুই ঘর বানায়/আর রাত যাপনের দিন পার করে/দিনের বনসাই হয়ে বেঁচে থাকে/অথচ চাঁদরাই প্রথম প্রজ্ঞাল পাঠাল কালোছায়ার নীল বর্ণজলে।’ তিনি কিছুটা প্রশ্রয়ের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তারপর থেকে তার সঙ্গে আমার আত্মীয়তা কবিতায়। তাঁর আরেকটি কবিতার লাইন আমার চেতনায় মুহুর্মুহু ঢেউ তোলে। আজকাল নিরামিশ চুমুর ভাঁজে কিছুই প্রত্যাশা করি না/শুধু বেঁচে থাকি বিপন্ন বিষন্ন সিলেবাসনির্ভর চুমুর সংসারে নৈরাশ্যবোধ, হতাশা, ক্লিষ্টতাময় জীবনের দৃশ্যমান অভিজ্ঞতা এ কবির কবিতায় সঙ্কটের সত্যমৌলিকতাকে বিকাশ ঘটায়। অস্তিত্ব সংসারবেদনা অপ্রাপ্তিবোধ মানুষের জীবন স্পন্দনকে নির্বিকারচিত্তে বিমূর্তের জাগরণ ঘটায়। রাষ্ট্রযন্ত্রের স্থূলতা, ঐতিহ্যের পর স্পর্শকে অস্বীকার করে নিজের জীবনযাপনের পথকে বৃত্তাবদ্ধ করে মনোজগতে স্থির নয় তবে মিশ্র স্থিরতায় রক্তীয় বীজের জাগরণ আমাদের হতাশা আর নৈরাশ্যপ্রবণ বা ক্রমশ আবেগপ্রবণহীন ভিন্ন মানুষ রূপে রূপান্তরিত করে, যা কিনা অস্তিত্ব সঙ্কটের এক দুঃখের তীব্র যন্ত্রণাবোধকে প্রাণিত করে তোলে। কবি সেই দুঃখ আর নৈরাশ্যবোধের চেতনা থেকেই লিখেন- ‘একাত্তরের লালচোখে স্বপ্নের রঙে শূন্যতার ফুল ফোটে একটি ফুল একটি দেশ একটি নাম বাংলদেশ/সুখের পদাবলিতে মাটির বিভাজনে নিজেকে চিনি আর ইতিহাসের বয়স বেড়ে যায়/আর বয়সের শাদাকালো আগুনে মন-হƒদয় পুড়ে পুড়ে মাটির বিশ্বাসে যৌবনবর্তী হয়ে উঠছি/আমরা চুয়াল্লিশ বছরেও দুঃসময় কাটিয়ে উঠেনি কেউ’। মাসুদ মুস্তাফিজ উত্তরবঙ্গের মানুষ। আমার মা উত্তরবঙ্গের ছিন্নমূল উদ্বাস্তু। কাজেই এই কবির অনেক কথা আমার সহজে বোধগম্য হয়। তাঁকে আমি অনুভব করতে পারি। তাঁর কবিতাকে স্পর্শ করতে পারি। তার আবেগকে ছুঁতে পারি। তাঁর কবিতায় দেখি- ‘এই বালিকা শহরে বৃষ্টিকে প্রথম যেদিন বুঝেছি কবিতা না বোঝা মেঘকন্যারা লজ্জায় মুখ লুকোতো আর মেঘের সবুজমনে ফরিঙঘোড়া দাঁপিয়ে দাঁপিয়ে আমি মেঘের ইন্দ্রজালে হারিয়ে যেতাম উড়ে যাওয়া মেঘের অন্তর্বাস খুলে বাতাসে ভাসিয়ে উর্বশী চাঁদের বৃষ্টিবিরহে স্বপ্নের ঘর তৈরি করত’ ‘নিঃশ্বাস পতনের শব্দ’ ও ‘স্বপ্নপোড়ারোদ আর সুবর্ণ বাংলাদেশ’ এ দুটো কবিতাই সাক্ষ্য দেবে মাসুদ মুস্তাফিজের বিরামহীন নিরীক্ষালগ্নতা। এ নিরীক্ষা যেমন ভাষাকাঠামোর তেমনি আঙ্গিক সংস্থানেরও। আর তাৎপর্যের দিক হচ্ছে আধুনিক কবিতা নিয়ে জনযোগাযোগহীনতার যে অভিযোগ তা থেকেও তার কবিতা আশ্চর্যরকমভাবে মুক্ত। কেন তাঁর কবিতা এত মনোগ্রাহী? এক কথায় বলা যায় তাঁর অধিকাংশ কবিতার অবয়ব ছোট। শব্দের ব্যবহারজনিত সংযম ও কৃপণতা এবং স্পেস ও সাংকেতিকতা, পরিহাস ও স্যাটায়ার সহযোগে কবিতার ভাষা উত্তরাধুনিক কবিতার মতো অনেক বেশি তীর্যক যা আমরা অন্যদের কবিতায় পাই না। তিনি ফতোয়াকে আক্রমণ করেছেন কিন্তু তাঁকে অস্বীকার করেননি। তিনি পরিমিতিবোধের কবি, স্মিতবাক কবি, ভদ্রগোছের কবি। তাঁর মুগ্ধতার ভাষা অনুদ্বেলিত, তাঁর ঘৃণার ভাষা সুপরিশীলিত; তাঁর প্রতিবাদের ভাষা বিদ্বেষমুক্ত, তাঁর প্রেমের ভাষা পরিণত। সব ক্ষেত্রেই তিনি আবেগের আতিশয্য এবং উচ্চারণের প্রগলভতাকে পরিহার করেছেন। তিনি কল্পনাকেও কখনও লাগামহীন হতে দেননি। উদার মানবতাবাদে গভীরভাবে বিশ্বাসী কবি। তাঁর কবিতায় মানবতবাদী সুর প্রবল, তবে তা প্রগলভ নয়। আধুনিক কবি হয়েও তিনি শিল্পের বিমানবিকীকরণ তত্ত্বে গা ভাসিয়ে দেননি। নিঃসর্গ তাঁকে মুগ্ধতা দেয়, কিন্তু নৈসর্গিকতাকে তিনি কখনও বান্ময় করে তোলেন মানব জৈবিকতার লীলার প্রেক্ষিত হিসেবেও। নৈসর্গিক ও মানবিক হয়ে ওঠে সমন্বয়ী ও সংশ্লেষিত। তিনি লিখছেন- ‘যে শহরে পিঁপড়ে নেই/সেই শহরে মানুষ থাকে-/ পিঁপড়ের কাছে জীবন শিখে/বীজ থেকে জন্মের পথিককাল পেরিয়ে মাটির দ্রোহ ভেঙে জলপাই রঙের নতুন ছাই হয়/সময়ের এ্যাক দূর-চিহ্ন ছিঁড়ে পৃথিবীর স্বপ্নযাত্রাপখে অনেক সূর্যক্ষয় অথচ কিছু কিছু মৃত্যু অপ্রকাশ্যেই লেখা থাকে মাটির বরপুত্র হয়েও মাটিতেই নেবে যাবে সব অমরসত্য/যেমন অনেক জীবন প্রকাশ্যেই মিথ্যে হয়ে যায় আমরা লোকালয়ের জানালা ভেদে নিঃসঙ্গতার চর্চা করি গহীন ভাতবাতাসের দিনে/অথচ কোন মাসে ফুল না ফুটলে আমাদের বন্ধুত্বের নিষ্কণ্টক সম্পর্কের কিছুই হয় না। এক আলোচনায় তিনি বলেছিলেন- ‘সাহিত্যের একটা লিটারেরি প্রপার্টি বা সাহিত্যমূল্য আছে। লেখাটি যখন শুধু লেখা মাত্রই থাকে, তখন সেটার কোন মূল্য নেই। এটা একটা বর্ণনা হতে পারে, অন্তর্গত বোধ হতে পারে। কিন্তু লেখার ভেতর যখন সাহিত্য মূল্যটা থাকবে, তখন এটাকে আমি বলব, এটা শিল্প হয়ে উঠেছে; কবিতা হয়েছে। একজন কবির কাজ অন্বেষণ করা, আবিষ্কার করা নয়। তাঁর ভেতরে সবসময় অতৃপ্তি ও অন্বেষণ করার তাগিদ থাকে। মননশীলতা ও সৃজনশীলতার সমন্বয়ে কবিতা রচনা করেন তিনি। কবি মাসুদ মুস্তাফিজ শুধু বাংলাদেশে নয় ভারতেও প্রতিষ্ঠিত, আমাদের দেশের দৈনিক, সাহিত্য কাগজ, ছোট কাগজে যেমন, কৃত্তিবাস, দেশ, কবিতানগর, কবিতা ক্যাম্পাসসহ অনেক কাগজে লেখেন। এবারের বাংলাদেশের নির্বাচিত নয়ের দশকে প্রকাশিতব্য কবিতা ক্যাম্পাস সংখ্যায় তাঁর কবিতা, কবিতার ওপর আলোচনা বেরুবে। বর্তমান কবিতা ক্যাম্পাস অনুকবিতা সংখ্যায় মাসুদ মুস্তাফিজের একগুচ্ছ কবিতা বের হয়। চলতি ভারত বিচিত্রায় তাঁর কবিতা প্রকাশ পেয়েছে। জয় হোক কবিরÑসমৃদ্ধ হোক বাঙলা কবিতার। এখানকার পাঠকরা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে বলশালী। বর্তমানে ইন্টারনেটের সৌজন্যে দুধ কা দুধ পানি কা পানি সহজেই বোঝা যায়। সে জন্য আমরা তাকিয়ে থাকি তাঁর কবিতা দর্শনের অপেক্ষায়। তাঁর ৪৯তম জন্মদিনে তাই প্রার্থনা একটাই, ভাল থাকুন, তাহলেই আমরা ভাল লেখা পাব।
×